বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রাস্তায়
উৎপল শুভ্র
১৫ জানুয়ারি ২০২২
বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রাস্তা কোনটি, বলতে পারেন? তা দেখতে আপনাকে যেতে হবে নিউজিল্যান্ডের ডানেডিনে। রাস্তার নাম বল্ডউইন স্ট্রিট, পায়ে হেঁটে যেটির মাথায় উঠতে পারলে একটা সার্টিিফিকেট পাওয়া যায়। তবে তা বিনামূল্যে নয়।
সার্টিফিকেটটা হাতে নেওয়ার সময় নিজেকে এডমন্ড হিলারি মনে হলো। হিলারি উঠেছিলেন এভারেস্টে আমি উঠলাম কোথায়? বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রাস্তার শীর্ষে। কিসের সঙ্গে কী!
এভারেস্টে প্রথম মনুষ্য পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার কৃতিত্ব হিলারির। বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রাস্তার শীর্ষে প্রথম পদচিহ্ন অবশ্যই আমার নয়। ডানেডিনের অবশ্যদ্রষ্টব্য বন্ডউইন স্ট্রিটে প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটকের পদচিহ্ন পড়ে। গত পরশু বিকেল সাতটার দিকে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ওপরে উঠছি, তখনো দেখা হলো ভ্রমণপিয়াসী বেশ কজন জাপানির সঙ্গে।
বিকেল সাতটা লিখেছি বলে অবাক হবেন না। সামারে নিউজিল্যান্ডে সন্ধ্যা নামে রাত ১০টায়। নয়টার দিকেও এমন রোদ থাকে যে, মনে হয় বাংলাদেশে শীতের বিকেলের তিনটা। বাংলাদেশের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের সময়পার্থক্য (বাংলাদেশ সাত ঘণ্টা পিছিয়ে) এমনিতেই যথেষ্ট আয়েশ করে লিখতে বসার সুযোগ দেয়। গত পরশু চা-বিরতির আগেই ডানেডিনে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ায় হাতে অফুরন্ত সময়। ডানেডিনের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি করতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ ফয়সাল হাসানের ডানেডিন ঘুরিয়ে দেখানোর আমন্ত্রণে তাই 'না' করতে পারলাম না। সফরসঙ্গী সাংবাদিক সাইদুজ্জামান ও বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাঈমুর রহমানও খুব আগ্রহী। ফয়সালের গাড়িতে তিনজনেরই বিনে পয়সায় একটা 'গাইডেড ট্যুর হয়ে গেল।
প্রথমেই যে ফয়সাল ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেন, সেটি শুধুই নিজের বিশ্ববিদ্যালয় বলে নয়। দুই হাজার ছাত্রের এই বিশ্ববিদ্যালয়টাও নিউজিল্যান্ডের অন্যতম একটা ল্যান্ডমার্ক। নিউজিল্যান্ডের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যে এটিই। নিউজিল্যান্ডের প্রথম অনেক কিছুই ডানেডিনে। প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র (ডেইলি ওটাগো টাইমস, ১৮৬১), প্রথম গার্লস হাই স্কুল, প্রথম গ্যাসে জ্বালানো রাস্তার বাতি, প্রথম চকলেট ফ্যাক্টরি (ক্যাডবেরি), প্রথম আর্ট গ্যালারি, প্রথম কেবল কার, প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন—সব। নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেলিফোন কলটাও করা হয়েছিল এখান থেকেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পর বোটানিক্যাল গার্ডেনটাও দেখা হলো। ১৮৬৮ সালে উদ্বোধনের সময় কত বড় ছিল কে জানে, এখন এটির আয়তন ২৮ হেক্টর। নিউজিল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা এত লিখেছি যে, আবার তা লিখতে গিয়ে মনে হলো, পাঠক না আবার বাড়াবাড়ি মনে করে বসেন। শুধু এটুকু বলি, পুরো নিউজিল্যান্ড দেশটাকেই যেখানে মাঝেমধ্যে বোটানিক্যাল গার্ডেনের মতো লাগে, অনুমান করে নিন, যেটি সত্যি বোটানিক্যাল গার্ডেন, সেটি কেমন সুন্দর হতে পারে।
পরবর্তী গন্তব্য সিগনাল হিল পয়েন্ট। ডানেডিনের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। সেখানে একটা চাতালমতো করা আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে মোহিত হয়ে গেলাম। পুরো শহরটা যেন মিনিয়েচার হয়ে চোখের সামনে। মাঝখানে আবার ঢুকে পড়েছে নীল প্রশান্ত মহাসাগরের একটা অংশ। দূরে পাহাড়ের ঠিক ওপরে সাদা মেঘের দীর্ঘ একটা লম্বালম্বি আস্তরণ। প্রকৃতির চেয়ে বড় চিত্রশিল্পী বোধহয় আর হয় না।
বল্ডউইন স্ট্রিটে সবার শেষে গিয়ে ভালোই হলো। প্রায় খাড়া উঠে যাওয়া ওই রাস্তার মাথায় ওঠার পর আর কিছু দেখার শক্তি যে অবশিষ্ট থাকল না। রাস্তা দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করার পর সেটিতে ক্ষান্ত দিয়ে পাশে বানিয়ে দেওয়া সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পরও সবার হাঁসফাঁস অবস্থা। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রাস্তা হিসেবে এমনিতেই তো নাম ওঠেনি বল্ডউইন স্ক্রিটের।
বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রাস্তা ঠিক আছে, কিন্তু কতটা খাড়া? তা বোঝাতে 'গ্র্যাডিয়েন্ট-এর মতো প্রকৌশলবিদ্যার টার্ম ব্যবহার করতে হয়। সহজ করে বোঝাতে বলি, প্রতি ২.৮৬ মিটার এগোলে রাস্তাটা এক মিটার উঁচু হয়ে যায়।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে এখানে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে 'বল্ডউইন স্ট্রিট গাটবাস্টার' নামে একটা প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতা আর কিছুই না। রাস্তার নিচ থেকে দৌড়ে ওপরে উঠে আবার নেমে আসা। প্রায় হাজারখানেক প্রতিযোগী হয় প্রতিবছর। ২০০১ সালে মর্মান্তিক একটা দুর্ঘটনাও ঘটেছে এখানে। ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণের কী খেয়াল হলো, শক্ত প্লাস্টিকের একটা বিনের মধ্যে ঢুকে ওই রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে নামবে। নামার সময় পার্ক করা একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে একজনের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু, গুরুতর চোট লাগে অন্যজনের মাথায়।
নামতে নামতে ফয়সালের মুখে ঘটনাটা শুনতে শুনতে মনে হলো, হেঁটে নামতেই এই অবস্থা, ড্রামের মধ্যে গড়িয়ে নামা তো 'মরিবার হলো তার সাধ' ছাড়া আর কিছুই নয়। রাস্তাটা যেখানে এসে খাড়া উঠতে শুরু করেছে, সেখানে ছোট্ট একটা দোকান। পটারি অ্যান্ড সার্টিফিকেট শপ। ভেতরে বল্ডউইন স্ট্রিটের ছবি-সংবলিত সব পটারি সাজানো। ছোট্ট পোস্টকার্ডও। পোস্টকার্ডের দাম এক নিউজিল্যান্ড ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রাস্তায় ওঠার প্রমাণ সার্টিফিকেটের দাম দুই ডলার। দুটিই কিনে ফেললাম। সার্টিফিকেটে নাম লিখে দেওয়া হলো। কয় তারিখে এই 'কীর্তি' গড়া হয়েছিল, সেটিও। দেশে গিয়ে সবাইকে গর্ব করে দেখাব ভাবছি।