গ্রেনাডার বদলে ত্রিনিদাদ

উৎপল শুভ্র

২৬ মে ২০২১

গ্রেনাডার বদলে ত্রিনিদাদ

সেন্ট ভিনসেন্টে প্রথম টেস্ট জয়ের সুখস্মৃতি নিয়ে গ্রেনাডা যাব বলে এয়ারপোর্টে বসে আছি, আছি তো আছিই, শেষ পর্যন্ত গ্রেনাডার বদলে যেতে হলো ত্রিনিদাদ। সেখান থেকে পরদিন নাকি গ্রেনাডায় যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেন এয়ারপোর্টে নেমে আরেক বিড়ম্বনা।

গগনে গরজে মেঘ ঘোর বরষা, হোটেলে একা বসে আছি নাহি ভরসা...

গুরুদেব, ক্ষমা করবেন। সংবাদপত্রের লেখার দাবি মেটাতে আপনার কবিতার লাইনটা একটু বাস্তবানুগ করে নিতে হলো!

‘বসে আছি’টাকে ‘কড়চা লিখছি’ করে দিলে আরও বাস্তবোচিত হতো। কিন্তু তাতে যে কবিতার ছন্দটা নষ্ট হয়ে যায়!

ক্যারাবিয়ানে এখন বর্ষাকাল। বরষাই তো থাকবে। হোটেলে বসে আছি—এটাই বা এমন ঘটা করে জানানোর কী আছে? হোটেলেই তো থাকার কথা। কিন্তু ত্রিনিদাদের হোটেলে? আমার তো এখন গ্রেনেডার হোটেলে থাকার কথা ছিল!

সেন্ট ভিনসেন্ট পর্ব শেষ করে পরশু রাতে গ্রেনেডাতেই যাচ্ছিলাম। লিয়াট নামে ক্যারাবিয়ানের কুখ্যাত এয়ারলাইন্সের কল্যাণে রাত আড়াইটায় এসে উঠলাম ত্রিনিদাদের হোটেলে!

আকাশ থেকে দেখা গ্রেনাডা। ছবি: উইকিপিডিয়া

রাত সাড়ে আটটায় বিমান ছাড়ার কথা, পৌনে নয়টার দিকে ঘোষণা এল লিয়াটের বিমান এখন অ্যান্টিগায়, সেটিতে কী একটা গড়বড় হয়েছে। বিমান ছাড়ার পরিবর্তিত সময় রাত সাড়ে দশটা। সাড়ে দশটা বাজল, এগারোটা—কোনো খবর নেই। সোয়া এগারোটার দিকে লিয়াটের লম্বাচুলো এক তালপাতার সেপাই এসে অবলীলায় ঘোষণা করল, সাড়ে বারোটায় বিমান ছাড়বে এবং দেরি হয়ে গেছে বলে গ্রেনেডা না হয়ে সরাসরি যাবে ত্রিনিদাদ। গ্রেনেডার যাত্রীরা ত্রিনিদাদে রাত কাটিয়ে পরদিন যাবেন গন্তব্যে।

এই বেয়াদব বলে কি! গ্রেনেডায় আমার হোটেল বুক করা, পরদিন সকালে কত কাজ! কিন্তু মান্ধাতা আমলের ছোট্ট সব বিমান নিয়ে কারবার লিয়াটের কর্মীদের এমন মারমুখো যাত্রীদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই পরিচয় হয়। আমার উত্তেজিত রূপে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নির্বিকার মুখে ওই তরুণ আশ্বাস দিলেন, ‘সমস্যা কী? ত্রিনিদাদে হোটেল দেওয়া হবে। ভোরেই গ্রেনেডার ফ্লাইট।’

ত্রিনিদাদ বিমানবন্দরে নেমে মহাবিড়ম্বনা। ইমিগ্রেশনের লোকজনকে গ্রেনেডার যাত্রীদের ত্রিনিদাদে রাত্রিযাপনের ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। লিয়াটের কাউকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে শেষপর্যন্ত একটা সুরাহা হলো এবং জানা গেল, লিয়াটের ওই কর্মী মিথ্যা বলেছেন। ভোরে ত্রিনিদাদ থেকে গ্রেনেডায় কোনো ফ্লাইট নেই, প্রথম ফ্লাইটটা দুপুর সোয়া দুটোয়। গ্রেনেডায় যেতে না পারার আসল কারণও অন্য। রাত দশটার পর গ্রেনেডার বিমানবন্দরে ছুটি হয়ে যায়।

আকাশ থেকে দেখা ত্রিনিদাদ। ছবি: উইকিপিডিয়া

কী চমৎকার একটা দিনের কী ভয়াবহ সমাপ্তি! টেস্ট জয়ের মধুর আবেশ নিয়ে ঘুম ভেঙেছে। বিজয়ের গল্প লিখে-টিখে দুপুর বারোটার মধ্যে ফ্রি। এবার আমি নির্ভেজাল পর্যটক! ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেন্ট ভিনসেন্ট দেখতে। ক্রিকেট এমনই সময়গ্রাসী খেলা যে, দেশ আর শহর দেখা বলতে বেশির ভাগ সময়ই বিমানবন্দর, হোটেল আর মাঠ। এবার কড়চার মালমসলা জোগাড়ের বাড়তি দায় আছে বলে বাধ্য হয়েই একটু এদিক-ওদিক যাওয়ার সময় বের করতে হচ্ছে। সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে গ্রেনাডার শেষ ফ্লাইটটাও নেওয়া এ কারণেই।

পর্যটকের চোখে সেন্ট ভিনসেন্ট দেখার বিকেলটা এমনই মন ভরিয়ে দিয়েছে যে, ত্রিনিদাদের হোটেলে বসে এই কড়চা লিখতে হওয়ার বিরক্তির মধ্যেও তা ছড়িয়ে দিচ্ছে ঝিরিঝিরি বাতাস। অগ্ন্যুৎপাত থেকে জন্ম, সেন্ট ভিনসেন্ট তাই পাহাড় আর পাহাড়। সেই পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা, পাশেই সাগর, দূর দিগন্তে গিয়ে যা মিশে গেছে নীল আকাশে। আহা, প্রকৃতির চেয়ে বড় শিল্পী আর হয় না!

প্রায় বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়া ট্যাক্সি ড্রাইভারকে আগেই বলা ছিল, হাতে সময় কম, সেন্ট ভিনসেন্টে এসে পর্যটকেরা যেসব দেখে, সেই তালিকার এক নম্বর থেকে শুরু করো। এক-দুই-তিন করে যতটুকু পারা যায়। শুরুটা হলো ফোর্ট চালোট দিয়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাত শ ফুট ওপরে পাহাড়ের মাথায় সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের বানানো দুর্গ। সামনে তাকালে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত চোখ যায়। এটি বানানোর উদ্দেশ্যও তো ছিল এটিই।

পাহাড়ের মাথায় ফোর্ট শ্যালোট। কিংসটাউন, সেন্ট ভিনসেন্ট

মানবজাতি যখন ভূখণ্ড জয়ের লড়াইয়ে লিপ্ত, কোন দিক থেকে কে এসে আক্রমণ করে বসে ঠিক নেই, তখন এখানে বসেই চোখ রাখা হতো বহিঃশত্রুর দিকে। সেই যুগের বেশ কয়েকটা কামানও এখনো আগের জায়গায়ই বসে আছে। এখন এটি লাইটহাউসের কাজ করে। আর পেছনে ছোট্ট একটা ঘর কাজ করে মহিলা কয়েদিদের শাস্তি-নিবাস হিসেবে। নিচে লতাপাতায় প্রায় ঢেকে যাওয়া লোহার একটা কাঠামো দেখিয়ে বার্ট (গাইডে রূপান্তরিত আমার ট্যাক্সি ড্রাইভার) জানাল, এক সময় ওখানে কুষ্ঠরোগীদের ফেলে যাওয়া হতো।

ফোর্ট চালোট থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন। সেটি কিংসটাউন শহরের মধ্যেই। সাজানো-গোছানো গাছের সারি আর ফুলের মেলা—বোটানিক্যাল গার্ডেন যেমন হয় আর কি! সবচেয়ে দর্শনীয় অবশ্য সেন্ট ভিনসেন্ট প্যারট। প্যারট মানে তো অবশ্যই টিয়া পাখি, তবে হলুদ-নীল-সবুজে বহুবর্ণ সেন্ট ভিনসেন্টের জাতীয় পাখির এমনই আকার যে, ইগল বলে ভুল হতেই পারে কারও।

বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বেরিয়ে বার্ট বলল, এবার তোমাকে আসল জায়গা দেখাব। আসল জায়গা মানে কিংসটাউন থেকে গাড়িতে আধঘণ্টা দূরত্বের ওয়ালিবু। যেখানে শুটিং হয়েছে হলিউডের ব্লকবাস্টার ছবি পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান-এর। ওই ছবির প্রথম পর্ব মুক্তি পাওয়ার পরই সেন্ট ভিনসেন্টে আসা পর্যটকদের অবশ্যদ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে এটি। দুদিকে পাহাড়, মাঝখানে সাগর—অপূর্ব একটা জায়গা। পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান ছবির প্রায় সব উপকরণই রাখা আছে সেখানে। সেই ঘর, কফিনের সারি, জনি ডেপের বেয়ে ওঠা মাস্তুল, আদ্যিকালের টেলিফোন, মাথার খুলি, হাড়গোড়...। ছোট্ট একটা জাদুঘরমতোও দাঁড়িয়ে গেছে। পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান-এর ছবি অঙ্কিত চাবির রিং-মগ-ওয়ালমেট-টিশার্ট—সুন্দরই জিনিসগুলো, কিন্তু দাম দেখার পর আমার কাছে আর একটুও সুন্দর মনে হলো না!

জায়গার নাম ওয়ালিবু। এখানে শ্যুটিং হয়েছিল `পাইরেটস অব দ্য কাারিবিয়ান`-এর

পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান-এর কাছে সেন্ট ভিনসেন্টের অসীম কৃতজ্ঞতা। এই ছবিই সারা বিশ্বে নতুন করে চিনিয়েছে দেশটিকে। যেটির অনিবার্য প্রভাব পড়েছে পর্যটকের সংখ্যাতেও। ওয়ালিবু থেকে ফেরার পথে যেখানে থামলাম, পর্যটকদের একটা অংশের কাছে সেটিও বড় আকর্ষণ, বিশেষ করে যারা নৃতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন। ঘন জঙ্গলের মধ্যে কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছে দুহাত প্রশস্ত একটা নদী। তার পাশে বিশাল একটা পাথরে কী যেন আঁকিবুকি। একটু খেয়াল করলে মানুষের মুখের মতো বোঝা যায়। এগুলোকে বলে ‘পেট্রোগ্লিফ’, যাতে ক্যারাবিয়ানে মানব প্রজাতির আদিতম সময়ের ছাপ।

ওসব শিল্পকর্ম কারিবদের কাজ। সেন্ট ভিনসেন্টের আদি বাসিন্দাও তারাই। এই ভূখণ্ড ক্রিস্টোফার কলম্বাস আবিষ্কার করেছেন বলে যে একটা জনশ্রুতি ছিল, গবেষণায় সেটি মিথ বলে প্রমাণিত। কলম্বাস এখানে কোনোদিন নামেননি, পাশ দিয়ে যখন গেছেন, তার অনেক আগে থেকেই কারিবদের বসত এখানে। ২০০২ সাল পর্যন্ত ২২ জানুয়ারি মহাসাড়ম্বরে পালিত ‘কলম্বাস ডে’ তাই এখন বাদ। পরিবর্তে ১৪ মার্চ পালিত হয় ন্যাশনাল হিরোস্ ডে। হাজার বছর আগে এই দিনেই কারিবদের নেতা জোসেফ চাটোয়া ব্রিটিশ হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন বলে ধারণা।

এগুলোকে বলে পেট্রোগ্লিফ। সেন্ট ভিনসেন্টোর পাথরে উৎকীর্ণ সেখানকার আদি বাসিন্দা কারিবদের শিল্পকর্ম

পেট্রোগ্লিফ দেখতে দেখতে বার্ট সগর্বে ঘোষণা করল, আমি কিন্তু কারিব। তাই নাকি? কারিবদের বংশধরেরা এখনো আছে? আছে, তবে সেন্ট ভিনসেন্টে মেরেকেটে শ পনেরো। বার্টকে দেখতে তো আর আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের মতোই লাগে। ‘কারণ হলো, আমার মা কারিব, বাবা নিগ্রো। আমার মায়ের চুল সোজা, গায়ের রংও আমার মতো মিশমিশে কালো নয়।’

এখানেই শেষ করি। লিয়াটের ফ্লাইটের ডাক এসেছে। বিমানবন্দরে যেতে হবে। আজও গ্রেনেডা যাওয়া হবে কি না সেটি অবশ্য নিশ্চিত হতে পারছি না। ওই যে শুরুতে রবিবাবুর কবিতার লাইনটা... ‘নাহি ভরসা’ শব্দ দুটি তো লিয়াট এয়ারলাইন্সকে নিয়েই লেখা!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×