ভুল করে নেভিসে!

ক্যারিবীয় কড়চা

উৎপল শুভ্র

১০ জুন ২০২১

ভুল করে নেভিসে!

ডমিনিকা থেকে সেন্ট কিটসের বিমানে উঠেছি। নির্ঘুম রাত ও পেটে ক্ষুধা মিলিয়ে চোখ জড়িয়ে এসেছে ঘুমে। প্লেন নামার পর হন্তদন্ত হয়ে নেমে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম, এটা সেন্ট কিটস নয়। আমি আসলে নেভিসে নেমে গেছি। প্লেন ততক্ষণে উড়ে গেছে সেন্ট কিটসের দিকে। নেভিস থেকে জাহাজে করে সেন্ট কিটসে যাওয়ার রোমাঞ্চকর সেই গল্প।

ডমিনিকা থেকে পরশু যে সেন্ট কিটসে পৌছাতে পারলাম, সে জন্য নিজেকে মহা ভাগ্যবান মনে হচ্ছে!

এই দেখুন, আপনি ভাবছেন আবার বোধ হয় লিয়াট-বিভ্রাটের কোনো গল্প ফেঁদে বসতে যাচ্ছি। না ভাই, এখানে লিয়াটের কোনো দোষ নেই 1 অবাক করে দিয়ে ডমিনিকা থেকে ঠিক সময়েই লিয়াটের ফ্লাইট ছেড়েছে। অ্যান্টিগা থেকে সেন্ট কিটসের ফ্লাইটটাও একেবারে অন টাইম!

এখানে যা হয়েছে, তার পুরো দায়িত্বই আমার । সেই দায়িত্ব স্বীকারের মধ্যে একটু লজ্জা-লজ্জা ভাবও মিশে থাকছে। ঘটনাটা শুরু থেকে না বললে সেই লজ্জার ভাবটা কাটবে না।

ডমিনিকার হোটেল থেকে দেড় ঘণ্টার পাহাড়ি চড়াই-উতরাই এয়ারপোর্টে। সকালে বেয়ে তাড়াহুড়োয় ভালোমতো নাশতাও করা হয়নি। লিয়াটের ফ্লাইটে খাওয়াদাওয়ার কোনো বালাই নেই। সেন্ট কিটসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাই ঠিক করলাম, এয়ারপোর্টে খেয়ে-টেয়েই প্লেনে উঠব।

ডমিনিকার ছোট্ট এয়ারপোর্ট বাংলাদেশের মফস্বল শহরের রেলওয়ে স্টেশনকেও হার মানানোর মতো। কিন্তু তাই বলে চেক-ইন করে ভেতরে ঢুকে একটাও খাবারের দোকান পাব না, এটা কল্পনাও করিনি। অ্যান্টিগায় এসে একটা স্যান্ডউইচে পেটের আগুন কিছুটা নিভল । কিন্তু প্রায় সারা দিন অভুক্ত থেকে পেটের ওই শান্তি জন্ম দিল অন্য সমস্যার। টানা ভোরে ওঠার অনভ্যস্ততায় প্রতিবাদী দুচোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে। সেন্ট কিটসের ফ্লাইটে প্রায় মিনিবাসের মতো ওই সিটে বসেও তাই ঝিমুচ্ছি। লিয়াটের ছোট্ট বিমানে বিমানবালা থাকেন একজনই, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা...' তাঁর দেওয়া ঘোষণাটা আবছামতো কানে এল। যাক, সেন্ট কিটসে এসে গেছি!

বড় দ্বীপটা সেন্ট কিটস, ছোটটা নেভিস। সেন্ট কিটসের বদলে ভুল করে নেমে গিয়েছিলাম এই নেভিসেই

সেন্ট কিটসে এই প্রথম। প্লেন থেকে নেমে কৌতূহলভরে চারপাশ দেখতে দেখতে ইমিগ্রেশনের লাইনে । মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পর সামনে যখন মাত্র দু-তিনজন, হঠাৎ চোখ পড়ল দেয়ালের লেখাটায়-ওয়েলকাম টু নেভিস!

মানে কী? এটা কি সেন্ট কিটস না? সামনের যাত্রীকে জিজ্ঞেস করায় রীতিমতো অবাক-‘এটা সেন্ট কিটস হতে যাবে কেন? এটা তো নেভিস।' সর্বনাশ! পাশের ছোট্ট দ্বীপ নেভিসকে নিয়ে সেন্ট কিটস ও নেভিস নামের এই দেশ, এটা জানতাম। প্লেন নামার আগে ঘোষণায় সেন্ট কিটস-নেভিস দুটি কথাই শুনেছি। একটা দ্বীপের পাশ দিয়ে উড়ে আসার সময় আমি ভেবেছি, বিমানবালা বোধ হয় যাত্রীদের জ্ঞানদান করতে বলছেন, আমরা এখন নেভিসের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি, একটু পরই নামব সেন্ট কিটসে। এখন বুঝতে পারলাম, নিদ্রাপ্রভাবিত কানে আমি শুনেছি উল্টোটা। তা ছাড়া আমার সময়সূচিতে অ্যান্টিগা থেকে সেন্ট কিটস লেখা আছে। প্লেন যে নেভিস ছুঁয়ে যাবে, জানতামই না। যাত্রীদেরও প্রায় সবাইকেই নেমে পড়তে দেখেছি। দু-একজন যাঁরা বসে ছিলেন, ভেবেছি, প্লেনের দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা তাঁদের পছন্দ নয়। ভিড় কমলে নামবেন।

এখন কী করি? এয়ারপোর্টের লোকজন প্লেনের দিকে দৌড়ে গেল। বেশি দূর অবশ্য যেতে হলো না, সামনে দিয়ে পাখির মতো উড়ে গেল লিয়াটের বিমান। নেভিস থেকে আকাশপথে মাত্র ছয় মিনিটের দূরত্বের সেন্ট কিটসের দিকে।

কিন্তু এখন আমি কী করি! ইমিগ্রেশনের তরুণী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এখানে রাত কাটাতে হবে। ভালোই লাগবে। নেভিস খুব সুন্দর দ্বীপ।' সুন্দর! সুন্দর দিয়ে আমি কী করব? আজই সেন্ট কিটসে যাওয়ার কোনো উপায়ই কি নেই? না, আর কোনো ফ্লাইট নেই। 'বোটে যেতে পারতে, কিন্তু। শেষ বোটটা ছয়টায় ছাড়ে ছয়টা তো বাজেই' বলার পর আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে মায়া হলো বলেই কি না, কাকে যেন ফোন করলেন। ফোন রেখে বললেন, 'এখনই ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাও। একটা বোট নাকি এখনো আছে।'

ট্যাক্সি ড্রাইভার উড়ে চলল। আমি উঠতে না উঠতেই ছেড়ে দিল বোট বোট না তো, ফেরি। সেটিও যাত্রী পারাপারের নয়, গাড়ির যাত্রী বলতে কেউ গাড়ি নিয়ে এপার-ওপার করতে চাইলে শুধু তারাই। ফেরি যে পথে এল, সেখানেই নেভিস আর সেন্ট কিটস সবচেয়ে কাছাকাছি। সাগরে আড়াই মাইল। মিনিট পঁয়ত্রিশ লাগবে। স্যুটকেস সেন্ট কিটসে চলে গেছে। যাক, সেটি আনা যাবে। ওপারে গিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিলেই হবে।

ফেরিতে ছয়-সাতজনের কৃষ্ণাঙ্গ এক পরিবার। বছর পঁয়তাল্লিশের পরিবারের কর্তার সেন্ট কিটসেই জন্ম, তবে ছয় বছর থেকেই আটলান্টায় । পরিবার নিয়ে জন্মভূমিতে ছুটি কাটাতে এসেছেন। তিনিই দিলেন ভয়ংকর তথ্যটা। এটা গাড়ি পারাপারের ফেরি বলে সবচেয়ে শর্টকাট রাস্তায় যায়। ওপারে পুরো বিরানভূমি, ট্যাক্সি-ফ্যাক্সি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না এবং শহর সেখান থেকে পনেরো-বিশ মাইল। তাহলে উপায়? আমার করুণ মুখ দেখে ভদ্রলোক বললেন, “আমার গাড়িতে চলো। কষ্ট-টষ্ট করে যাওয়া যাবে।' আমার অবশ্য কোনো কষ্টই হলো না। গাড়িচালক ওই ভদ্রলোকের পাশের সিটে বসে আরামেই এলাম। কষ্ট যা হলো কিশোরী মেয়েটার, সিটের পেছনে ফাঁকা জায়গাটায় বসে আসতে হলো তাকে। 

সেন্ট কিটসে আমার যে ম্যারিয়ট হোটেলে ওঠার কথা, ওই ভদ্রলোকও (ভাই রে, আসলেই ভদ্রলোক, কী বাঁচানো যে বাঁচিয়েছেন!) সেখানেই উঠছেন। হোটেল পর্যন্ত তাই আসা গেল।  সেখানে চেক-ইন করেই এয়ারপোর্টে দৌড়ালাম স্যুটকেসের জন্য। বেলা ১১টায় ডমিনিকার হোটেল থেকে বেরিয়েছিলাম, এয়ারপোর্ট থেকে স্যুটকেস নিয়ে সেন্ট কিটসের হোটেলের রুমে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বসতে বসতে রাত নয়টা। তার পরও খুব একটা ক্লান্ত লাগল না।

অন্য কাউকে যে দোষ দেওয়ার নেই!

৩১ জুলাই ২০০৯, সেন্ট কিটস।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×