চাকরিটা না যায়!

২২ মে ২০২১

চাকরিটা না যায়!

প্রেসবক্সে বসেই শোনা যাচ্ছে সাগরের কলতান। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে দেখবেন, বিশ-পঁচিশ গজ দূরেই সাগর আর অসংখ্য হেরন পাখির উড়ে বেড়ানো। স্টেডিয়ামটাও খুব সুন্দর। সমস্যা একটাই, আমি তো আর পর্যটক হিসেবে আসিনি। যে কাজে এসেছি, সেটি করতে না পারলে এমন অপরূপ সৌন্দর্যও বিস্বাদ লাগে।

প্রথম প্রকাশ: ১২ জুলাই, ২০০৯। প্রথম আলো।

‘ভাই, এটা কি একবিংশ শতাব্দী, নাকি মধ্যযুগ?’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া ম্যানেজার ফিলিপ স্পুনার অবাক হয়ে বলেন, ‘কেন, এ কথা বলছেন কেন?’

বলব না! একটা টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে। অথচ প্রেসবক্সে স্কোরার নেই, টিভি নেই, ইন্টারনেট কাজ করছে না—বাংলাদেশ পর্যন্ত ডিজিটাল দেশ হয়ে যাচ্ছে, আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের একি দুরবস্থা!

ফিলিপ স্পুনার ছেলেটাকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম দেখেই খুব পছন্দ হয়েছে। মৃদুভাষী, মিশুক—নিজের কাজটাও বোঝে। নিজের কাজটাও বোঝে? প্রেসবক্সের এ অবস্থার পরও এমন স্বীকৃতি!

কারণ বেচারার নাকি কিছুই করার নেই। নিজে বারবাডোজের 'দ্য নেশন' পত্রিকায় অনেক দিন কাজ করেছেন। দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড ঘুরে এসেছেন। ক্রিকেট কভার করতে সাংবাদিকদের কী লাগে না-লাগে জানেন। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট বোর্ড এই ২০০৯ সালেও ভিক্টোরিয়ান যুগের ক্রিকেটের রোমান্টিসিজম ফিরিয়ে আনতে এমনই বদ্ধপরিকর যে, অনেক চেষ্টা করেও নাকি কিছু করতে পারেননি। ‘এ সমস্যার কথা জানিয়ে আপনি আমাকে একটা ই-মেইল করুন। আমি বোর্ডের লোকজনকে ওটা দেখিয়ে দেখি কিছু করতে পারি কি না’—বলার আগে এবং পরে ক্ষমা চেয়ে নিলেন স্পুনার।

কিন্তু আমার তো ক্ষমায় পেট ভরবে না। আগের দিনের বৃষ্টির কারণে গত পরশু দ্বিতীয় দিনের খেলা শুরু হয়েছে সকাল সাড়ে নয়টায়। সেন্ট ভিনসেন্টে আমার আবাস ক্রিস্টাল হাইটস গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ওপর একটা লেখা শেষ করে ‘ক্যারিবীয় কড়চা’টা মাত্র শুরু করেছি, মাঠে যাওয়ার ট্যাক্সি এসে হাজির। ঠিক আছে, বাকিটা না হয় মাঠে গিয়েই শেষ করব। হন্তদন্ত হয়ে প্রেসবক্সে ঢুকেই মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। টিভি আর স্কোরার যে নেই, সেটি তো আগের দিনই জানা হয়ে গেছে। এদিন দেখি ইন্টারনেটও কাজ করছে না। ‘প্রথম আলো’ প্রেসে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু লেখা পাঠাব কীভাবে?

মেজাজটা আরও বেশি খারাপ হওয়ার কারণ, ওই ইন্টারনেট-সেবাটা দাম দিয়ে কেনা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে সাংবাদিকদের প্রেসবক্সে ইন্টারনেট পেতে টাকা দিতে হয়। প্রথম সংস্করণের জন্য ম্যাচ রিপোর্ট দূরে থাক, ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসার পর ক্যারিবীয় কড়চাটাও যে প্রথমবারের মতো বাদ পড়তে যাচ্ছে—এটা বুঝতে পেরে আমি চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলাম। সাংবাদিকদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্রেন্ডা লি নামে মহিলা শুধু ক্ষমা চেয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু আমার ওই কথা—আমি কি ক্ষমা ভেজে খাব নাকি! এত টাকা খরচ করে এখানে এসেছি কি ফাজলামো করতে!

নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করে খেলা দেখতে দেখতে ভাবছি, নেভিল কার্ডাসরা তো এভাবেই ক্রিকেট কভার করতেন। কীভাবে লিখতেন, বল লেগ স্টাম্পে পড়ে একটু বাঁক খেয়ে ব্যাটের বাইরের দিকের কানা এড়িয়ে অফ স্টাম্পে গিয়ে লেগেছে? নির্ঘাত বানিয়ে লিখতেন!

নিজের জায়গায় ফিরে একটুই বেশিই করে ফেললাম কি না ভাবছি। কলিন ক্রফট এসে বললেন, ‘তুমি ন্যায্য কথাই বলেছ। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রতিটি সিরিজেই বিদেশি সাংবাদিকদের এই চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ওদের অভ্যাস হয়ে গেছে।’ বিশ্বকাপের ম্যাচ হয়েছে বলে গ্রেনাডা আর সেন্ট কিটসে টিভি-টুভি হয়তো পাব বলে ভরসা দিলেন। তবে ডমিনিকায় এর চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে বলেও আভাস দিয়ে রাখলেন। এরপর একটু রসিকতাও করলেন, ‘তুমি তো এর আগেও ক্যারাবিয়ানে এসেছ। তোমার তো অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা।’

এবার আর্নস ভেলে প্রথম পা রেখেই মুগ্ধতার কথা লিখেছি এই কলামেই। আসলেই দারুণ স্টেডিয়াম। দর্শক-টর্শক নেই বলে গ্যালারির লাল-নীল-হলুদ চেয়ারগুলো রঙধনু হয়ে উঠতে পারছে। পাশের বিমানবন্দর থেকে একটু পর পর ছোট ছোট সব বিমান উড়ে যাচ্ছে যেন মাঠের ওপর দিয়ে। মাঠটাও দুর্দান্ত। নিষ্কাশন ব্যবস্থা এমনই অসাধারণ যে, তুমুল বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার দশ মিনিট পরই খেলা শুরু হয়ে যাচ্ছে। প্রেসবক্সে বসেই শোনা যাচ্ছে সাগরের কলতান। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে দেখবেন, বিশ-পঁচিশ গজ দূরেই সাগর আর অসংখ্য হেরন পাখির উড়ে বেড়ানো (হেরন বোধ হয় এক ধরনের বকই, কিন্তু এত সুন্দর পরিপার্শ্বের সঙ্গে বকটা কেমন বেমানান লাগে না!)। সমস্যা একটাই, আমি তো আর পর্যটক হিসেবে আসিনি। যে কাজে এসেছি, সেটি করতে না পারলে এমন অপরূপ সৌন্দর্যও বিস্বাদ লাগে।

সেন্ট ভিনসেন্টের আর্নস ভেল স্টেডিয়ামের চারপাশে এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিন্তু খেলা কাভার করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে এমন অপরূপ সৌন্দর্যও বিস্বাদ লাগে

নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করে খেলা দেখতে দেখতে ভাবছি, নেভিল কার্ডাসরা তো এভাবেই ক্রিকেট কভার করতেন। কীভাবে লিখতেন, বল লেগ স্টাম্পে পড়ে একটু বাঁক খেয়ে ব্যাটের বাইরের দিকের কানা এড়িয়ে অফ স্টাম্পে গিয়ে লেগেছে? নির্ঘাত বানিয়ে লিখতেন! তখন প্রেসবক্সে যেমন টিভি ছিল না, পাঠকদের সামনেও না। কিন্তু আমার লেখা তো অসংখ্য রিপ্লেতে সমৃদ্ধ খেলা দেখে পড়তে বসবে বাংলাদেশের পাঠক। ভুল-টুল লিখলে এটা মনে করাও খুবই স্বাভাবিক যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে আমি বোধ হয় মাঠে না গিয়ে অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছি!

ভুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনাই থাকছে। সাকিব আল হাসানের আউটটা যে আউট নয়, গালিতে যাওয়ার আগে বল লেগেছে তাঁর আর্মগার্ডে, এটা তো আমি ইন্টারনেট সমস্যা সমাধান হওয়ার পর ক্রিকইনফো থেকে জেনেছি। সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু এক শ গজ দূরে চারতলা উচ্চতায় বসে কীভাবে নিশ্চিত হব, বলুন?

স্কোর-টোর নিয়েও মহাসমস্যা। স্কোরবোর্ডে লেখাগুলো এত ছোট যে, পড়াই মুশকিল। এর মধ্যেই আবার কলিন ক্রফট জানিয়ে গেছেন, স্কোরবোর্ডে বিশ্বাস রাখলে সর্বনাশ হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে নাকি যাকে-তাকে ধরে এনে স্কোরবোর্ডের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। যাদের অনেকে নাকি গণনা করতেও জানে না। হাতেনাতে প্রমাণও পেয়েছি। প্রথম দিনের খেলা শেষে বাংলাদেশের স্কোর ৪২, আর স্কোরার বাংলাদেশকে ভালোবেসে অবলীলায় তা ৫০ রান বাড়িয়ে ‘৯২’ দেখিয়ে গেলেন!

ও হ্যাঁ, গত পরশু বিকেলের দিকে প্রেসবক্সে টেলিভিশন একটা এসেছে। এক কোনায় ১৪ ইঞ্চি একটা সাদাকালো টেলিভিশন। সকালে এত চিল্লাচিল্লি করেছি, ধন্যবাদ জানানোটা কর্তব্য মনে হলো। ব্রেন্ডা লিকে হাসিমুখে বললাম, ‘শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ায় অনেক ধন্যবাদ।’ লি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে বললাম, ‘সাদাকালো টিভির কথা যে ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই শৈশবে দেখেছি কি না!’

১১ জুলাই ২০০৯। সেন্ট ভিনসেন্ট।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×