বিদায় ডমিনিকা!
উৎপল শুভ্র
৭ জুন ২০২১
ক্রিকেটপাগল ডমিনিকানরা বোধ হয় বাংলাদেশকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে। নইলে মাঠ থেকে ফেরার পথে কেন এত অভিনন্দন পাব? ট্যাক্সি ড্রাইভার পাশ দিয়ে যাচ্ছেন বলে যাচ্ছেন—ওয়েলডান, বাংলাদেশ। কনগ্রাটস্! বাংলাদেশ দল ফেরার পর হোটেলের লোকজনের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হলো, ওরা সব বাংলাদেশেরই লোক। ডমিনিকাকে বিদায় জানাতে তাই একটু মন খারাপই হয়েছিল।
—ডমিনিকায় প্রথমবার?
–কেমন লাগছে আমাদের দ্বীপ?
–আবার আসবে তো?
ডমিনিকায় আসার পরপর এই প্রশ্নগুলো শোনা অভ্যাস হয়ে গেছে। ক্যারিবিয়ানের 'ন্যাচার আইল্যান্ড' আরও বেশি পর্যটক টেনে আনার একটা তোড়জোড় শুরু করেছে। সাধারণ ডমিনিকানদেরও কি কোর্স-টোর্স করানো হয়েছে। নাকি! নইলে অজানা-অচেনা বিদেশিকে আবার ফিরে আসার জন্য এমন আকুতি জানানো কেন?
পেছনে কারণ হিসেবে এটাও থাকতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো, এখানকার লোকগুলোই আসলেই খুব আন্তরিক। ওই কথাগুলো মন থেকেই বলা। পর্যটননির্ভর যেকোনো দেশের মানুষই অতিথির প্রতি দারুণ বন্ধুভাবাপন্ন হয়। ক্যারিবিয়ানের বেশির ভাগ দ্বীপেই তাই। তবে ডমিনিকানদের হাস্যমুখ আন্তরিকতা যেন একটু বেশিই ছুঁয়ে গেল।
ক্রিকেটপাগল লোকজন বোধ হয় বাংলাদেশকে পছন্দও করে ফেলেছে। নইলে পরশু মাঠ থেকে ফেরার পথে কেন এত অভিনন্দন পাব? ট্যাক্সি ড্রাইভার পাশ দিয়ে যাচ্ছেন বলে যাচ্ছেন—ওয়েলডান, বাংলাদেশ। কনগ্রাটস্! বাংলাদেশ দল ফেরার পর হোটেলের লোকজনের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হলো, ওরা সব বাংলাদেশেরই লোক। এক তরুণী তো বাংলাদেশের জার্সি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। টানা জয় পাওয়ার কারণেই কি না, বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের দেখে সিরিজ জয়-টয়ের ব্যাপারটা বোঝাই কঠিন। নিরুত্তাপ বাংলাদেশ দলের চেয়ে ওই তরুণীর উচ্ছ্বাসটাই বরং বেশি চোখে লাগল।
উপমহাদেশের বাইরে ক্রিকেটারদের নিয়ে এত আদেখলেপনা নেই। হোটেলের লবিতে সমর্থকদের ভিড়ও শুধু ভারত-পাকিস্তান বাংলাদেশেরই বৈশিষ্ট্য। পরশু ডমিনিকার গ্যারাওয়ে হোটেল ব্যতিক্রম। সেটির মূলে অবশ্য বাংলাদেশিরাই। কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশের চার তরুণ-তরুণী রজোর অল সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়তে এসেছেন। দুই ম্যাচেই গ্যালারির একটা অংশ লাল-সবুজ করে রেখেছিলেন তাঁরা। টেলিভিশনে ইয়া বড় এক লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে যে তরুণকে সারাক্ষণ লাফালাফি করতে দেখেছেন, তাঁর নাম আরিফ। ১৩ বছর ধরে ডমিনিকাবাসী যে বদরুজ্জামানের কথা আপনাদের আগেই জানিয়েছি, উনার ছেলে।
পরশু খেলা শেষে আরও কিছু ভারতীয় ও পাকিস্তানি বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত হোটেলের লবিতে জয় উদ্যাপন করতে এল ওরা সবাই। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছবি-টবি তুলল, রাত জেগে আঁকা পোস্টার উপহার দিল খেলোয়াড়দের। ক্রিকেটাররা অবশ্য না করলেই নয় এতটুকু ভদ্রতা দেখিয়ে যে যার রুমে। ম্যানেজার শফিকুল হককেই বরং দেখা গেল তাদের সঙ্গসুধা পানে বেশি আগ্রহী।
এর আগে মাঠে একটা মজার ঘটনা ঘটল। এবারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সবচেয়ে যেটি বিস্মিত করেছে, তা হলো এখানকার মিডিয়ার অনুপস্থিতি। গ্রেনেডা থেকে লেখা কড়চায় প্রেসবক্সেও একটা রেকর্ড হয়ে গেছে জানিয়ে পরে বিস্তারিত লেখার যে প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়েছিলাম, সেটি এই বিষয়েই। রেকর্ডের শিরোনাম হতে পারে–প্রেসবক্সে একমাত্র সাংবাদিক বাংলাদেশের। প্রেসবক্সে লোকজন আরও কিছু ছিল। তবে তাঁদের কেউই এই ম্যাচ কভার করছিলেন না। স্পনসর ডিজিসেলের পাঁচ-ছয়জন, টিভি কমেন্ট্রি শেষ করে টনি কোজিয়ারও এসে বসতেন। এর বাইরে বারবাডোজের এক সাংবাদিক দুদিন এসেছিলেন। লেখা-টেখা দূরে থাক, একটা নোট নিতেও দেখিনি কখনো। লাঞ্চের আগে আগে আসতেন, লাঞ্চ করার পর তাঁর জরুরি কোনো কাজের কথা মনে পড়ে যেত।
ঘটনা কী? ত্রিনিদাদে তিনটা বড় পত্রিকা আছে, বারবাডোজের নেশন আর জ্যামাইকার গ্লিনারও বেশ নামকরা পত্রিকা। ওসব পত্রিকার সাংবাদিকেরা কই? খোজখবর করে জানলাম, আর্থিক মন্দার এই সময়ে এঁদের নাকি পাশের দ্বীপে সাংবাদিক পাঠানোর মতো সামর্থ্য নেই! ডমিনিকার প্রেসবক্সে অবশ্য স্থানীয় এক সাংবাদিকের দেখা মিলল । ডমিনিকায় দুটি পত্রিকা। দুটিই সাপ্তাহিক। সান বেরোয় সোমবার, বৃহস্পতিবার ক্রনিকল। সান-এর সাংবাদিক প্রেসবক্সেই বসতেন, ক্রনিকল-এর সাংবাদিকের দেখা পেলাম পরশু ম্যাচ শেষে ।
এখানে ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনও খুব মজার। বসে টসে কথা বলার বালাই নেই। সাংবাদিক থাকলে তো! ক্যারিবিয়ানে রেডিও খুব জনপ্রিয়। ক্রিকেটের চলতি ধারাবিবরণী প্রচারিত হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ বা কোনো খেলোয়াড়ের প্রতিক্রিয়া জানতেও মূলত রেডিওর লোকজনই যান ।
মজার যে ঘটনার কথা বলছিলাম, গত পরশু ম্যাচ শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ জন ডাইসনকে স্থানীয় এক সাংবাদিক ডমিনিকার ক্রিকেট সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। ব্যাপারটা আরেকজনের একদমই পছন্দ হলো না। তাঁর লাইন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভরাডুবি, কিন্তু তাঁকে প্রশ্ন করারই সুযোগ দিচ্ছেন না ওই সুযোগ সুবিধাবিদ। শেষ পর্যন্ত দুজনের তুমুল ঝগড়াই শুরু হয়ে গেল। সেটি থামার পর ডাইসনকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্দশায় ক্ষুব্ধ সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোথায় যাচ্ছে? ডাইসন গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন, 'সেন্ট কিটস।'
ওই সাংবাদিক তো মহা উত্তেজিত হয়ে বললেন, এর মানে কী? ডাইসন একই রকম নির্লিপ্ত, ‘এখান থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেন্ট কিটসে যাচ্ছে। সেখানে আরেকটি ওয়ানডে, এরপর একটা টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।' ওই সাংবাদিকের প্রশ্নটা ছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কী?
ডাইসনের তা না বোঝার কথা নয়। কিন্তু কী বলবেন তিনি! প্রশ্নটা
আক্ষরিক অর্থে নেওয়াটাই নিরাপদ পথ মনে হলো তাঁর কাছে। হ্যা, পরের গন্তব্য সেন্ট কিটসই। দুদল ডমিনিকা থেকে সরাসরি ফ্লাইটেই যাচ্ছে। আমার ফ্লাইট অ্যান্টিগা হয়ে। আবার সেই লিয়াট! আমার জন্য দোয়া করবেন ভাই!
৩০ জুলাই, ডমিনিকা।