ছুটি কাটাতে আসুন, কাজ নিয়ে নয়

উৎপল শুভ্র

২৭ মে ২০২১

ছুটি কাটাতে আসুন, কাজ নিয়ে নয়

সাগর, সৈকত, নারিকেল গাছে মিল থাকলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিটা দ্বীপেরই আলাদা চরিত্র। একেকটা তাই একেকভাবে মুগ্ধ করবে আপনাকে। তবে একটা ব্যাপার সব দ্বীপেই কমন। জীবনটাকে সহজভাবে নিয়ে কোনো কিছুকেই সিরিয়াস না ভাবা। এ কারণেই বলি, ক্যারাবিয়ান ছুটি কাটানোর জন্য আদর্শ, কাজ করতে গেলেই সমস্যা।

প্রথম প্রকাশ: ১৯ জুলাই, ২০০৯। প্রথম আলো।

ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনেও নিশ্চয়ই কেউ কেউ ক্যারিবিয়ানে আসে। তবে সংখ্যাটা একেবারেই নগণ্য। মানুষ এখানে সবচেয়ে বেশি আসে ছুটি কাটাতেই। ইউরোপ-আমেরিকায় যখন তীব্র শীতের কামড়; ক্যারিবিয়ানের ঝকঝকে রোদ আর রুপালি সৈকতে যে তখন চুম্বকের টান।

সেই টানেই ছুটে আসে হাজার হাজার মানুষ। ক্যারিবিয়ান দেশগুলোও খেয়ে-পরে বাঁচে। পর্যটনের ওপর এমনই নির্ভরতা যে, বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দায় সতর্ক সংকেত বাজছে ক্যারিবিয়ানজুড়ে। ইউরোপেও এখন গ্রীষ্ম, রোদের জন্য তাই এখানে আসার প্রয়োজন নেই। টুকটাক পর্যটক এখন যা আসছে, সেটি বোনাস। পর্যটন-মৌসুম শুরু হবে ইউরোপের শীতে, কিন্তু মন্দার এই সময়ে গুচ্ছের টাকা খরচ করে এবার ওরা আসবে তো?

এটি ওদের সমস্যা, ওরা বুঝুক। আমার কী, আমি তো এখানে আর দিন পনেরো আছি। প-নে-রো দিন! একটা দিনকেই যে এক বছর বলে মনে হচ্ছে! বাংলাদেশের সাংবাদিক আমি একা। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গেই যা একটু বাংলায় কথা বলার সুযোগ পাই, বাকি সময়টা ক্যারিবিয়ানের দুর্বোধ্য ইংরেজি বুঝতে প্রাণান্তকর অবস্থা।

আসল সমস্যা এটা নয়। তা হলো, এটি আসলে শুধুই ছুটি কাটানোর জায়গা। কাজ করার নয়। আর সাংবাদিকের মতো আপনার কাজ যদি ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে বাঁধা থাকে, তা হলে তো হয়েছেই! 

ক্যারাবিয়ানের মানুষগুলো বড় দিলখোলা। এই ডাব বিক্রেতাই যেমন ডাব কাটতে কাটতে আপনাকে আপন করে নেবে

ক্যারিবিয়ানদের দেখি আর অবাক হয়ে ভাবি—এরা এমন হলো কীভাবে! কোনো কিছুতেই হেলদোল নেই, সব সময় একটা এলায়িত ভঙ্গি। ঢিলা বললে এদের কিছুই বোঝানো যায় না। এরা হলো মহাঢিলা। সাগরের হাওয়াতেই কি কিছু একটা আছে! নাকি ছুটি কাটাতে আসা মানুষের কোনো কিছু নিয়েই তাড়া থাকে না বলে এদের নিয়ে কারবার করতে করতে ওরা এমন হয়ে গেছে!

ট্যাক্সি ড্রাইভাররাই দেখলাম একমাত্র ব্যতিক্রম। নইলে আর কাউকে যদি সকাল নয়টায় আসতে বলেন, নিশ্চিত থাকতে পারেন ভাগ্য খুব ভালো হলে ১১টার দিকে তাঁর দেখা পাবেন। আগমনটা এমনই হাসিমুখে হেলতে-দুলতে হবে যে, আপনার সন্দেহ হতে বাধ্য—আমি কি ১১টাতেই আসতে বলেছিলাম নাকি! দেরিতে যদি প্রতিক্রিয়া দেখান, এমন বিস্ময় উপহার পাবেন যে, আপনার নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হবে! ঠিকই তো, নয়টার জায়গায় ১১টা—এমন কী দেরি!

বারবাডোজের একট ঘটনা বলি। আমার হোটেলে একটা লাইট জ্বলছে না। রিসেপশনে ফোন করার পর জানানো হলো, এখনই ইলেকট্রিশিয়ান আসছে। সেই ‘এখনই’ আধঘণ্টাতেও শেষ না হওয়ায় আবার ফোন। এবার উত্তর পেলাম, ‘হি ইজ অন দ্য ওয়ে।’ রিসেপশন থেকে আমার রুমে আসতে দুই-তিন মিনিটের বেশি লাগে না। অথচ আরও আধঘণ্টা অপেক্ষার পরও ফোন করে পেলাম সেই একই উত্তর, ‘অন্য দ্য ওয়ে!’ আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। অন দ্য ওয়ে তো বুঝলাম, কিন্তু ইলেকট্রিশিয়ান ভদ্রলোক কি সেন্ট লুসিয়া থেকে আসছেন নাকি? রিসেপশনের তরুণী আমাকে সংশোধন করে দিলেন, ‘না, না; ও তো হোটেলেই থাকে।’

আরও মিনিট পনেরো পর যখন ছোকরা ইলেকট্রিশিয়ানের দেখা মিলল, আমাকে উত্তেজিত দেখেও তাঁর শিস দেওয়া বন্ধ হচ্ছে না। শিস বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে একটাই কথা—‘কুল মান! কুল!’ ব্যাটা বলে কি! আমি এক ঘণ্টারও বেশি অন্ধকারে বসে আছি আর উনি বলছেন, কুল মান!

এমনিতে এরা লোক বড় ভালো। যাকে বলে দিলখোলা মানুষ। পর্যটকদের নিয়ে কারবার বলেই কি না প্রথম পরিচয়েই এমন আন্তরিক যে, মনে হবে যেন অনেক দিনের চেনা। কিন্তু সমস্যাটা হয় আপনার হাতে নির্দিষ্ট সময়ে করণীয় জরুরি কোনো কাজ থাকলে। আজ (শনিবার) সকালে হোটেল থেকে মাঠে আসার অভিজ্ঞতার কথাই বলি। ম্যাচ রিপোর্টটা কোনোমতে শেষ করে মাঠে আসার তাড়া। এসে কড়চা লিখতে হবে। ট্যাক্সিতে উঠেই তাগাদা দিলাম, আজ তাড়াতাড়ি যেতে হবে। রয় স্যামুয়েলস্ নামে ৫২ বছরের আমুদে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়েও হঠাৎ নেমে গেলেন। হোটেলের সামনে আরেকটা গাড়ি এসে থেমেছে। চালকের আসনে বসা ভদ্রমহিলার সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা, একটু গল্প না করলে কেমন হয়!

এই ছবিটা গ্রেনাডার। পর্যটকদের সঙ্গে এভাবেই মিশে যায় স্থানীয় মানুষ

মাঠে আসার রাস্তাটাও কেমন অচেনা লাগল! আগের দিন পাহাড়ের ওপরের একটা রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম আর আজ একটা বাজারের মধ্য দিয়ে। জিজ্ঞেস করায় স্যামুয়েলস বললেন, ‘আজ শনিবার। সবার বাজারের দিন। দেখো, সবাই তাজা ফল ও তরিতরকারি কিনছে। তোমাকে দেখাতে একটু ঘুরে যাচ্ছি।’

কেমন লাগে বলেন! ট্যাক্সিতে উঠেই বলেছি, আমার তাড়া আছে আর উনি আমাকে সবজির বাজার দেখাচ্ছেন! 

লিয়াটের কল্যাণে ত্রিনিদাদে রাত কাটানোর সময় বব হাওয়ার্ড নামে এক ভদ্রলোককেও ওই বিড়ম্বনার সঙ্গী পেয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের লোক, গ্রেনেডায় বেড়াতে এসে ভালো লেগে যাওয়ায় বিশ বছর ধরে সেখানেই আছেন। বীমার ব্যবসা করেন। আমি এর আগেও দুবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসেছি জেনে বললাম, ‘তা হলে তো তোমার এদের বুঝে ফেলার কথা। প্রথম প্রথম আমার এমন মেজাজ খারাপ হতো যে পাগল-পাগল লাগত! কারও অফিসে আসার সময় ঠিক নেই। কোনো কাজ দিলে সেটি ঠিকভাবে হয় না। পরে বুঝেছি, ক্যারিবিয়ানে এসব নিয়ে মেজাজ খারাপ করে কোনো লাভ নেই। এটাই ওদের ওয়ে অব লাইফ, কিছুতেই তা বদলাবে না।’

কিছুতেই না বদলানোর প্রমাণ তো ক্রিকেট মাঠেও প্রতিদিনই পাচ্ছি। গ্রেনেডার প্রেসবক্সে টিভি আছে, কিন্তু স্কোরার নেই। প্রথম দিন মাঠের স্কোরবোর্ডটাও চা-বিরতির আগ পর্যন্ত অচল। সাবেক জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যান অ্যান্ডি পাইক্রফট এই সিরিজেই প্রথম ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পেয়েছেন। মাঠে স্কোরবোর্ড থাকাটা টেস্ট ম্যাচের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কি না—জানতে চাওয়ায় অসহায়ের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘স্কোরবোর্ডের কথা বলছেন? সকালে মাঠে গিয়ে দেখি এক দিকের সাইট স্ক্রিনও নেই! দুদিন আগে ভেন্যু পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখলাম টেস্ট ম্যাচের কোনো প্রস্তুতিই নেই। আমি নয়টা জিনিস করতে হবে বলে তালিকা করে দিয়েছিলাম। পরদিন গিয়ে দেখি মাত্র একটা হয়েছে।’

আইসিসির কাছে কড়া ভাষায় একটা রিপোর্ট দেবেন বলে জানালেন। তবে তাতে নিজের কর্তব্য পালন করা ছাড়া আর কিছুই যে হবে না, সেটি তিনিও জানেন। ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজে যেকোনো সিরিজেই ম্যাচ রেফারিরা এমন রিপোর্ট দেন। ওদেরকে বলাও হয়। ওরা পাত্তাই দেয় না।’

কাজের সময় বিরক্তি লাগে। আবার ভাবি, ভালোই তো আছে ওরা! কোনো কিছুকে পাত্তা না দিয়ে আনন্দময় এই নির্ভার হেলদোল জীবন খারাপ কী!

জুলাই ২০০৯, গ্রেনাডা।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×