পেছন ফিরে তাকাতেই রাজি নন মার্টিন ক্রো
উৎপল শুভ্র
১৭ জুন ২০২১
ব্যাটসম্যান হিসেবে কেমন ছিলেন মার্টিন ক্রো, সে তো কম বেশি সবারই জানা। কিন্তু ব্যক্তি মার্টিন ক্রোকে কজনই বা জানেন! তা কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে। লারা-টেন্ডুলকারের আবির্ভাবের আগে তাঁকে নব্বই দশকের সেরা ব্যাটসম্যান মনে করতেন অনেকেই। ক্রিকেট নিয়ে চিন্তাভাবনাও ছিল বৈপ্লবিক। ২০০১ সালে হ্যামিল্টনে নেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই লেখাটাও যার প্রমাণ।
‘নিজের সময়’ নিয়ে প্রায় সবারই একটা মোহাচ্ছন্ন ভাব থাকে। অবসর নেওয়ার পর ক্রিকেটারদের মধ্যে ব্যাপারটা আরও বেশি। ‘আমার সময়েই সেরা খেলা হতো, এখন তো আর খেলার সেই মানই নেই’—বেশ কবছর খেলা ছেড়েছেন এমন ক্রিকেটারদের মুখে এ ধরনের কথা শুনতে পাওয়াটাই যেন নিয়ম। মার্টিন ক্রো এর ব্যতিক্রম।
এতটাই ব্যতিক্রম যে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলতেই রাজি হলেন না শুরুতে। ‘আমাকে ইন্টারভিউ করে কী হবে, বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলুন, ওরাই তো এখনকার তারকা। আমরা তো ইতিহাস’—সাক্ষাৎকার নিতে চাওয়ায় এই তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত অনেকটা পীড়াপীড়ি করেই রাজি করাতে হলো তাঁকে। সেই সাক্ষাৎকারের শুরুতেই বললেন, ‘আমি কিছু সাবেক খেলোয়াড়কে দেখেছি তারা এখনও তাদের অতীত গৌরবে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এটি ভালো দেখায় না। আমি খেলা ছাড়ার বছরখানেক পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর পেছনে ফিরে তাকাব না। আমি যা খেলেছি, আমি যা করেছি, সেসব অতীতের খাতাতেই থাক। আমি শুধু ভাবতে চাই বর্তমান নিয়ে। বর্তমানে আমি টিভির কমেন্ট্রির সঙ্গে জড়িত, সেটি নিয়েই আমার সব ভাবনা।’
শুধু কমেন্টেটর হিসেবেই টিভির সঙ্গে নেই তিনি, মার্টিন ক্রো স্কাই টিভির নির্বাহী প্রযোজক। তবে সেটি তো আর ক্রিকেটার মার্টিন ক্রোর পরিচয়কে ছাপিয়ে যেতে পারে না। ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৭৭ টি টেস্ট ও ১৪৩টি ওয়ানডে। ৭৭ টেস্টে ১৭ টি সেঞ্চুরিসহ ৪৫.৩৬ গড়ে তাঁর রান ৫৪৪৪। যদিও এই পরিসংখ্যানে ব্যাটসম্যান হিসেবে মার্টিন ক্রোর ‘গ্রেটনেস’ প্রতিফলিত হয় না বলেই ধারণা। আশির দশকে বিশ্ব ক্রিকেটে যখন ‘গ্রেট’ ব্যাটসম্যানের ছড়াছড়ি, তখনও বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে অনেকেই বলতেন মার্টিন ক্রোর নাম। হাঁটুর ইনজুরি বাধা হয়ে না দাঁড়ালে তাঁর রেকর্ডটা আরও উজ্জ্বল হতো, এ নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রসঙ্গ তুলেও বোঝা গেল মার্টিন ক্রো ব্যতিক্রম, ‘হ্যাঁ, হাঁটুর ইনজুরি আমাকে ভালোই ভুগিয়েছে। নইলে হয়তো আমি আরও ভালো করতে পারতাম। তবে আমি ব্যাপারটা দেখি অন্যভাবে। ’৮৪ থেকে ’৯৪ পর্যন্ত মোটামুটি ইনজুরিমুক্তই ছিলাম আমি। আমার সবগুলো সেঞ্চুরিই ওই সময়ে করা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যায়ে এক দশক ওভাবে খেলে যাওয়ার সৌভাগ্যটাই আমি মনে রাখতে চাই, ইনজুরির কারণে কিছু টেস্ট ম্যাচ বা কয়েকটি বছর হারানোর দুভার্গ্য নয়।’
বাবা ডেভিড ক্রো মাত্র তিনটি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেললেও ছেলেদের ক্রিকেটের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন ভালোমতোই। জেফ ক্রো ও মার্টিন ক্রো—তাঁর দুই ছেলেই অধিনায়কত্ব করেছেন নিউজিল্যান্ডের। বড় ভাইকে অনেকটাই ছাড়িয়ে গিয়ে মার্টিন ক্রো পরিণত হয়েছেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানে। সেই ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারের অনেক স্মরণীয় কীর্তির মধ্যে ভিন্ন রকম ঔজ্জ্বল্য ধারণ করে আছে ১৯৯৪ সালে লর্ডসে করা সেঞ্চুরিটা, ‘ইনজুরির কারণে নয় মাস বাইরে থাকার পর ফিরেছিলাম আমি। নিউজিল্যান্ডের ক্যাপ্টেনসি ছেড়েছি, এই পর্যায়ে খেলার মতো সামর্থ্য আর আছে কি না তা নিযেও সংশয় ঢুকে গেছে মনে। অথচ ক্যারিয়ারটা স্মরণীয়ভাবে শেষ করার তীব্র আকুতি তখন আমার মধ্যে। লর্ডসেও আমি ব্যাট করতে নেমেছিলাম হাঁটুতে একটা ব্যান্ডেজমতো পরে। এরপর প্রথম দিনই যখন আমি সেঞ্চুরি করলাম, মাঠের মাঝখানেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। ওই মুহূর্তটির একটি ছবি এখনও আমার কাছে আছে।’
লর্ডসের এই সেঞ্চুরির পাশেই আছে ১৯৯২ বিশ্বকাপ। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে নিউজিল্যান্ডকে সেমিফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন মার্টিন ক্রো। প্রথম ১৫ ওভারের ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার সুযোগ নিতে মার্ক গ্রেটব্যাচকে শুরু থেকেই চালানোর ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া, অফ স্পিনার দীপক প্যাটেলকে দিয়ে বোলিং ওপেন করানো...ওয়ানডে ক্রিকেটকে বদলে দেওয়া সব বৈপ্লবিক উদ্ভাবন মার্টিন ক্রোর মস্তিষ্কপ্রসূতই। কিন্তু পর্যন্ত সেই বিশ্বকাপ আনন্দের চেয়েও বেশি বেদনার স্মৃতি হয়ে থাকে তাঁর জন্য। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি করার পর ইনজুরি আর ফিল্ডিংয়ে নামতে দেয়নি। বাইরে বসে নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি, ‘আমরা লেখা একটি বইয়ে ওই সেমিফাইনালের প্রতিটি মুহূর্তের বর্ণনা আছে। আসলে বদলি অধিনায়ক (জন রাইট) আমাদের ট্যাকটিসটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি।’
নিজে ছিলেন অসাধারণ স্টাইলিশ এক ব্যাটসম্যান। হয়তো এ কারণেই তাঁর পক্ষপাতটা সবসময়ই যাঁদের ব্যাটিং দেখতে ভালো লাগে তাঁদের প্রতি। গ্রেগ চ্যাপেল এ কারণেই প্রিয় ছিলেন, যদিও পরে ভিভ রিচার্ডসের গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁর সময়ের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এই দুজনকেই আলাদা করে রাখেন, আর এখনকার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মার্ক ওয়াহর ব্যাটিং দেখতে টাকা খরচ করতেও রাজি তিনি, অথচ স্টিভ ওয়াহর ব্যাটিং অসহ্য লাগে তাঁর। কারণটা, ওই যে সৌন্দর্যের প্রতি পক্ষপাত। রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটিং দেখতেও পছন্দ করেন, কারণ ‘ও হলো ক্ল্যাসিক্যাল এবং একই সঙ্গে টেকনিক্যাল।’ তবে শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে আর কারও তুলনা করতে রাজি নন মার্টিন ক্রো, স্যার ডনের পর শচীনকেই মনে করেন ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান। এ কথা বলার সময ভিভ রিচার্ডসের কথা ভুলে যাননি, ‘আমার মনে হয় আজ থেকে ১০ বছর পর শচীন যখন ৫০টি টেস্ট সেঞ্চুরি নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করবে, তখন রিচার্ডসের চেয়ে তাকে একটু এগিয়েই রাখতে হবে। যদিও তার দিনে রিচার্ডস হয়তো শচীনের চেয়েও বিধ্বংসী ছিল। আমি বরং এভাবে বলি স্যার ডন, শচীন, রিচার্ডস—এরা তিনজনই ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা তিন ব্যাটসম্যান।’
মার্টিন ক্রোর সময়েরই আরেক ‘গ্রেট’ জাভেদ মিয়াঁদাদ, সুযোগ পেলেই ক্রিকেটের মান নেমে যাওয়া নিয়ে হাহাকার করেন। মার্টিন ক্রো কিন্তু তাঁর দলে যোগ দিতে রাজি নন। খেলোয়াড়দের ধারাবাহিকতা বা মান যদি একটু পড়েও গিয়ে থাকা, সেজন্য অর্থলিপ্সু ক্রিকেট কর্মকর্তাদেরকেই দায়ী করেন মার্টিন ক্রো, ‘খেলোয়াড়দের কী দোষ! এখন যে হারে খেলা হচ্ছে, তাতে কারও পক্ষেই পারফরম্যান্সের একটা নির্দিষ্ট মান ধরে রাখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ওয়ানডের মিছিল তো শুষে নিচ্ছে খেলোয়াড়দের। আমাদের সময়ে আমরা একটা টেস্ট ম্যাচ খেলার আগে বাড়তি সময় পেতাম, নিজেদের সামস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে পারতাম, এখন সেই সুযোগ কোথায়? বতর্মান খেলোয়াড়রাই ওই সময়ে খেললে তাদের পারফরম্যান্স আরও ভালো হতো। আমি যে ওই সময়ে খেলতে পেরেছি, এ জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।’
এই ওয়ানডের আগ্রাসনের একটাই ভালো দিক দেখছেন ক্রো, ‘এখন টেস্ট ক্রিকেট অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাকর হয়ে উঠেছে। ওয়ানডেকে অনেকটাই পেছনে ঠেলে দিয়েছে তা। অথচ এক সময় তো অবস্থাটা উল্টো দাঁড়িয়েছিল।’
হ্যামিল্টন টেস্টের আগে অকল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের চারদিনের ম্যাচটি দেখেছেন। ‘এটুকু দেখে মন্তব্য করা কঠিন’—এ কথা বলার পর দ্রুত উন্নতির জন্য সবচেয়ে বড় করে দেখালেন ‘ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ঘরোয়া ক্রিকেট’কে। অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক সাফল্যের মূল রহস্য হিসেবেও বললেন শক্তিশালী ঘরোয়া ক্রিকেটের কথাই। ডিসেম্বর প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে, তারপরও বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনো নামগন্ধ নেই—এ কথা জানলে মার্টিন ক্রো কী বলতেন, কে জানে!