জীবনই এমন লড়াকু বানিয়েছে ওয়াগনারকে
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
একের পর এক শর্ট বলে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন ব্যাটসম্যানদের, চোখমুখ থেকে ঠিকরে বেরোয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আর জেদ। মাঠের সেই রাগী ফাস্ট বোলার মাঠের বাইরে একেবারেই অন্য রকম! মুখে সব সময় হাসি, কথাবার্তায় দারুণ আন্তরিক। শুধু টেস্টই খেলেন এবং সেটিতে নিউজিল্যান্ডের বোলারদের মধ্যে স্যার রিচার্ড হ্যাডলির পরই সেরা স্ট্রাইক রেট তাঁর। ২০১৯ বাংলাদেশ–নিউজিল্যান্ড সিরিজের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র ক্রাইস্টচার্চে ইন্টারভিউ দিতে বসার আগেই শর্ত দিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর বোলিং ট্যাকটিকস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
প্রথম প্রকাশ: ১৪ মার্চ, ২০১৯। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: একটু পুরোনো দিনের কথা দিয়ে শুরু করি। ২০০৬-০৭ মৌসুমে আপনি দক্ষিণ আফ্রিকা একাডেমির হয়ে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ওই সফরের কথা কি মনে আছে?
নিল ওয়াগনার: অনেক কিছুই। আমার জন্য এটি ছিল ‘মেক অব ব্রেক’ ট্যুর। ওই সময় কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজির (দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক) সঙ্গে চুক্তি ছিল না। বিদেশে আমার প্রথম সফর, উপমহাদেশেও প্রথম। খুবই কঠিন ছিল। বল খুব একটা সুইং করে না। তামিম, মুশফিকদের বিপক্ষে সেবারই প্রথম খেলেছি। ওরা তখনই ভালো ব্যাটসম্যান। সাফল্য বিবেচনায় ওই সফরটা আমার ভালো যায়নি। তবে অনেক কিছু শিখেছিলাম। কোচিং স্টাফরা আমাকে বলেছিলেন, তুমি নিজেকে কতটা নিংড়ে দিতে পারো, সেটি দেখে নিজেই চমকে যাবে। সেই শিক্ষাটা পরেও কাজে লেগেছে।
শুভ্র: দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে দুটি টেস্টে আপনি বদলি ফিল্ডার হিসেবে নেমেছিলেন। তার মানে আপনার ওপর নির্বাচকদের নজর ছিল। তারপরও দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে আসার ঝুঁকিটা কেন নিয়েছিলেন?
ওয়াগনার: আমি তখন খেলার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম, কিন্তু সেভাবে সুযোগ পাচ্ছিলাম না। টেস্ট ক্রিকেট, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে চাচ্ছিলাম, বিশ্বকাপে খেলতে চাচ্ছিলাম। বয়স কম ছিল, তাই আবেগে বাঁধ দিতে পারতাম না। এ সময়ই নিউজিল্যান্ডে আসার সুযোগ এল। আমার বাবা বললেন, ‘যদি বিদেশে সুযোগ আসে আর এখানে তেমন সুযোগ দেখতে না পাও, তাহলে সেটা নেওয়া উচিত। তোমার একটা স্বপ্ন আছে, সেটাকে তাড়া করো।’ আমি সেটাই করেছি। শুধু আমি জানি, সে জন্য আমাকে কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। শুধু পরিবার ছেড়ে আসাই নয়; কী হবে, সেটাও তো জানতাম না।
শুভ্র: নিউজিল্যান্ড কেন? দক্ষিণ আফ্রিকানরা তো এমন পরিস্থিতিতে পড়লে সাধারণত ইংল্যান্ডে যায়...
ওয়াগনার: কৈশোরে আমি রাগবির খুব ভক্ত ছিলাম। ক্রুসেডারসের (ক্রাইস্টচার্চের রাগবি দল) সমর্থক ছিলাম। অল ব্ল্যাকসকে অনেক ভালো লাগত, হাকা ভালো লাগত। ওদের প্যাশন ভালো লাগত, ওরা যা করত সবই। নিউজিল্যান্ডের স্পোর্টস আমাকে খুব টানত। যুক্তরাজ্যে গ্র্যান্ট এলিয়টের মতো আরও কয়েকজন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটার নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে আমাকে ভালো ভালো কথা বলেছিল। নিউজিল্যান্ডই ছিল আমার শেষ সুযোগ, আমাকে সফল হতেই হতো। সেটাও নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। জানতাম, সফল হতে গেলে আমাকে নিউজিল্যান্ডে মানিয়ে নিতে হবে, এর সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। এখানকার সবকিছুকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। নিউজিল্যান্ড আমাকে যেভাবে বরণ করে নিয়েছে, সেটা অনেক দারুণ ছিল।
শুভ্র: নিউজিল্যান্ডে খেলার সুযোগ পেতে আপনাকে চার বছরেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে। যখন ডাক পেয়েছিলেন, সেই মুহূর্তটার কথা মনে আছে?
ওয়াগনার: অবশ্যই। সে বছর ঘরোয়া মৌসুমটা খুব ভালো কেটেছিল। ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ায় মৌসুম শেষেই আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গেছি। কয়েক দিন পর নিউজিল্যান্ডের এক নির্বাচক ফোন করে বললেন, ‘তুমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাচ্ছ।’ তখন মধ্যরাত, আমার বাবা-মা আমার রুমের দরজায় এলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তোমার সব ত্যাগ, সব কঠোর পরিশ্রমের ফল মিলেছে।’ আমার জন্য অনেক গর্বের ও তৃপ্তির মুহূর্ত ছিল সেটি।
শুভ্র: আপনার বোলিংয়ের ধরনটা একটু আলাদা। এভাবে লম্বা সময় ধরে একই জায়গায় শর্ট বল করে যাওয়া...কাউকে দেখে এমন শিখেছেন, না নিজে নিজেই?
ওয়াগনার: যখন ছোট ছিলাম, অ্যালান ডোনাল্ডের বোলিং দেখতাম। মাইকেল আথারটনের বিপক্ষে তাঁর আগুনঝরা বোলিং দেখেছি। রিকি পন্টিংয়ের বিপক্ষে। উইকেটে অনেক জোরে বলটা ঠুকতেন, বাউন্সারও দিতেন। তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখায়ও তিনি সব সময় পিচে জোরে বল ফেলার কথা বলেছিলেন। আমিও সেটাই করার চেষ্টা করি। পরে ব্রেট লিকে দেখেছি। আমি ছোটখাটো গড়নের হওয়ায় এমন বোলিং করতে সুবিধা হয়।
শুভ্র: সেদিনই বলছিলেন, টানা শর্ট বোলিং করতে শরীরের ওপর কেমন ধকল যায়। একটা টেস্টের ধকল সামলে উঠতে কদিন লাগে আপনার?
ওয়াগনার: সাধারণত দুই দিন। টেস্টের পরের দিন হয়তো পুরোটাই বিশ্রামে থাকি, পরের দিন থেকে একটু-আধটু নড়াচড়া শুরু করি। এখানেও আমি রাগবির উদাহরণ দেব। রিচি ম্যাককয়ের (নিউজিল্যান্ড রাগবি দলের সাবেক অধিনায়ক) মতো অনেককে দেখেছি, ভাঙা হাত নিয়েই খেলে গেছে, শরীরের কোথাও কেটে গেছে, তা নিয়েই খেলে গেছে। টিভিতে ওসব দেখে নিজেও সে রকম কিছু করার প্রেরণা পেয়েছি। মনে হয়েছে, ওরা পারলে আমি কেন এমন করতে পারব না!
শুভ্র: তা তো পারছেনই। আপনার ডান হাতের দুটি আঙুল এখনো এক সাথে বাঁধা দেখছি। ওয়েলিংটন টেস্টে এই চোট পাওয়ার পরও খেলে গেছেন। ২০১৬ সালে এই ক্রাইস্টচার্চে তো যে হাতে বোলিং করেন, সেই বাঁ হাতের অনামিকা ভেঙে যাওয়ার পরও বোলিং করে ওই ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। কীভাবে পারেন এসব?
ওয়াগনার: ওই যে বললাম, অন্য খেলাতে বিশেষ করে রাগবিতে এমন অনেক দেখেছি। ভাঙা হাত নিয়ে, রক্তাক্ত মুখ নিয়ে কেউ খেলে যাচ্ছে। ওটাই আমাকে ব্যথা সহ্য করে, শরীরের সমস্যা অগ্রাহ্য করে খেলে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। আমি যেমন ওদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি, আমি চাই, আমাকে দেখেও এমন কিছু করার অনুপ্রেরণা পাক শিশু-কিশোরেরা।
শুভ্র: মাঠে আপনার সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন একটা আগুন ফুটে বেরোয়। শুধু বোলিংয়ের ধরনে নয়। ব্যাটসম্যানদের দিকে সুবচন বর্ষণ, টিটকারির হাততালি...এসব যতটা নিউজিল্যান্ডের, তার চেয়ে বেশি দক্ষিণ আফ্রিকার। তাই না?
ওয়াগনার: আমি এভাবে বলব না যে, এটা নিউজিল্যান্ডের চেয়ে বেশি দক্ষিণ আফ্রিকার...
শুভ্র: নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষায় বা মাঠে কথাবার্তায় তো এমন যুদ্ধংদেহী ভাব থাকে না...
ওয়াগনার: সেটা ঠিক। আমার মনে হয়, যেখানে জন্মেছি, সেটার একটা প্রভাব তো থাকবেই। এর সঙ্গে আপনি কিসের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন, সেটিরও প্রভাব থাকে। জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে, লড়াই করে বেড়ে উঠলে আপনি একচুলও ছাড় দিতে চাইবেন না। এখানে আসতে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে, সেটা মনে থাকলেই ওই আবেগটা বেরিয়ে আসে। আমার ক্ষেত্রে বলব, ওই লড়াইগুলো আমার অনেক পছন্দ। ম্যাচের পর ওই খেলোয়াড়ের সঙ্গে হয়তো কথা হলো, তখন ম্যাচের ওই ঘটনা নিয়েই হাসাহাসি করি আমরা।
শুভ্র: আপনি তো গালাগালি করেন না বলেই জানি। শুধু ব্যাটসম্যানকে খোঁচান, কড়া ভাষায় বললে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করেন, তাই না?
ওয়াগনার: হ্যাঁ, মজার খোঁচাখুঁচি। তামিমের সঙ্গে যেমন। এটা শুরু হয়েছে সেই ২০০৬ সালে। তামিমকে আমি অনেক সম্মান করি, দারুণ ব্যাটসম্যান। ওর বিপক্ষে খেলাটা অনেক উপভোগ করি। ওকে বল করা সব সময়ই কঠিন। আর আমাদের মধ্যে যেসব কথা হয়, সেগুলো খুব মজার। যখনই আমাদের দেখা হয়, সেসব নিয়ে হাসাহাসি হয়। ডেল স্টেইনের সঙ্গেও এমন অনেক লড়াই হয়েছে আমার। ও আমার ভালো বন্ধু। পরে দেখা হওয়ার পর এসব নিয়ে কথা বলা, হাসাহাসি করা.. খেলাটার এই দিকটাও আমার অনেক ভালো লাগে।
শুভ্র: এটা কি আপনার সহজাত? নাকি নিজেকে যেন আরও আক্রমণাত্মক মনে হয়, সে জন্য এসব করেন?
ওয়াগনার: সহজাতই বলব।
শুভ্র: মাঠে আপনি যেভাবে নিজেকে উজাড় করে দেন, সেটিও কি সাফল্য না পেলে অমন প্রতিক্রিয়ার একটি কারণ?
ওয়াগনার: হানড্রেড পার্সেন্ট।
শুভ্র: পুরোটা মিলিয়ে যে প্যাকেজটা হয়, সেটির কোনো আদর্শ কি ছিল সামনে?
ওয়াগনার: নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। অনেককে দেখেই তো শিখেছি। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ একজন। ডোনাল্ডের কথা তো আগেই বলেছি। ব্রেট লির অনেক প্যাশন, অনেক আগ্রাসন ছিল। তাঁর বোলিং দেখতে ভালো লাগত, দেখাও হয়েছে, বিপক্ষেও খেলেছি। দারুণ মানুষ। মাঠের বাইরে এত বন্ধুভাবাপন্ন, এত আন্তরিক! দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৩ বিশ্বকাপে নিজে আমার গাড়িতে ক্রিকেট ব্যাগ উঠিয়ে দিয়েছেন। আমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেছেন। মাঠে এমন আক্রমণাত্মক, কিন্তু মাঠের বাইরে কী অমায়িক!
শুভ্র: আপনি যে ধরনের বোলিং করেন, তাতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অভ্যস্ত নয় বলে কি এই সিরিজে আপনার কাজটা তুলনামূলক সহজ হয়েছে?
ওয়াগনার: কেন এ কথা বলছেন, বুঝতে পারছি না। বাংলাদেশিরাও অনেক কঠিন। বেশ কয়েকজনই তো বেশ ভালো ব্যাটিং করেছে। হ্যাঁ, ওরা এই কন্ডিশনে অভ্যস্ত নয়। এখানে যেভাবে আউট হয়েছে, বাংলাদেশে সেভাবে আউট হবে না। এখানে প্রথমবার এসে ব্যাটিং করা কঠিনই। যারা এখানে আগেও এসেছে, তাদের ব্যাটিং ভালো হয়েছে, অভিজ্ঞতাটা বোঝা গেছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান ভালো ব্যাটিং করেছে, দ্রুত রান তুলেছে। দ্রুত রান তোলা মানেই কিন্তু বোলারের ওপর চাপ।
শুভ্র: এই সিরিজে সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ, তামিমের সঙ্গে আপনার খণ্ডযুদ্ধের কোনটা বেশি উপভোগ করেছেন?
ওয়াগনার: তামিমই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ ও খুব ভালো বল ছেড়েছে, খেলেছেও ভালো। সর্বশেষ ইনিংসে দ্রুত আউট হয়ে গেছে, কিন্তু এর আগের তিনটি ইনিংসে খুব ভালো খেলেছে। নিজের মান ও অভিজ্ঞতাটা বুঝিয়ে দিয়েছে। দলে এমন অভিজ্ঞ খেলোয়াড় থাকলে সুবিধা, প্রথমবার এলে সবকিছু কঠিন লাগবেই।
শুভ্র: আপনার বোলিং নিয়ে বাংলাদেশ দলে চরম অস্বস্তি থাকলেও কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের সংবাদমাধ্যমেই একজন এটিকে ‘অখেলোয়াড়সুলভ’ বলে ধুয়ে দিয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনি কী বলবেন?
ওয়াগনার: কিছুই বলব না। তিনি তাঁর কাজ করছেন। যা ঠিক মনে করেন, লিখেছেন। আমি এ নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি শুধু দলের জন্য সেরাটা দিতে চাই। দল কী চায়, অধিনায়ক আমার কাছে কী চান, সেটাই শুধু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।