ব্লাডি পয়েন্ট, ব্লাডি রিভার

ক্যারিবীয় কড়চা

উৎপল শুভ্র

১৪ জুন ২০২১

ব্লাডি পয়েন্ট, ব্লাডি রিভার

ক্যারাবিয়ানেও যে সেন্ট মার্টিন আছে, এটা কি জানেন? সেই সেন্ট মার্টিনও একটা না, দুইটা। ইংরেজিতে একটু ভিন্ন বানানে আলাদা করা দুই সেন্ট মার্টিনের একটি ফ্রান্সের উপনিবেশ, অন্যটি নেদারল্যান্ডসের। এই কড়চা অবশ্য এ নিয়ে নয়। এটা সেন্ট কিটসের গল্প। যেখানে অন্য সব দ্বীপের মতো দূর্গ আছে, অনন্য হয়ে আছে সাগরতীরে মাথা তুলে দাঁড়ানো কালো পাথরের শৃঙ্গ আর ক্যারিবীয় আদিবাসী কারিবদের রক্তে লাল হয়ে যাওয়া নদীর এক করুণ ইতিহাস।

সেন্ট কিটসের লোকদের কী বলে জানেন? কিটিশিয়ান! তা বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত কিটিশিয়ান কে? স্বীকৃতিটা পাবেন কিম কলিন্স। ২০০৩ সালে অ্যাথলেটিকসের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট জেতার পর যিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, ট্রেনিং-ফ্রেনিং তাঁর একদম ভালো লাগে না। নিজেকে তিনি মনে করেন, বিশ্বের অলসতম স্প্রিন্টার। এই স্বীকারোক্তির জন্য কলিন্সের ধন্যবাদ প্রাপ্য। অলস না হলে আর ক্যারাবিয়ান কিসের!

সেন্ট কিটসে এলাম আর কিম কলিন্সের সঙ্গে দেখা করব না! দেখা হলোও। তবে কলিন্সের সঙ্গে নয়, কিম কলিন্স হাইওয়ের সঙ্গে। সেন্ট কিটসের রাজধানী বাসেতেরের একটা রাস্তা কলিন্সের নামে। গত পরশু সেটি দেখার পরই আসলে কলিন্সের কথা মনে পড়ল। খোঁজখবর করে জানলাম, তিনি নাকি এখন এখানে নেই।

ক্যারিবিয়ানের সম্ভবত সেন্ট কিটসেই শুধু রেলগাড়ি আছে। তবে সেটি সাধারণ যাত্রীবাহী রেলগাড়ি নয়। পর্যটকদের দ্বীপ ঘুরিয়ে টাকাপয়সা কামানোর জন্য বিশেষ ট্রেন। নাম সুগার ট্রেন। তিন ঘণ্টা-সাড়ে তিন ঘণ্টায় পুরো দ্বীপ চক্রাকারে ঘুরে আসার বিনিময়মূল্য মাত্র ৮৯ ডলার।

ডলারটা যে মার্কিন, সেটি কি জানানো প্রয়োজন? সেন্ট কিটসে দু-এক দিন থাকলে অবশ্য আর তা মনে হয় না। ক্যারিবিয়ানের বড় সব দেশ-জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ, বারবাডোজ, গায়ানার নিজস্ব মুদ্রা আছে। সবই ডলার-তবে জ্যামাই কান ডলার, বারবাডোজ ডলার এমন আর কী! অ্যান্টিগা, সেন্ট ভিনসেন্ট, গ্রেনেডা, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট কিটস এমন আরও কিছু ছোট দ্বীপ মিলে যে ইস্ট ক্যারিবিয়ান ফেডারেশন, সেগুলোর অভিন্ন মুদ্রা-ইস্ট ক্যারিবিয়ান ডলার। পর্যটকদের দেশ বলে সব জায়গাতেই মার্কিন ডলার চলে। তবে সেন্ট কিটসের মতো আর কোথাও এর এতটা প্রতিপত্তি দেখিনি। ট্যাকিবস ড্রাইভার মার্কিন ডলারে ভাড়া বলে, হোটেলের বিলও আসে মার্কিন ডলারেই।

সুগার ট্রেনটায় ঘোরার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সেটি সকাল সাড়ে নয়টায় । তখন তো লেখাই শেষ হয় না। পরশু যিনি খোজখবর করে ট্রেনের সময়সূচি জানালেন, সেই কামরুজ্জামান চৌধুরীই দিলেন বিকল্প প্রস্তাব। ট্রেন যখন হলো না, তিনি নিজেই গাড়িতে করে 'আইল্যান্ড ট্যুর'-এর ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত। ডমিনিকায় এক বাঙালির দেখা পেয়ে অবাক হয়েছিলাম। সেন্ট কিটসে হলাম আরও বেশি। ডমিনিকার বাঙালি ভদ্রলোকই যে জানিয়েছিলেন, সেন্ট কিটসে বাংলাদেশের কেউ নেই। অথচ কামরুজ্জামান চৌধুরী অনলাইনে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে দশ বছর ধরে সেন্ট কিটসে আছেন। দুই বছর পর নিয়ে এসেছেন ভাই আমিনুল আলমকেও।

সাগরতীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কালো পাথর শৃঙ্গ। কী যে সুন্দর! ছবি: সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস গাইড

এই দুই ভাইয়ের সৌজন্যে সেন্ট কিটসটা মোটামুটি দেখা হয়ে গেল। ক্যারিবিয়ানের কোনো দ্বীপই হুবহু আরেকটা দ্বীপের মতো নয়। তবে মূল ব্যাপারে তো সেই একই-সেই সাগর, সেই পাহাড়, সেই উপকূল ঘিরে রাস্তা। সেন্ট কিটসে নতুন যেটি দেখলাম, তা হলো 'ব্ল্যাক রক'। সাগরপাড়ে কালো সব শৃঙ্গ। দেখতে মাটির মতো লাগে। আসলে শক্ত পাথর। হাজার বছর আগে মাউন্ট লিয়ামুইগা থেকে অগ্ন্যুৎপাতে নির্গত লাভা সাগরের ঠান্ডা পানির স্পর্শে অমন জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে। নীল সাগরের পটভূমিতে ওই লম্বা লম্বা কালো পাথর–দৃশ্যটা অপূর্ব ।

ব্রিমস্টোন হিল ফোর্টেস দেখার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। সব দ্বীপেই এমন দুর্গ দেখেছি। সেই একই ইতিহাস-দ্বীপের দখল নিয়ে মূলত ইংরেজ আর ফরাসিদের মারামারি। কখনো বা যুক্ত স্প্যানিয়ার্ড বা ডাচরাও। ব্রিমস্টোন হিলে গিয়ে অবশ্য মনে হলো, এটা না দেখলে দুর্গ-দর্শন অপূর্ণ থেকে যেত। কারণটা সেন্ট কিটসের তিন-চার শতাব্দীর ইতিহাস মূর্ত করে তোলা জাদুঘর। এমন সাজানো-গোছানো যে, চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে আশ্চর্য সেসব দিনের প্রতিচ্ছবি। দুর্গে সৈন্যরা কীভাবে দিন কাটাত, তাদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা কী ছিল, সেসবের প্রায় প্রামাণ্য উপস্থাপনটা অসাধারণ! ইংরেজ সৈন্যদের মূর্তিগুলোর সামনে গিয়ে মনে হলো, ব্রিমস্টোন হিলের বদলে মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে দাঁড়িয়ে আছি। এমনই জীবন্ত!

ব্রিমস্টোন হিল দূর্গে সাগরমুখী কামানগুলো কি দেথতে পাচ্ছেন?। ছবি: উইকিপিডিয়া

ব্রিমস্টোন হিল ফোর্টেসকে বলা হয় 'জিব্রাল্টার অব ক্যারাবিয়ান', ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদাও পেয়েছে এটি। দুর্গের ওপর বসানো সাগরমুখী কামানের পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম দূরে দুটি দ্বীপ–সেন্ট ইউস্টেটিয়াস আর শেবা। প্রথমটিতে হাজার আড়াই লোকের বাস, দ্বিতীয়টিতে মাত্র বারো শ। দুটিই ডাচ অ্যান্টিলিসের অংশ। ইংরেজিভাষী ক্যারাবিয়ান দ্বীপগুলোই শুধু ক্রিকেট খেলে বলে আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলতে মূলত ওসবই বুঝি। তবে ইংরেজদের সঙ্গে পেরে না উঠেও ক্যারাবিয়ানের খুচখাচ কিছু দ্বীপ ঠিকই দখলে নিয়েছিল ফরাসি-ডাচ বা স্প্যানিয়ার্ডরা। ফরাসিদের রাজত্ব তো এখনো আছে। গুয়াডেলোপ-মার্টিনিক নামের দুটি দ্বীপ যেমন এখনো ফ্রান্সেরই অংশ। সেন্ট মার্টিন (হ্যাঁ, এখানেও একটা সেন্ট মার্টিন আছে) নামে দ্বীপটির মাঝখানে আবার দুই ভাগ। একটি অংশ ফ্রান্সের, আরেকটি নেদারল্যান্ডসের। পার্থক্য বোঝাতে একটির নাম St. Martin, অন্যটির St. Marteen. ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে উড়ে যাওয়ার সময় ফ্রান্সের সেন্ট মার্টিনে বিমান যাত্রা বিরতি করেছিল বলেই যা জানতে পেরেছি। 

দুই সেন্ট মার্টিনের ঘটনাটা তো জানলাম ইন্টারনেটে। ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্য বিতরণ বাদ দিয়ে সেস্ট কিটসে নিজে কী দেখলাম, সেটাই বরং লিখি। ডমিনিকা থেকে কারিবদের নিয়ে যখন লিখেছি, ব্লাডি পয়েন্টের কথাটা অবশ্যই আপনাদের জানানো উচিত। নাম থেকেই বুঝে নেওয়ার কথা, এখানে রক্তারক্তির একটা ব্যাপার আছে। আসলেই তাই। শহর থেকে একটু বাইরেই ওই জায়গাটা। ১৬২৬ সালে যেখানে ফরাসিরা দুই হাজার কারিবকে হত্যা করে দ্বীপ থেকে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। তিন দিন ধরে নাকি রক্ত গড়িয়ে পড়েছে পাশের নদীতে। নদীর নামও তাই ব্লাডি রিভার। রাস্তার পাশে একটা সাইনবোর্ডে উৎকীর্ণ সেই রক্তাক্ত ইতিহাস। জানা থাকার পরও জায়গাটায় গিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

ক্যারাবিয়ানের আদিবাসী কারিবদের রক্তে ভেজা `ব্লাডি পয়েন্ট`-এর ইতিহাসটাও লেখা আছে এখানে। ছবি:উইকিপিডিয়া

সেই মন ভালো হলো প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি দেখে। ভাবছেন, না জানি কী প্রাসাদোপম কিছু! আসলে উল্টো। সেন্ট কিটসের একটা পতাকা উড়ছে, আশপাশে অন্য সব বাড়ির সঙ্গে এ ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই। বাড়িটাও প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব। এখানে প্রধানমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ বলতে শুধু একটা গাড়ি, আর একজন দেহরক্ষী। কামরুজ্জামান চৌধুরী জানালেন, প্রধানমন্ত্রী আর গভর্নর জেনারেলই শুধু এখানে গাড়ি পান। মন্ত্রী-টন্ত্রীদের তা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বাংলাদেশের মন্ত্রীদের গাড়ির বহরের কথা শুনলে ওরা নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ করবে।

 ১ আগস্ট, সেন্ট কিটস।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×