খেলা নিয়ে খেলার বাইরে
মাশরাফি-তামিমদের সাথে অন্যরকম এক নাস্তা
উৎপল শুভ্র
১৪ জুলাই ২০২১
সারা রাত আড্ডার পর ভোরবেলায় এসে হঠাৎ মাশরাফির মাথায় ভুত চাপল, `চলেন, নাস্তা করে ঘুমাই।` সেই নাস্তাও টিম হোটেলে হলে হবে না, হতে হবে খুলনার রাস্তার পাশে সাধারণ কোনো হোটেলে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কিছু সমস্যা হলো। কিন্তু মাশরাফি কি আর তাতে দমবার পাত্র! মাশরাফি-তামিম-তাসকিন-সোহানদের সঙ্গে অন্যরকম সেই নাস্তার গল্প।
সারা রাতের আড্ডায় ভোর নেমে আসার পর যখন হাই তুলতে শুরু করেছি, হঠাৎই মাশরাফির মাথায় ভুত চাপল। 'চলেন, নাস্তা করে তারপর ঘুমাই।'
ভালো প্রস্তাব। আমার পেট অনেকক্ষণই খিদেয় চোঁ চোঁ করছে। নাস্তা করে ঘুমানোই ভালো, তাতে ঘুমটাও ভালো হবে। যখন ইচ্ছা উঠলেই হবে। বাংলাদেশ দলের যেমন, তেমনি আমারও এ দিন কোনো কাজ নেই। কিন্তু বাজে তো মাত্র ৫টা । সিটি ইন হোটেলের ব্যুফে ব্রেকফাস্ট তো ৭টার আগে রেডি হবে না। আরও এতক্ষণ জেগে থাকব? না, সম্ভব নয়।
মাশরাফিকে তাই বললাম, 'আমি আর পারব না। তুমি নাস্তা করে ঘুমাও। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।'
আড্ডাটা হচ্ছিল তামিমের রুমে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষ হয়েছে সে দিনই। যে সিরিজটি ছিল ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি। সেই 'প্রস্তুতি' কথাটাকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। প্রথম দুই ম্যাচে জেতার পর একাদশ নিয়ে এমনই এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করলেন যে, পরের দুই ম্যাচে হেরে সিরিজ ড্র! জিম্বাবুয়ের জন্য যা জয়েরই নামান্তর। আমরা অবশ্য সেই সিরিজ নিয়ে বেশি কথা বলিনি। মাশরাফি আর তামিম থাকলে কথা বলার বিষয়ের অভাব পড়ে নাকি!
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ প্রস্তুতির অংশ হিসাবে বাংলাদেশ দল আরও কদিন খুলনাতেই থাকবে। বাড়তি কিছু করার ইচ্ছা থেকে আমিও সিরিজ শেষে বাড়তি একদিন থেকে যাচ্ছি।
মাশরাফি-সাকিব-তামিমদের একই ফ্লোরে আমার রুম। প্রথম দিন থেকেই দেখছি, সময় কাটাতে ক্রিকেটাররা একটা ক্যারম বোর্ড জোগাড় করে নিয়েছে। সিরিজ শেষ হওয়ার রাতেও খেলা চলছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। খেলা-টেলা শেষ হওয়ার পর মাশরাফি বা তামিমের কেউ একজন বললেন, 'কাল তো অফ ডে। এত তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কী দরকার! চলেন, গল্প করি।'
মাশরাফি আর তামিমের সঙ্গে গল্প করলে সময় পাখির ডানায় উড়ে চলে যায়। গল্পে গল্পে ভোর হয়ে যাওয়াটা তাই মোটেই ব্যতিক্রমী কিছু নয়। ব্যতিক্রমী বললে সেই ভোরের নাস্তাটা। সিটি ইনের ব্রেকফাস্টের জন্য অপেক্ষা করার ইচ্ছা নেই শুনেই মাশরাফি বলল, 'এখানে কে নাস্তা করবে? চলেন, বাইরে যাই। আজ রাস্তার পাশের কোনো দোকানে নাস্তা করব।' বড়লোকি নিয়ে তামিমের সঙ্গে মাশরাফির নিত্যই খুনসুটি চলে।
যথারীতি এখানেও তা থাকল। তামিমের দিকে তাকিয়ে একটা ফিচকে হাসি দিয়ে মাশরাফি বলল, 'তামিমের অবশ্য রাস্তার পাশের দোকানে নাস্তা করলে পেট খারাপ হতে পারে।' এতে লাভ যেটা হলো, সাধারণ কোনো হোটেলে নাস্তা করায় মাশরাফির চেয়ে তামিমই বেশি উৎসাহ দেখাতে শুরু করলেন। কিন্তু শুধু তিনজনে কি আর মাশরাফির হয়!
খুব দ্রুতই আরও দুজন জোগাড় হয়ে গেল। মাশরাফির ফোনে তাসকিনের ঘুম ভাঙল। মুখে লালচে আভা আর চোখে ঘুম নিয়ে তাসকিন চলে এলেন কয়েক মিনিটের মধ্যেই। এবার মাশরাফির মনে হলো, একটু 'লোকাল নলেজ'-এর প্রয়োজন আছে। সেই প্রয়োজন মেটাতে ঘুম থেকে উঠতে হলো নুরুল হাসান সোহানকেও। সোহানের 'অপরাধ', তিনি খুলনার ছেলে। কোথায় ভালো নাস্তা পাওয়া যাবে, এটি তাঁর জানা আছে। সোহানও চলে এলেন তামিমের রুমে।
সমস্যাটা হলো নিচে নামার পর। গাড়ি একটা প্রস্তুতই আছে। ঠিক মনে নেই, সম্ভবত সোহানেরই গাড়ি ছিল ওটা। কিন্তু এমন মহতী একটা কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন হোটেলের সামনে প্রহরারত দুই-তিনজন পুলিশ। দেশের পরিস্থিতি তখন ভালো নয়, এসকর্ট পুলিশ জিপ ছাড়া কোথাও যাওয়া যাবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন তাঁরা। মাশরাফির পীড়াপীড়িতেও অভাবনীয় মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে অনড় থাকলেন নিজেদের অবস্থানে। ঠিক আছে, তাহলে পুলিশের গাড়িও থাকুক সঙ্গে, সমস্যা কী! সমস্যা হলো, সেই গাড়ি চালাবেন কে? সঙ্গেই বা আর কারা যাবেন? এঁদের তো হোটেলের সামনেই ডিউটি। এত ভোরে আর কোনো পুলিশ তো এখানে নেই।
খোঁজ-খোঁজ-খোঁজ...ওয়্যারলেস-মোবাইলে খোঁজ করে শেষ পর্যন্ত সেই মুহূর্তে চরম আকাঙ্ক্ষিত পুলিশের সন্ধান পাওয়া গেল। শুরু হলো ঐতিহাসিক এক নাস্তার সন্ধানে আমাদের যাত্রা। লোকাল গাইড সোহানই পথ নির্দেশ করে নিয়ে গেলেন রাস্তার পাশের ছোট্ট একটা ছাপড়া হোটেলে। হোটেলের লোকজন তো আমাকে ছাড়া বাকি সবাইকে দেখে বিস্মিত-চমকিত-আনন্দিত, একটু উচ্ছ্বসিতও। একটু বোধ হয় অবিশ্বাসও দেখলাম তাঁদের চোখে।
রাস্তায় তখনো সেভাবে লোকজন চলাচল শুরু হয়নি। তারপরও খুব দ্রুতই হোটেলের সামনে ছয়/সাতজনের একটা জটলামতো দাঁড়িয়ে গেল। আমি গম্ভীর মুখে বললাম, 'বেশি দেরি করলে বিপদ হবে। আপনারা বেরোতে পারলেও আমি আর পারব না। জনতা আমাকে ঘিরে ধরবে।' মাশরাফি-তামিম আবার রসিকতার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু তাসকিন আর সোহানের মুখ দেখে মনে হলো, কথাটা তাঁরা সিরিয়াসলিই নিয়েছেন। রসিকতা করার পর সেটি বুঝিয়ে বলার মতো বিড়ম্বনা আর নেই। বাধ্য হয়ে আমাকে সেটিই করতে হলো।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই হোটেলে ফিরতে পেরেছিলাম। স্মৃতি হয়ে থাকল শুধু এই ছবিটা।
নাস্তা করতে করতে সোহানই বোধ হয় বলেছিলেন, এই 'ঐতিহাসিক' নাস্তার একটা ছবি তুলে রাখা উচিত। সেলফির এই যুগে ছবি তোলার জন্য কারও দ্বারস্থ হওয়ার দরকার কি! সেলফি তোলার দায়িত্বটাও অধিনায়কই নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। মানে মাশরাফি আর কি!
সোহান তাঁর ফেসবুকে ছবিটা পোস্ট করতে না করতেই সেটি ভাইরাল। আমিই সেটি হারিয়ে ফেলেছিলাম। পুরনো ছবি ঘাঁটতে গিয়ে তা পেয়ে যাওয়ার পর মনটা ফিরে গেল ব্যতিক্রমী নাস্তায় শেষ হওয়া খুলনার সেই রাতে। ভাবলাম, এটাকে ব্যক্তিগত গল্প করে রাখার বদলে সবার সঙ্গে শেয়ার করাই যায়।