আমি বিজয় দেখেছি
উৎপল শুভ্র
২৪ মে ২০২১
বাংলাদেশের একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের সব বড় জয়ই দেখেছি—এটা বললে কি তা গর্বের মতো শোনায়? শোনালে শোনাবে। বাংলাদেশ দল বাজে খেললে যখন `এমন জঘন্য খেলা নিয়ে এত কথা লেখেন, আপনার লজ্জা লাগে না?` প্রশ্ন শুনতে হয়, তখন এই সুযোগে আমি কেন বলব না--আমি বিজয় দেখেছি!
‘আমরা করব জয়...' গানটা শুনলেই আমার চোখে কেন যেন জল চলে আসে। গত পরশু আর্নস ভেলে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের বারান্দায় বসে আবারও তা এল। ভেতরে ক্রিকেটাররা 'আমরা করব জয়...' গাইছে, একেকজনের গলা একেক দিকে—–আহা, তার পরও কী মধুরই না লাগছে।
এমনিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জয় যে আমাকে খুব আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তা নয়। বরং উল্টো প্রচণ্ড একটা চাপ অনুভব করি। মনে হয়, এই দেখো, বাংলাদেশ দলের ভারটা এখন আমার ওপর চেপে বসল! মাঝখানে অনেক বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর একেকটা জয় আসে বলেই সেটি আর শুধুই জয় থাকে না। পুরো দেশের আবেগ জড়িয়ে যায় সেই জয়ে। সেই আবেগ প্রথাগত ক্রিকেট রিপোর্টিংয়ের চেয়ে বেশি কিছু দাবি করে। পারব তো?
ক্রিকেটারদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজি। ওরা তো আরও কত চাপের মধ্যে পারফর্ম করে, পুরো দেশের প্রত্যাশা চেপে থাকে ওদের কাঁধে, আমার লেখা আর কয়জন পড়বে?
জয়ের আনন্দে ভেসে যাওয়ার বদলে এমনিতেই কৃষ্ণবর্ণ মুখ আরও কালো হয়ে যাওয়ার একটা কারণ যদি এটা হয়, আরেকটা আবেগকে চেপে বসতে দেওয়ার সময় কই? বাংলাদেশের জয় মানেই কাজ বেড়ে যাওয়া। দলের সবার সঙ্গে কথা বলো, ড্রেসিংরুমে কেমন উৎসব হলো, সেই খোঁজখবর নাও–বেশির ভাগ সময় ম্যাচ শেষ হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা লিখে পাঠাও।
সেন্ট ভিনসেন্টের জয়টা এই সমস্যা থেকে মুক্ত। সময় পার্থক্যের কারণে এটি বিস্তারিত লেখার কাজটা পরদিনের জন্য তোলা। বলতে গেলে এই প্রথম তাই বাংলাদেশের জয়ের আনন্দটা খেলোয়াড়দের মিলেমিশে উপভোগ করলাম। শুধু ড্রেসিংরুমে প্রবেশাধিকারটুকু বাদে। কেন, এখানে আমি বাংলাদেশের একমাত্র সাংবাদিক, আমাকে ড্রেসিংরুমে ডেকে নিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত! আর খেলোয়াড়দের যে গানের গলার পরিচয় পেলাম, 'আমরা করব জয়' আমি এর চেয়ে খারাপ গাইতাম না।
দুষ্টুমি করলাম। ড্রেসিংরুম খেলোয়াড়দের ভুবন। সেখানে অন্য কেউ কেন থাকবে? তার ওপর আবার সাংবাদিক। এতক্ষণ যা বললাম, তা বাংলাদেশের জয়ে আবেগে ভেসে না যাওয়ার গৌণ কারণ। আসল কারণটা হলো, এমন দু-একটা জয়েই বাংলাদেশের ক্রিকেট জাতে উঠে গেল, আমি একদমই তা মনে করি না।
সেদিন এক পাঠকের মেইল পেলাম। তাঁর দাবি, বাংলাদেশই আসলে ক্রিকেটের সবচেয়ে আনপ্রেডিক্টবল দল। আজ ভালো খেলে তো কাল খারাপ। আমি পুরোপুরি একমত পোষণ করে দুষ্টুমি করে উত্তর দিলাম, "ক্রিকেটারদের রবীন্দ্রসংগীত শোনা নিষিদ্ধ করতে হবে। ওরা সবচেয়ে বেশি কোন গানটা শোনে জানেন, 'কোন খেলা যে খেলব কখন/ ভাবি বসে সেই কথাটাই..."
এখনো জাতীয় দলের ক্যাম্পে না থাকলে একজন ক্রিকেটারের জিমনেসিয়ামে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্লাবে ফিজিও নেই, ট্রেনার নেই, অনুশীলনের জন্য ভালো উইকেট পর্যন্ত নেই। ওঁরা কী প্রস্তুতি নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এই কঠিন অঙ্গনে পা রাখছে?
বাংলাদেশ আনপ্রেডিক্টেবল, কারণ বাংলাদেশ ভালো দল নয়। খারাপ দল হঠাৎ হঠাৎ ভালো খেলে ফেলে, ভালো দল বেশির ভাগ সময়ই ভালো। এটা আসলে আপনাকে আগে বুঝতে হবে। বাংলাদেশ যে খারাপ দল, সেই দায়টাও শুধু এই দলের নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের!
এই সেন্ট ভিনসেন্ট টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের সময় ফেসবুকে বিচিত্র সব মন্তব্য পড়ছিলাম। একজন আমাকে গুরুদায়িত্ব দিয়ে ফেললেন, 'ভাই, ব্যাটসম্যানদের সবাইকে কান ধরে মাঠে ১০ চক্কর দিতে বলেন।' আমি উত্তর দিলাম, 'ভাই, বাংলাদেশে আর কোন ক্ষেত্রে নিজের কাজটা না পারলে এমন শাস্তির ব্যবস্থা আছে, জানাবেন।'
আরেকজন লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারছেন না। কেন, লজ্জা কেন? খেলায় না পারলে লজ্জার কী আছে? ক্রিকেট দলের পরাজয়ে এমন লজ্জা, বাংলাদেশ যখন দুর্নীতিতে বিশ্বের এক নম্বর হয় তখন তো কাউকে তেমন লজ্জা পেতে দেখি না!
ক্রিকেটারদের হাজারো দোষ। বড় স্বপ্ন নেই, অনেকেই পরিশ্রমবিমুখ--আমি নিজেই তো এসব কত লিখেছি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, এটাই কি আমাদের জাতীয় চরিত্র নয়। ক্রিকেটাররা তো আর ভিনগ্রহ থেকে আবির্ভূত কোনো মহামানব নয়। এঁদের মধ্যে তো সমাজের প্রতিচ্ছবিই থাকবে।
এটাও আসল কথা নয়। আসল কথা হলো, বাংলাদেশের ক্রিকেট যেমন অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে দিন পার করছে, ক্রিকেট দল তো এমনই হবে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর নয় বছর হতে চলল, এখনো আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে পিকনিকের আমেজ। এখনো আমাদের ক্রিকেট শুধুই ঢাকাকেন্দ্রিক, এখনো জাতীয় দলের ক্যাম্পে না থাকলে একজন ক্রিকেটারের জিমনেসিয়ামে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্লাবে ফিজিও নেই, ট্রেনার নেই, অনুশীলনের জন্য ভালো উইকেট পর্যন্ত নেই। ওঁরা কী প্রস্তুতি নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এই কঠিন অঙ্গনে পা রাখছে? এ যেন ক্লাস ফাইভের বই পড়া ছেলেকে মাস্টার্স পরীক্ষায় বসিয়ে দেওয়ার মতো!
তাই বলি, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হলে নিজ দায়িত্বে দেখুন। আর খারাপ খেললেই মাশরাফি-আশরাফুলদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার না করে মিছিল করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে চলে যান। গিয়ে শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করুন, ক্রিকেটের বড় দলগুলোর কাছে আমরা কখনো এক শ-দেড় রানেও হারি। কিন্তু পেশাদারিত্ব, ব্যবস্থাপনা, ক্রিকেট অবকাঠামো—এসব বিবেচনায় ওসব দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কাছে বিসিবি কত রানে হারবে? উত্তরটা আমিই বলে দিই। সংখ্যাটা এত বড় হবে যে, ক্যালকুলেটরের পর্দায় ধরবে না।
না, লেখাটা কড়চার মেজাজ হারিয়ে বড় বেশি গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কী করব, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ভাবলেই যে এই কথাগুলো খুব বিরক্ত করতে থাকে। বাংলাদেশ মাত্র টেস্ট জিতেছে, আপনাদের সবার মনমেজাজ ভালো—এই সুযোগটা নিয়ে মনের কথাগুলো উগড়ে দিলাম আর কি!
মনমেজাজ আমারও খুব ভালো। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র সাংবাদিক বলে প্রেসবক্সে টনি কোজিয়ার-ইয়ান বিশপরা এমনভাবে অভিনন্দন জানালেন যে, মনে হলো আমিই জিতেছি। সাকিব আল হাসানের সঙ্গে রসিকতাও করলাম মাত্র তো একটা টেস্ট জিতলেন। আমি তো দুটিতেই ছিলাম। বাংলাদেশের একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের সব বড় জয়ই দেখেছি—এটা বললে কি তা গর্বের মতো শোনায়?
শোনালে শোনাবে। বাংলাদেশ দল বাজে খেললে যখন 'এমন জঘন্য খেলা নিয়ে এত কথা লেখেন, আপনার লজ্জা লাগে না?' প্রশ্ন শুনতে হয়, তখন এই সুযোগে আমি কেন বলব না--আমি বিজয় দেখেছি!