`গর্জে উঠো SHAKIB `
খেলা নিয়ে খেলার বাইরে
উৎপল শুভ্র
১৪ জুলাই ২০২১
দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ করে ঠিকই গর্জে উঠেছিলেন সাকিব। মুশফিকের সঙ্গে মিলে আফগানিস্তানের সঙ্গে উদ্ধারও করেছিলেন বাংলাদেশকে। কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমের সামনে তাঁর মুখে তখন তালা। যা অনেক চেষ্টা করেও খোলা গেল না। সব প্রশ্নের একটাই উত্তর। শুধুই হাসি।
বাংলাদেশের জন্য ২০১৫ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটাই সবচেয়ে সহজ ছিল, সবচেয়ে কঠিনও। সহজ, কারণ প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান। গ্রুপে স্কটল্যান্ড থাকলেও সেই ম্যাচটা প্রতিপক্ষের মাঠে। আফগানিস্তানই তাই সবচেয়ে 'সহজ'।
আবার সবচেয়ে কঠিনও, কারণ এই আফগানিস্তানের কাছে সর্বশেষ ওয়ানডেতে হেরেছে বাংলাদেশ, তাও আবার নিজেদের মাঠে। সেই দুঃস্মৃতির সঙ্গে শুরুর নার্ভাসনেস। শুরুতেই হোঁচট খেলে ২০০৩ বিশ্বকাপ ফিরে আসার ভয়!
ক্যানবেরার জয়ে তাই আনন্দের বেশি মিশে ছিল স্বস্তি। বিশ্বকাপের জন্য তৈরি মানুকা ওভালের অস্থায়ী প্রেসবক্সে উঠতে-নামতে বেশ কসরত করতে হয়। ম্যাচশেষে তাই ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্ততি নিয়েই নেমে গেছি প্রেসবক্স থেকে। সংবাদ সম্মেলন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার পথে দেখি, পড়ে আছে এই প্ল্যাকার্ডটা। যাতে লেখা, গর্জে উঠো SHAKIB...কাজ শেষ, কোনো দর্শক আর সেটি বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাননি। ফেলে গেছেন বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথে। ছবিটা কেন তুলেছিলাম, এটা আর এখন ঠিক মনে পড়ে না। যে রাস্তা দিয়ে বেরোচ্ছিলাম, তা বড়জোর চার/পাঁচ হাত চওড়া। ডানপাশে স্টেডিয়ামের দেয়াল। বাঁয়ে ওই সবুজ দেয়ালের মতো বানিয়ে ফেলে এমন কী একটা গাছ আছে না, সেই গাছ। ওই গাছের নামটা ঠিক জানি না। গুগল করলেই জানা যায়। থাক্, এই গল্পে গাছের নামটা এমন জরুরি কিছু নয়।
সরু ওই রাস্তায় প্ল্যাকার্ডটাকে অমন নিঃসঙ্গ পড়ে থাকতে দেখে কিছু একটা মনে হয়েছিল বলেই তো ছবিটা তুলেছিলাম। একদিন এ নিয়ে কিছু লিখব, এমন চিন্তা থেকে নিশ্চয়ই নয়। তবে লিখতে লিখতেই প্ল্যাকার্ডের ছবি তোলার সম্ভাব্য একটা কারণ খুঁজে পাচ্ছি। গর্জে ওঠার এই আহ্বানে ভালোই সাড়া দিয়েছিলেন সাকিব। ৫৬ বলে ৭১ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফিটা মুশফিকুর রহিমের হাতে উঠলেও অনায়াসেই তা পেতে পারতেন সাকিবও। ৫১ বলে ৬৩ রানের ইনিংসের পর বোলিংয়ে ২ উইকেট। বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে চার হাজারের মাইলফলকও ছুঁয়েছিলেন ওই ইনিংসেই। সাকিব ব্যর্থ হলে এই প্ল্যাকার্ডের ছবিটা তুলতাম বলে মনে হয় না।
২০১৫ বিশ্বকাপে আরেকটি নিষেধাজ্ঞা কাটিয়েই প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল সাকিবের। এর আগে-পরে সাকিব আরও নানা কারণে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন। তবে সেবার তাঁকে ছয় মাস কেন নিষিদ্ধ করেছিল ক্রিকেট বোর্ড, সেই কারণটা এখনো রহস্যাবৃত। ক্রিকেটে নানা কারণে নিষিদ্ধ হয়েছেন ক্রিকেটাররা, কিন্তু 'অ্যাটিটিউড সমস্যা'র কারণে নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বোধ হয় এই একটাই (কেভিন পিটারসেনকে চাইলে অবশ্য এই দলে রাখতে পারেন)। 'অ্যাটিটিউড'-কে নিষেধাজ্ঞার কারণ বলছি, সেটাও তো অনুমান থেকে। বোর্ড থেকে সুনির্দিষ্টভাবে তা বলা হয়েছিল বলে মনে পড়ছে না। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না দেখিয়েই কাউকে ছয় মাস মাঠের বাইরে ঠেলে দেওয়ার ওই ঘটনাও বোধ হয় সাকিবের বর্ণিল ক্যারিয়ারের আরেকটি রেকর্ড।
নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর সাকিবের মুখে কুলুপ। কুশল বিনিময় হচ্ছে, টুকটাক আড্ডাও, কিন্তু ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কোনো প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ উঠলেই শুধু হাসিতেই সেরে দিচ্ছেন উত্তর। আফগানিস্তান ম্যাচের পর ভাবলাম, এবার হয়তো একটু ব্যতিক্রম হবে।
এসব পুরনো কথা মনে পড়ছে, আর্কাইভে দ্বিতীয় ছবিটা পেয়ে যাওয়ায়। ফিরে এসে এমন পারফরম্যান্স, বাংলাদেশের পক্ষে দ্র্রুততম চার হাজার রান...সাকিবের প্রতিক্রিয়াটা অনুমান করতেই পারেন। আমাকেই শুধু্ অনুমানই করতে হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর সাকিবের মুখে কুলুপ। কুশল বিনিময় হচ্ছে, টুকটাক আড্ডাও, কিন্তু ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কোনো প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ উঠলেই শুধু হাসিতেই সেরে দিচ্ছেন উত্তর। আফগানিস্তান ম্যাচের পর ভাবলাম, এবার হয়তো একটু ব্যতিক্রম হবে। এটা তো বিতর্কিত কিছু নয়, নির্দোষ আনন্দাভুনূতি। সাকিবকে পেলেই হয়। মাঠ থেকে তড়িঘড়ি করে হোটেলে ফেরাও এ কারণেই। প্লেয়াররা রুমে ঢুকে গেলে সাকিবকে পাওয়া মুশকিল হবে। আগেই তাঁকে ধরতে হবে। ধরলামও।
ক্যানবেরার গ্র্যান্ড হায়াত রিজেন্সি হোটেলটা মনে হয় পুরনো দিনের কোনো প্রাসাদের রূপান্তরিত রূপ। বাইরে থেকে দেখতে প্রাসাদের মতোই লাগে। প্রথাগত হোটেলের মতো টানা রুম নেই, সিঁড়ি দিয়ে উঠে-নেমে বিভিন্ন ধাপে কয়েকটি করে রুম। বড় একটা বেসমেন্টও আছে।সাকিবকে পেয়েছিলাম সেখানেই। সঙ্গে আরও কয়েকজন---নাসির, রুবেল, এনামুল, আল আমিন। কিন্তু সাকিব কিছু বলবেন না তো বলবেনই না। যা-ই জিজ্ঞেস করি, উত্তর অপরিবর্তিত।শুধুই হাসি।
এক সময় একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, 'আরে ভাই, কী বলবেন, তা তো জানিই। "বিশ্বকাপের শুরুটা ভালো করা দরকার ছিল, তা হওয়ায় আমি খুব খুশি। দলের জয়ে অবদান রাখতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে"--এমন কিছুই তো!'
মুখের হাসি আরেকটু বিস্তৃত করে সাকিব বললেন, 'তা হলে জানেনই। সেটাই লিখে দেন।'
'জানি, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার মুখে তা না শুনে লিখে দিলে তো আর সাংবাদিকতা হলো না। আপনি মুখে তালা দিয়েছেন কেন, এটাই বুঝতে পারছি না। দলের সবাই তো কথা বলছে।'
সাকিবের এবারের হাসিটাতে একটু বিষন্নতার ছোঁয়া, 'সবাই বললে সমস্যা নাই। সাকিব আল হাসান কিছু বললেই সমস্যা।'
নাসির ততক্ষণে স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি করতে শুরু করেছেন। সাকিবের হয়ে উত্তর দেওয়ার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করুন, আমি বলে দিচ্ছি। ৪ হাজার রান কোনো ব্যাপার! ও তো ১৫ হাজার রান করবে।' 'একটু বেশি হয়ে গেল না?' বলে আপত্তি করলেন সাকিব। মাথা নেড়ে সায় দিলেন বাকিরাও। নাসির তাই সংশোধনী দিলেন, ‘আমরা যেহেতু কম ম্যাচ খেলি, রানটা ৮-১০ হাজার করে দিন।’ সবাই একমত হলেন এবং হাসির ফোয়ারা ছুটল।
সাকিবকে আর পীড়াপীড়ি করা ঠিক হবে না সিদ্ধান্ত নিয়ে বললাম, 'ঠিক আছে, আপনি যখন কথা বলবেনই না, সেটিই লিখব। আসেন, সবাই মিলে একটা ছবি তুলি। এতে তো আর কোনো সমস্যা নেই, না কি?'
না, সমস্যা নেই। সাকিব হাসিমুখেই ছবির জন্য পোজ দিলেন। তবে ছবিটা একদমই ভালো হয়নি। রুবেল, আল আমিন আর আমি কোনো ছবিতে থাকলে সেই ছবিতে একটু আলোকস্বল্পতা দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে এই ছবিটার এমন কবীর সুমনের গান (এই যে দেখছি আবছায়াটাই লাগছে ভালো) হয়ে যাওয়ায় আমাদের যে কোনো দায় নেই, নাসির আর সাকিবকে দেখলেই তা বুঝতে পারবেন! বেসমেন্টের ওই মৃদু আলোতে ছবি এমনই হওয়ার কথা। তাও ভালো, সাদা টি শার্ট পরেছিলাম। ছবিটা যে কারণে অন্তত 'ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট' হতে পেরেছে!
ছবিটা যতবার দেখি, আমার অবশ্য খুবই ভালো লাগছে। শুধু্ই একটা ছবি তো নয়, এটা যে একটা গল্প বলছে।