একটি ছবি, হ্যামিল্টন-স্মৃতি এবং নাসিরের জন্য দীর্ঘশ্বাস

উৎপল শুভ্র

১৫ জুলাই ২০২১

একটি ছবি, হ্যামিল্টন-স্মৃতি এবং নাসিরের জন্য দীর্ঘশ্বাস

প্রায় সব ছবিতেই স্মৃতি লুকিয়ে থাকে। কখনো কখনো গল্প্‌ও। ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগের রাতে তোলা এই ছবিটাই যেমন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল ওই দেশে আমার প্রিয় শহর হ্যামিল্টনে।

খেলা কাভার করতে এত দেশে গিয়েছি, সবচেয়ে ভালো লেগেছে কোন দেশ? বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন প্রায়ই প্রশ্নটা করেন। আমি একটুও না ভেবে বলে দিই--নিউজিল্যান্ড।

সেই নিউজিল্যান্ডে আমার সবচেয়ে প্রিয় শহরের নাম হ্যামিল্টন। শান্তির চাদরে ঢাকা ছোট্ট একটা ছিমছাম শহর। এমনিতেই ভালো লাগার মতো। আমার আরও বেশি ভালো লাগে অবশ্য অন্য কারণে। ২০০১ সালে প্রথমবার নিউজিল্যান্ডে প্রথম ট্যুরে অকল্যান্ডে বন্ধুর বাড়িতে এক রাত কাটিয়েই চলে গিয়েছিলাম হ্যামিল্টনে। পরের চারটি ট্যুরেও হ্যামিল্টন ছিল কমন। ২০০১ থেকে ২০১৯---শহরটা যেন একই রকম আছে। প্রতিবারই উঠেছি টিম হোটেল নভোটেল তানুইয়ে। যেটির পাশেই ওয়াইকাটো নদী। ওই হোটেল, ওই নদী, হোটেল থেকে মিনিট দশ/বারোর হাঁটা দূরত্বের মাঠে যাওয়ার রাস্তা সব এমন আপন লাগে যে, হ্যামিল্টন কেমন যেন একটা 'বাড়ি ফেরা'র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে দেয়। 

তা এই ছবির সঙ্গে হ্যামিল্টনের কী সম্পর্ক? ছবিটা দেখেই তো মনে পড়ল হ্যামিল্টন। নভোটেল তানুই হোটেলের সামনের রাস্তা পেরিয়ে একটু হাঁটলেই একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। ২০০১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রথম চারটি ট্যুরেই খাওয়া-দাওয়া বেশির ভাগ সময় ওখানেই হয়েছে। ক্রিকেটারদেরও তা-ই। আশেপাশে আরও কয়েকটা রেস্টুরেন্ট। সন্ধ্যার পর ওখানে ক্রিকেটারদের সঙ্গে তাই নিয়মিতই একটা আড্ডা জমত। নিউজিল্যান্ডের এই একটা মজা। সন্ধ্যায় আড্ডা-টাড্ডা মেরে রাত ১০টায় লিখতে বসলেও ডেডলাইন চোখ রাঙায় না। সমস্যা হয় একটাই, লেখা শেষ হতে হতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে। এটা অবশ্য আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। ডেডলাইন ঘাড়ের ওপর এসে না পড়লে লিখতে না পারার অভ্যাসের কারণে বিনিদ্র রাতকে নিয়তি মেনেই আমি নিউজিল্য্যান্ড যাই।

২০১৯ সালে সর্বশেষবার নিউজিল্যান্ডে গিয়ে দেখি, আগের ট্যুরগুলোতে ছোট্ট কিন্তু আন্তরিক যে রেস্টুরেন্টটাতে বেশি  লাঞ্চ/ডিনার করেছি, সেই্ রেস্টুরেন্টটা আর নেই। খুব মন খারাপ হলো। ভারতীয় মালিক দম্পতির সঙ্গেও যে চেনাজানা হয়ে গিয়েছিল। তখন কি আর জানতাম,পরদিনই নাটকীয়ভাবে তাঁদের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাবে? দুপুরে লাঞ্চ করব বলে নভোটেল তানুই হোটেল থেকে মাত্র বেরিয়েছি। হঠাৎই হোটেলের সামনে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যেতে যেতে একটা প্রাইভেট কার আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়াল। ড্রাইভিং সিটে বসা ভদ্রলোক দেখি আমার দিকেই হাসিমুখে তাকিয়ে। জানতে চাইছেন, 'হাউ আর ইউ, মাই বাংলাদেশি ফ্রেন্ড?'

আমি তো যারপরনাই অবাক। নিউজিল্যান্ডে অনেকবার আসার সুবাদে আমাকে 'বাংলাদেশি ফ্রেন্ড' বলে ডাকতে পারেন, এমন কয়েকজন অবশ্যই আছেন। কিন্তু উপমহাদেশীয় এই এই ভদ্রলোককে তো চিনতে পারছি না। গাড়িটার একটু কাছে যেতেই চিনতে পারলাম। এ তো সেই রেস্টুরেন্টের মালিক! আমি এসেই তাঁর রেস্টুরেন্টের খোঁজ করেছি শুনে হাসি দিয়ে বললেন, 'চলো, তোমাকে আমার রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাই।'

সঙ্গী সাংবাদিক, ইএসক্রিকইনফোর মোহাম্মদ ইসামকে নিয়ে তাঁর গাড়িতে করেই সেই রেস্টুরেন্টে। যেতে যেতেই আগের রেস্টুরেন্ট বাদ দিয়ে দুই রাস্তা পরেই আরও বড় একটা রেস্টুরেন্ট করেছেন তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে। পরের কয়দিন সেই রেস্টুরেন্টেই খাওয়া-দাওয়া। কখনো কখনো আমাদের যেতে দেরি হয়ে গেলে বন্ধ করে দেওয়া কিচেন খুলেও। বাংলাদেশের আগের ট্যুরগুলোতে ক্রিকেটারদের সঙ্গে তোলা ছবি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। আমাদের সেসব দেখাতে দেখাতে বললেন রমেশ চাঁদ ও তাঁর স্ত্রী মাধু দুজনই সমস্বরে বললেন, 'আরও অনেক দেশের ক্রিকেটাররাই আমাদের রেস্টুরেন্টে এসেছে। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মতো এত ভদ্র-বিনয়ী আর কেউ নয়।'

হ্যামিল্টনে নিজেদের রেস্টুরেন্টে রমেশ চাঁদ ও মাধু দম্পতি। ছবি: মোহাম্মদ ইসাম

এমন কথা শুনলে কে না খুশি হবে! আমরাও খুশি হলাম। ছবি-টবিও তুললাম। হাতে কার্ড ধরিয়ে দিয়ে রমেশ আর মাধুর একটাই অনুরোধ, বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের যেন আমরা রেস্টুরেন্টের নতুন ঠিকানাটা দিই।   

এই লেখার যে প্রচ্ছদ ছবিটা, এর সঙ্গে এসব কথার সম্পর্ক কী, এটাই ভাবছেন তো! সম্পর্ক হলো, এই ছবিটাও হ্যামিল্টনে তোলা। ইচ্ছা করেই ক্যাপশন দিইনি। ক্যাপশন কি লাগত? লাগতেই পারে। আমাকে ছাড়া বাকি তিনজনকে হয়তো চিনতেই পারছেন না। একটা ক্লু দিয়ে দিই। তিনজনই বাংলাদেশের ক্রিকেটার। আহা, বিরক্ত হচ্ছেন কেন? হাস্যরসই তো এই শ্বাসরোধী সময়ের সবচেয়ে বড় অ্যান্টিডোটের নাম।  

এই ছবিটা ২০১৫ বিশ্বকাপের সময়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের শেষ গ্রুপ ম্যাচের আগের রাতেই সম্ভবত। রমেশ চাঁদ আর মাধুর আগের যে ছোট্ট ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের কথা বলেছি, সেটির সামনে অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর কী ভেবে যেন আমিই কাকে যেন মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, 'আমাদের একটা ছবি তুলে দেন তো।' একটা না, ছবি বেশ কয়েকটাই তোলা হয়েছিল। এখানে শুধু একটাই দিলাম। এই আড্ডায় মাশরাফি বিন মুর্তজাও ছিলেন। চেয়ারে বসে ছিলেন বলে তাঁর মুখটা একটু অস্পষ্ট হয়ে গেছে, এ কারণে কেটে দিয়েছি। মাশরাফি কোনো আড্ডায় থাকলে যা হয়, তিনিই হয়ে থাকেন মধ্যমণি। এখানেও তা-ই ছিলেন। তবে ছেলেমানুষী দুষ্টুমিতে মাশরাফি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও নাসিরও কিন্তু খুব কম যান না। আহা, নাসির!

সব ছবিতেই গল্প থাকে, কখনো কখনো দীর্ঘশ্বাসও। এখানে সেই দীর্ঘশ্বাসের নাম নাসির হোসেন! কী একটা প্লেয়ার! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম দিন থেকেই কী স্বচ্ছন্দ! 'চাপ' বলে শব্দটাই যেন তাঁর অভিধানে ছিল না। চাপের কথা ওঠায় ফারুক আহমেদের একটা কথা মনে পড়ে গেল। বিপিএলে নাসির সেবার রংপুর রাইডার্সে, ফারুক সেই দলের উপদেষ্টা জাতীয় কিছু। একদিন এক আড্ডায় নাসির প্রসঙ্গ ওঠায় তাঁর কণ্ঠে মুগ্ধতামিশ্রিত বিস্ময়, 'কী প্লেয়ার রে বাবা! নার্ভাসনেস বলতে কিচ্ছু নেই। আমি জীবনে এমন প্লেয়ার দেখিনি।' বাংলাদেশের একাধিক ক্রিকেটারের মুখে তো তখন এমন বিশ্বাসের কথাও শুনেছি, একদিন বাংলাদেশের ব্যাটিং রেকর্ড সব নাসিরের হবে। ছবিটাতে নাসিরকে দেখে এ সব মনে পড়ছে আর তা অনূদিত হচ্ছে দীর্ঘশ্বাসে----কোথায় হারাল সেই নাসির! 

'পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ'---এই প্রশ্ন করার কোনো প্রয়োজনই নেই। পথ তো নাসির হারিয়েছেনই, কীভাবে, প্রশ্ন হতে পারে শুধু এটাই। খেলার চেয়ে 'ধুলা'র দিকে মন বেশি চলে যাওয়াতেই কি? 

কে জানে! কিছু প্রশ্ন আছে, যেসবের খুব জনপ্রিয় উত্তর থাকে। কিন্তু সেটাই সঠিক উত্তর কি না কে বলতে পারে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×