`চার-ছক্কা মারাটা আমার সিস্টেমের মধ্যেই আছে`

উৎপল শুভ্র

২৯ এপ্রিল ২০২১

`চার-ছক্কা মারাটা আমার সিস্টেমের মধ্যেই আছে`

সনাৎ জয়াসুরিয়া

ব্যাট হাতে সনাৎ জয়াসুরিয়া কেমন, সেটা ক্রিকেট-বিশ্ব ভালোই জানে। সবচেয়ে ভালো জানেন বোলাররা। তবে মাঠের বাইরের ‘মাতারা হারিকেন’কে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা ব্যাটসম্যান জয়াসুরিয়ার চেয়েও হয়তো এগিয়ে রাখবেন মানুষ জয়াসুরিয়াকে! তারকাসুলভ কোনো অহমিকা নেই, এটা বললেও সব বলা হয় না। সাক্ষাৎকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জরুরি কাজে সময়টা একটু পেছাতে হওয়ায় আর কোন ক্রিকেট সুপারস্টার বারবার দুঃখ প্রকাশ করবেন? আর কোন সুপারস্টার সেই ‘অপরাধবোধে’ আক্রান্ত হয়ে সাক্ষাৎকার দিতে চলে আসবেন সাংবাদিকের হোটেল রুমেই! তাজ সমুদ্র হোটেলের ২২৪ নম্বর রুমে সনাৎ জয়াসুরিয়ার সাক্ষাৎকার নিলেন অভিভূত উৎপল শুভ্র।

প্রথম প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০০৭। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ড আপনার (পরে গেইল আর আফ্রিদি ছাড়িয়ে গেছেন তাঁকে) । টেস্ট ক্রিকেটেও আপনার চেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছেন মাত্র ১১ জন (এখন সংখ্যাটা ২৭) । জয়াসুরিয়া মানেই যেন অনায়াসে ছক্কা মারার প্রদর্শনী। কীভাবে মারেন? 

সনাৎ জয়াসুরিয়া: অনেক চার-ছক্কা মারতে হবে, আমি কখনোই এটা ভেবে মাঠে নামি না। ক্রিজে সেট হয়ে গেলে চার-ছয় তো হবেই, এটা নিয়ে আমাকে কখনোই ভাবতে হয়নি। এই ক্ষমতাটা আমি সহজাতভাবেই পেয়েছি।

শুভ্র: তারপরও ছক্কা মারার বিশেষ একটা টেকনিক তো আছেই। সবাই তো পারে না। টেকনিকটা কী?

জয়াসুরিয়া: ছক্কা মারার টেকনিক বলতে আমি হ্যান্ড অ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশনটাই (চোখ আর হাতের সমন্বয়) বুঝি। চোখ আর হাতের সমন্বয়টা খুব দ্রুত হতে হয়। অন্য অনেক খেলোয়াড়ের চেয়ে আমার হয়তো সেটি দ্রুত, আমি ঠিক বলতে পারব না। একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে। তবে ওই যে বললাম, এটা ন্যাচারাল। 

শুভ্র: আপনার ব্যাটিং টেকনিকের অনেক কিছুই তো ক্রিকেট ব্যাকরণের বাইরে। শুরুতে কোনো কোচ বা কেউ আপনার খেলাটা বদলানোর চেষ্টা করেননি? 

জয়াসুরিয়া: না, কেউই আমাকে আমার খেলা বদলাতে বলেনি। ছোটবেলায় আমি যেভাবে ব্যাট করতাম, এখনো সেভাবেই করি। তবে খেলতে খেলতে ছোট ছোট কিছু জিনিস তো ঠিক করতেই হয়েছে। ব্যাট করতে নেমে শুরুতে কিছু বেসিক জিনিস ঠিকভাবে করা হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখি। এরপর নিজের ন্যাচারাল খেলাটাই খেলি।

শুভ্র: স্কুল ক্রিকেটে বা ঘরোয়া ক্রিকেটে নিশ্চয়ই ছক্কা-টক্কা মেরে অনেক ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়েছেন! 

জয়াসুরিয়া: (হাসি) এমন ঘটনা তো অনেকই আছে। আমার খেলাটা সব সময়ই এ রকম। আমি মেরে খেলি, চার-ছয় মারি, দ্রুত রান তুলি। ইটস্ ইন মাই সিস্টেম। আসলেই এটা আমার সিস্টেমের অংশ।

সনাৎ জয়াসুরিয়া উইকেটে থাকা মানেই ছিল এই দৃশ্যের ফিরে ফিরে আসা। ছবি; গেটি ইমেজেস শুভ্র: ওয়ানডেতে আপনার জয়জয়কারের সময়ও অনেকের মনে সংশয় ছিল, টেস্টে হয়তো আপনার জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। অথচ টেস্টেও সাত হাজারের মতো রান, ট্রিপল সেঞ্চুরি... টেস্টে সাফল্য পাওয়ার ব্যাপারে কি আপনার মনে কখনো সংশয় ছিল?

জয়াসুরিয়া: না, কখনোই না। কারণ আমি যখনই সেট হয়েছি, ফিফটি বা সেঞ্চুরি করে বেরিয়েছি। তাই টেস্টে পারব না, এটা মনে হবে কেন?

শুভ্র: কোনো বোলারকেই তো বোলার মনে করেননি! তারপরও কেউ কি ছিল বা আছে, যাকে মারাটা কঠিন মনে হয়েছে?

জয়াসুরিয়া: ম্যাকগ্রা। ওকে মারাটা কখনোই সহজ ছিল না।

শুভ্র: কোনো বোলারের সঙ্গে বিশেষ কোনো লড়াইয়ের স্মৃতি আছে? 

জয়াসুরিয়া: সেভাবে কেউই আমাকে সমস্যায় ফেলতে পারেনি। ওরা কেউ বললে বলতে পারে, আমি তর্ক করতে যাব না। তবে আপনাকে বলি, কোনো বোলারকেই আমার কখনো কঠিন বলে মনে হয়নি। 

শুভ্র: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৭ বছর হয়ে গেল। বয়স বিবেচনায় নিলে এই মুহূর্তে আপনিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে সিনিয়র। এত দিন ধরে খেলে যাওয়ার রহস্যটা কী? 

জয়াসুরিয়া: রহস্য একটাই, কঠোর পরিশ্রম। এর সঙ্গে খেলাটির প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা। অনেক দিন টিকে থাকতে হলে আপনাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটই আমার ধ্যানজ্ঞান। এর জন্য আমি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। ট্রেনার যা বলে, তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি।

শুভ্র: কী ধরনের ত্যাগ, একটু খুলে বলবেন?

জয়াসুরিয়া: খাওয়া আর ট্রেনিং—এই দুটিই আসল। খেতে খুব পছন্দ করি, এমন অনেক কিছুই অনেক দিনই ছুঁয়েও দেখি না। কোনো দিন এমন হয়, ট্রেনিংয়ে যেতে ইচ্ছে করে না। সেদিনও যেতে হয়। খাওয়ার ব্যাপারে নিয়ম মেনে চলা আর ট্রেনিং—এই দুটিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

একমাত্র গ্নেন ম্যাকগ্রাকে ছক্কা মারতেই একটু সমস্যা হতো জয়াসুরিয়ার

শুভ্র: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম উইকেটটি পাওয়ার পর আপনার মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখেছিলাম, কাল ২৯৬তম ওয়ানডে উইকেটটি পাওয়ার পরও দেখলাম সেই একই রকম। এত বছরেও কিছু বদলায়নি!  

জয়াসুরিয়া: এটাই আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের চাবিকাঠি। আমি সব সময়ই খেলাটিতে মজে থাকি। তা না থাকলে আপনি খেলবেন কী করে? দেশের পক্ষে খেলাটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার, যে ম্যাচই খেলি না কেন, আমি ভালো খেলতে চাই। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, সব কিছুতে অবদান রাখতে চাই। বোলিংয়ে উইকেট পেলে সতীর্থদের সঙ্গে সেই আনন্দ উপভোগ করাটা আমার কাছে এখনো একই রকম রোমাঞ্চের।

শুভ্র: গত বিশ্বকাপের সময় একটা রসিকতা খুব বাজার পেয়েছিল, আপনি নাকি ২০১৯ বিশ্বকাপেও খেলবেন!

জয়াসুরিয়া: (হাসি) কী সব কথা! আমি আসলে এখন একেকটা সিরিজ ধরে চিন্তা করছি। দীর্ঘমেয়াদি কোনো চিন্তাভাবনাই করছি না। একটি করে সিরিজ খেলার পর দেখব কী অবস্থা।

শুভ্র: মাঝখানে অবসর নিয়ে ফেললেন, আবার ফিরে এলেন। এর নেপথ্যের গল্পটা কী?

জয়াসুরিয়া: সে সময়ের নির্বাচক কমিটি ভেবেছিল, আমি ফুরিয়ে গেছি। ওরাই আমাকে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে বাধ্য করেছিল। এর আগে কিছুদিন আমার সময়টা খুব ভালো যাচ্ছিল না। ওই নির্বাচকেরা এটা বুঝতে চায়নি যে, সব ব্যাটসম্যানেরই কখনো না কখনো খারাপ সময় যায়। একটু খারাপ সময় যাওয়ার অর্থই ফুরিয়ে যাওয়া নয়। নতুন নির্বাচক কমিটি আমাকে অবসর থেকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। ফিরে আসার পর ভালোই করছি। আমি তো বলব, গত এক-দেড় বছর আমি আমার সেরা খেলা খেলছি। সবাই যেটাকে আমার সেরা সময় বলে জানে, সেই ১৯৯৬-৯৭ সালেও আমি এত রান করিনি। 

শুভ্র: আপনি অবাক হননি! এতটা কি আশা করেছিলেন?

জয়াসুরিয়া: এত ভালো করব, তা তো আর জানতাম না। তবে ওই লোকগুলোকে ভুল প্রমাণিত করার একটা তাড়না তো ছিলই। ওদের ভুল প্রমাণ করার একটাই পথ ছিল—পারফরম্যান্স। মুখে কিছু বলে তো আর লাভ নেই। যা বলার ব্যাট দিয়েই বলতে হতো।

শুভ্র: বাধ্য হয়ে অবসর নেওয়ার দিনটি তাহলে নিশ্চয়ই আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃখের দিন ছিল! 

জয়াসুরিয়া: তা তো ছিলই। তবে আমাদের এদিকে এমনই হয়। শুধু তো আমার ক্ষেত্রে হয়নি, অনেক বড় বড় ক্রিকেটারকেও এভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। এমন যে হতে পারে, এটা তাই আমার জানাই ছিল। 

টেস্টের জয়াসুরিয়াও ব্যাটিং করতেন একই স্টাইলে

শুভ্র: ক্রিকেট-পরবর্তী জীবন নিয়ে কিছু ভেবেছেন?

জয়াসুরিয়া: আমি বেশ অনেক দিন একটা ব্যাংকে চাকরি করছি। ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। ওরা আমার পুরো ক্যারিয়ারেই অনেক সমর্থন জুগিয়েছে। এখন আমি ওই ব্যাংকের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই চাকরিটা তো থাকছেই। এর সঙ্গে ছোট একটা ব্যবসাও শুরু করেছি। 

শুভ্র: কিসের ব্যবসা?

জয়াসুরিয়া: ছোট একটা কোম্পানি করেছি।

শুভ্র: ব্যবসাটা কিসের, বলতে চাইছেন না কেন, বিজনেস সিক্রেট নাকি?

জয়াসুরিয়া: (হাসি) যদি বলেন, তা-ই। এই মুহূর্তে বলতে চাচ্ছি না। মাত্রই ছোট একটা ব্যবসা শুরু করেছি, এটুকুই জেনে রাখুন। 

শুভ্র: মাতারার জেলেপল্লীর এক তরুণ থেকে বিশ্ব-ক্রিকেটের বড় এক সুপারস্টার, এক দিন হয়তো বিজনেস ম্যাগনেট... আপনার উত্থানের গল্পটা তো রূপকথার মতো!

জয়াসুরিয়া: আমি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে গরিব পরিবারগুলোর একটি থেকে উঠে এসেছি। কলম্বোতে যখন প্রথম খেলতে এলাম, আমার একটা থাকার জায়গাও ছিল না। ক্রিকেট আমাকে সব দিয়েছে। আমাকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে। আমার বাবা-মার জন্য যেদিন একটা ভালো বাড়ি বানিয়ে দিলাম, সেটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত।

শুভ্র: ক্রিকেটে এত সব অর্জনের মধ্যে কোনটি নিয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি গর্বিত?

জয়াসুরিয়া: বেশ কিছু ইনিংস আছে, যা খেলতে পেরে আমি গর্ব অনুভব করি। তবে সবার আগে থাকবে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়। এটির সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। এবারের বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলাটাও দারুণ ব্যাপার। ফাইনালে হারার পরও আমাদের জয়ীর অনুভূতি হয়েছিল। কারণ আমার মতে, এবার আমরা ’৯৬ বিশ্বকাপের চেয়েও ভালো ক্রিকেট খেলেছি। সেমিফাইনালে উঠতে এবার অনেক বেশি ম্যাচ জিততে হয়েছে। দারুণ ক্রিকেট খেলে আমরা ফাইনালে উঠেছি।

টিভি থেকে নেওয়া ছবি বলে ঝাপসা দেখাচ্ছে। তারপরও তা দিতে হচ্ছে শারজার জয়াসুরিয়ার ১৮৯ রানের সেই ইনিংসের ছবি একটা দেওয়াটা কর্তব্য বলে

শুভ্র: এত সব স্মরণীয় ইনিংসের মধ্যে আপনার চোখে সেরা কোনটি?

জয়াসুরিয়া: একটি বেছে নেওয়া কঠিন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি (১৯৯৮ সালে ওভালে), ভারতের বিপক্ষে ওই ৩৪০ (১৯৯৭ সালে প্রেমাদাসায়)। গত বছর নিউজিল্যান্ডে একটি ইনিংস খেলেছি, ২৮০ চেজ করতে হতো, আমি ৮০ বলে ১২৫ করেছি। এটি আমার অন্যতম সেরা ইনিংস। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিডনিতে দারুণ চাপের মধ্যে দুটি সেঞ্চুরি। ভারতের বিপক্ষে মুম্বাইয়ে দেড় শ রানের ইনিংসটিও খুব স্মরণীয়। শারজায় ভারতের বিপক্ষে ১৮৯।

শুভ্র: সেদিন তো সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ রানের রেকর্ডটি ভেঙে দেবেন বলেই মনে হচ্ছিল। মনে আছে, আমাদের পত্রিকার প্রথম পাতায় সেদিন একটা লেখা লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল: একটুর জন্য!

জয়াসুরিয়া: (হাসি) হ্যাঁ, সেদিন আমার রেকর্ডটা ভাঙা উচিত ছিল।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×