সে সময়ের বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর একান্ত সাক্ষাৎকার
`টার্গেট ২০০০ সালের মধ্যেই টেস্ট স্ট্যাটাস`
আইসিসি ট্রফি ১৯৯৭
উৎপল শুভ্র
১২ এপ্রিল ২০২১
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব নেওয়ার পর এসিসি ট্রফি ও আইসিসি ট্রফি জয়কে প্রথম দুটি লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করেছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী। সেই দুটি লক্ষ্যই অর্জিত হয়েছে। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য তাঁর বাড়িতে ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে জানলাম, এরই মধ্যে নতুন লক্ষ্যও ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু ২০০০ সালের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার কথা যখন বলেছিলেন, তখন তা রীতিমতো অবাস্তব মনে হয়েছিল। এত বছর পর ইন্টারভিউটা আবার প্রকাশ করার একটা কারণ তো অবশ্যই এটা যে, তাঁর অনেক কথা এখনো প্রাসঙ্গিক।
প্রথম প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ১৯৯৭। ভোরের কাগজ।
উৎপল শুভ্র: বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে দারুণ শুরু হলো আপনার। এসিসি ট্রফির পর আইসিসি ট্রফি জিতল বাংলাদেশ।
সাবের হোসেন চৌধুরী: এটি তো প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার একার কৃতিত্ব নয়। এটা পুরো বোর্ডেরই কৃতিত্ব। আমাদের এটাই লক্ষ্য ছিল। প্রথম লক্ষ্য ছিল এসিসি, এরপর আইসিসি ট্রফি। আমরা চাচ্ছিলাম, এই দুটি টুর্নামেন্টের সাফল্যকে ভিত্তি করে আসল লক্ষ্য ওয়ানডে স্ট্যাটাস ও টেস্ট স্ট্যাটাসের দিকে এগিয়ে যেতে। সেটা হওয়ায় আমরা অবশ্যই খুব খুশি।
শুভ্র: বাংলাদেশের ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়া তো এখন নিশ্চিতই বলা যায়।
সাবের হোসেন: আসলে শুধু ওয়ানডে স্ট্যাটাস দেওয়ার ব্যাপারে আইসিসি এখনও কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এটা আইসিসির ডেভেলপমেন্ট কমিটির একটি সুপারিশ। আগামী জুনে আইসিসির মিটিংয়ে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। সে সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলে বাংলাদেশের ওয়ানডে স্ট্যাটাস না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার ধারণা, ওয়ানডে স্ট্যাটাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে আপাতত বাংলাদেশ এবং কেনিয়া তা পাবে।
শুভ্র: ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেলে তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য তা হবে বিশাল এক টার্নিং পয়েন্ট।
সাবের হোসেন: তা তো হবেই। ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার পর আমরা শুধু একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলতে পারব তা নয়, ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলারও অধিকার পাব। আমরা যদি পাকিস্তানে গিয়ে লাহোরের সঙ্গে খেলি বা ভারতে গিয়ে হায়দরাবাদের সঙ্গে তিনদিন বা চারদিনের ম্যাচ খেলি, তাহলে তা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ হিসেবে গণ্য হবে। এটা আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেলে সবচেয়ে বড় উপকার হবে এটাই।
শুভ্র: বাংলাদেশ তো টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদনই করেছে। কিন্তু এখনই নিশ্চয়ই তা পাওয়া হবে না। কত সালের মধ্যে তা পাওয়ার আশা করছেন আপনি?
সাবের হোসেন: আমার টার্গেট হচ্ছে ২০০০ সাল। আমি মনে করি, এর মধ্যেই এটা পেতে হবে এবং পাওয়া উচিতও। আমরা ধারণা, আইসিসির মিটিংয়ে আমাদেরকে বলা হবে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে। তখন আমাদের যুক্তি হবে, এই পাঁচ বছরে আমরা আর কী দেখাব? আমাদের দেশে ক্রিকেটের অবকাঠামো, দর্শক সমর্থন, কোচিং বা ট্রেনিং সিস্টেম এখন যা আছে, তার চেয়ে খুব বেশি বদল তো আমরা দেখাতে পারব না। আমাদের এখন প্রয়োজন এক্সপোজার, টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোর সঙ্গে নিয়মিত খেলার সুযোগ। সে জন্য টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার বিকল্প নেই। শ্রীলঙ্কা বা জিম্বাবুয়ের উদাহরণ দেব আমরা। ওরাও তো খুব সাধারণভাবে শুরু করেছিল, অথচ এখন ওরা অনেক ওপরে উঠে গেছে। তাছাড়া আমাদের সবচেয়ে বড় দাবি হবে, আমরা বেস্ট অব দ্য রেস্ট। আমরা এসিসি ট্রফি জিতেছি, আইসিসি ট্রফি জিতেছি, গত বিশ্বকাপে যে তিনটি সহযোগী সদস্য দেশ খেলেছে, সেই কেনিয়া, হল্যান্ড ও আমিরাত তিনটিকেই আমরা হারিয়েছি। তাই টেস্ট পরিবারের বাইরের দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সেরা। ক্রিকেটকে যদি গ্লোবালাইজ করতে হয়, তাহলে আরও দেশকে টেস্ট পর্যায়ে তুলে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরাই এর যোগ্যতম দাবিদার।
শুভ্র: কিন্তু আপনি কি সত্যিই মনে করেন, টেস্ট পর্যায়ে খেলার মতো সামর্থ্য আমাদের আছে?
সাবের হোসেন: আমার বিশ্বাস, ২০০০ সালের মধ্যে আমরা একটা পর্যায়ে যেতে পারব। আর একটা টার্গেট আমরা এখনই ঠিক করে ফেলতে চাই। তা হলো ২০০৮ সালের বিশ্বকাপে (তখন ২০০৮ সালেই বিশ্বকাপ হওয়ার কথা ছিল) শিরোপার দাবিদার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। এরকম কোনো লক্ষ্য ঠিক না করলে আপনি এগোতে পারবেন না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বলেছি, এসিসি ও আইসিসি ট্রফি জয়, এরপর ওয়ানডে ও টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া হবে আমাদের লক্ষ্য। এখন ২০০০ সালের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া এবং ২০০৮ সালের বিশ্বকাপে শিরোপার দাবিদার হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে আমাদের।
শুভ্র: সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নতুন পরিকল্পনা করা হয়েছে?
সাবের হোসেন: পরিকল্পনা আমরা তৈরি করছি। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের এখনই চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে হবে। যে দলটা আমাদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, সেই দলের সকল সদস্য তো বিশ্বকাপে থাকবে না, বয়সের কারণে থাকতে পারবে না। তাই নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেটা চাইব, তা হলো আন্ডার থার্টিন ও আন্ডার টুয়েলভ লেভেল থেকে ২৫ বা ৩০ জনের একটা স্কোয়াড যদি আমরা তৈরি করতে পারি। জাতীয় দলের পাশাপাশি এদের দায়িত্ব বিসিবিকে দিয়ে দিলে আমরা বিশ্বাস, পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্যে গ্রিনিজ একটা টেস্ট দলের নিউক্লিয়াস তৈরি করে দিতে পারবেন।
শুভ্র: তার মানে তো গ্রিনিজের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে। নইলে তিনি পাঁচ বছর থেকে আট বছর কাজ করবেন কীভাবে?
সাবের হোসেন: প্রাথমিকভাবে গ্রিনিজের সঙ্গে আমাদের তিন বছরের চুক্তি হয়েছে। তবে চুক্তিতে বলা আছে, তিন বছর পর যদি এটাকে আরও বাড়াতে চাই, তাহলে নতুনভাবে আলোচনা করে তা বাড়ানো যেতে পারে। সেই সুযোগ তো আছেই।
শুভ্র: এখন পর্যন্ত যা দেখেছেন, তাতে কোচ হিসেবে গ্রিনিজকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি?
সাবের হোসেন: কোচ হিসেবে গ্রিনিজের টেকনিক্যাল দিক নিয়ে কথা বলার মতো যোগ্যতা আমার নেই। তবে ব্যক্তি হিসেবে, অ্যাজ এ হিউম্যান বিইং, আমার মনে হয় না, এর চেয়ে ভালো কাউকে আমরা নিতে পারতাম। অনেকেই কিন্তু আপনাকে বলবেন, ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে আমাদের যে দলটা ছিল, প্লেয়ার টু প্লেয়ার বিবেচনা করলে সেটি ছিল এবারের দলের চেয়েও ভালো। গ্রিনিজ মূলত যা করেছেন, তা হলো ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্টগুলোকে একটা টিম পারফরম্যান্সে নিয়ে এসেছেন। এটা তো অবশ্যই তাঁর বিরাট একটা অবদান। এ থেকেই প্রমাণ হয়, গ্রিনিজ কত উঁচুমানের কোচ। আরেকটা ব্যাপার, কোচ কিন্তু শুধু প্রশিক্ষক নন। কখনও তাঁকে খেলোয়াড়দের বন্ধু হিসেবেও কাজ করতে হয়। গ্রিনিজ সেটাই করেছেন। কখনও তিনি খেলোয়াড়দের বন্ধু, আবার যখন প্রয়োজন, কঠিন কথাও বলেছেন তিনি। সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, খেলোয়াড়েরা তাতে রেসপন্স করেছে।
শুভ্র: ম্যানেজার হিসেবে গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর মেয়াদ তো ছিল আইসিসি ট্রফি পর্যন্তই। আইসিসি ট্রফির অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মনে হয়েছে, বাংলাদেশের সাফল্যে এই গ্রিনিজ-লিপু টিমওয়ার্কের অবদান অনেক। এই টিমটা কি থাকবে?
সাবের হোসেন: ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই যে, এই টিমটা থাকুক। লিপুর ব্যাপারে এর আগেও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, মিনিমাম একটা সময়ের জন্য তাঁকে ম্যানেজার রাখা হবে। এর আগে একেকটা ট্যুর আসত, আমরা একেকজনকে ম্যানেজার বানাতাম। আমি এখনও চাই, গ্রিনিজ-লিপু টিমটা থাকুক। তবে এ ব্যাপারে লিপুর সঙ্গে আলাদাভাবে আলাপ করতে হবে। কারণ তাঁরও একটা ব্যবসায়িক জীবন আছে, তাঁরও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। তিনি কতটা সময় দিতে পারবেন, তা জানতে হবে। কারণ এখন সবকিছুই হবে ফুল-টাইম, পার্ট-টাইমের দিন শেষ। আগে যদি আমরা ফোর্থ গিয়ারে চলে থাকি, এখন চলে যেতে হবে ফিফথ গিয়ারে। তাই শুধু গ্রিনিজ-লিপু নয়, আরও অনেক কিছু নিয়েই আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। বোর্ড নিয়ে চিন্তা করতে হবে, বোর্ডের স্ট্রাকচার বদলাতে হবে কিনা, ভাবতে হবে তা। আরেকটি জিনিস আমরা করতে চাচ্ছি, সবগুলো বিভাগে ক্রিকেটের জন্য একটা বিভাগীয় বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটা খুব জরুরি। কারণ বর্তমানে আমরা ঢাকার বাইরে ক্রিকেটের জন্য জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোর কাছে যাই, কিন্তু ডিএসএগুলোকে তো ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবল ও অন্য সব খেলা চালাতে হয়। তাই আমরা চাইছি, শুধু ক্রিকেটের জন্য নিবেদিত বিভাগীয় বোর্ড, যেগুলোকে আমরা সর্বোতভাবে সাহায্য করব। এ রকম আরও অনেক পরিকল্পনা আছে।
আরেকটি ব্যাপার যা আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি, তা হলো ক্রিকেটের জন্য আমরা একটা ট্রাস্ট গঠন করার সুপারিশ করব সরকারের কাছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। বিশ্বকাপ পর্যায়ে নিজেদের ধরে রাখতে হলে এবং টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তা শুধু সরকারের পক্ষে যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমাদের মতো গরিব দেশে আরও অনেক খাতই আছে, যেগুলো অগ্রাধিকার পাবে। তাই আমরা চাচ্ছি, আলাদা একটি ট্রাস্ট গঠন করতে, যে ট্রাস্ট থেকে আনা ফান্ড শুধু ক্রিকেটের উন্নয়নেই ব্যয় হবে।
শুভ্র: ঘরোয়া ক্রিকেটে কি কোনো পরিবর্তন আসছে এবার?
সাবের হোসেন: হ্যাঁ, এবার পরিবর্তন হবে। গত দুই বছর ধরেই ৮০ ওভারের ম্যাচ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নানা কারণে তা করা যায়নি। এবার যেভাবেই হোক, আমরা তা করব। এর সঙ্গে জাতীয় ক্রিকেটেদুই দিনের/তিন দিনের ম্যাচ হবে। চারটি বা পাঁচটি দল নিয়ে দীর্ঘ সময়ের ম্যাচের আরেকটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের কথাও ভাবা হচ্ছে। এবার থেকে দুদিন এবং তিন দিনের ম্যাচের ওপর জোর দিতে যাচ্ছি। কারণ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেলে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচগুলো তো আমাদেরকে খেলতে হবে।
শুভ্র: ঢাকা স্টেডিয়ামের অধিকার পাওয়াটা তো ক্রিকেটার জন্য বিরাট একটা সুসংবাদ।
সাবের হোসেন: অবশ্যই। আমাদের সকলেরই অনেকদিনের প্রত্যাশা ছিল এটি। প্রধানমন্ত্রী চিন্তা-ভাবনা করে নিজেই কিন্তু এ ব্যাপারে উদ্যেগ নিয়েছেন। আমাকে এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, আসলেই ঢাকা স্টেডিয়াম ক্রিকেটের জন্য প্রয়োজন। তবে একই সঙ্গে আমরা চাইব মগবাজারে ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি যেন খুব তাড়াতাড়ি তৈরি করা হয়। কারণ, আমরা ওখানে ইনডোর ট্রেনিং সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে ওপরে কাভার দেওয়া যায় কিনা, তা নিয়ে ভাবছি। তাহলে সারা বছরই আমরা খেলতে পারব। এর সঙ্গে একটা ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা আছে, তা করতে গেলে পূর্ণাঙ্গ একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম একান্ত প্রয়োজন। তাই ঢাকা স্টেডিয়াম পেলেও আমরা কিন্তু চাই, মগবাজারের ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি তাড়াতাড়ি নির্মাণ করা হোক।
শুভ্র: ঢাকা স্টেডিয়াম সারা বছর কীভাবে ব্যবহার করবেন?
সাবের হোসেন: এখানে দুটো ব্যাপার আছে। একটা হচ্ছে পিচের ব্যাপার। এখন তো আমাদেরকে সিনথেটিক টার্ফের কথা ভুলে যেতে হবে, আমরা এখন ন্যাচারাল উইকেটে খেলব। এতদিন কিন্তু আমরা উইকেট নিয়ে সেভাবে চিন্তা-ভাবনা করিনি। আপনি জানেন, ভালো উইকেট তৈরি করার কোনো ম্যাজিক ফর্মুলা নেই। এটা ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতিতেই করতে হয়। আমাদেরকে এখন মাটি পরীক্ষা করতে হবে। বাইরে থেকে এক্সপার্ট আনতে হবে। আমরা দুজনকে ভারতে পাঠাচ্ছি, উইকেট নিয়ে ভারতীয় বোর্ড আয়োজিত একটা সেমিনারে যোগ দিতে। ভালো উইকেট তৈরি করা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, এটির কাজ তো চলবেই। বাকিটা হচ্ছে প্র্যাকটিস। ঢাকা স্টেডিয়াম কিন্তু মূলত ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে এটি। তাই আন্তর্জাতিক মানের আদর্শ মাপের একটি মাঠে নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে পারাটা হবে দারুণ ব্যাপার।
"বিভাগীয় বোর্ডের যে চিন্তা-ভাবনা আছে, তাতে করে খেলাটা এমনিতেই তাবৎ দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এখন যেমন সব ঢাকা-কেন্দ্রিক খেলা হচ্ছে, তখন তা হবে না। প্রতিটি বিভাগীয় বোর্ডের অধীনে তখন খেলা হবে। প্রতিটি বিভাগ আলাদা টুর্নামেন্ট আয়োজন করলে বিভিন্ন জেলার খেলোয়াড়দের জাতীয় দৃশ্যপটে উঠে আসার সুযোগ তৈরি হবে।"
শুভ্র: বর্তমানে আমাদের দেশে পুরো খেলাটাই ক্লাবভিত্তিক। কিন্তু অনেকেরই ধারণা, মূল প্রতিযোগিতা অঞ্চল ভিত্তিতে হলে নতুন খেলোয়াড়ে বেরোনোর সুযোগ আরও বেশি থাকত। সেক্ষেত্রে জাতীয় ক্রিকেটকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কোনো পরিকল্পনা কী আছে?
সাবের হোসেন: একটা ব্যাপার কিন্তু ঠিক, আজ আমরা যে পর্যায়ে এসেছি তাতে ক্লাবগুলোর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। এককভাবে কাউকে কৃতিত্ব দিতে হলে ক্লাবগুলোকেই দিতে হবে। কারণ সরকারও সেভাবে এগিয়ে আসেনি, আমাদের সেরকম পরিকল্পনাও ছিল না। আবাহনী, মোহামেডান, বিমান, ব্রাদার্স, কলাবাগান মূলত এদের মতো ক্লাবই কিন্তু আজ ক্রিকেটকে এত দূর নিয়ে এসেছে। তবে বিভাগীয় বোর্ডের যে চিন্তা-ভাবনা আছে, তাতে করে খেলাটা এমনিতেই তাবৎ দেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য এটাই। এখন যেমন সব ঢাকা-কেন্দ্রিক খেলা হচ্ছে, তখন তা হবে না। প্রতিটি বিভাগীয় বোর্ডের অধীনে তখন খেলা হবে। প্রতিটি বিভাগ আলাদা টুর্নামেন্ট আয়োজন করলে বিভিন্ন জেলার খেলোয়াড়দের জাতীয় দৃশ্যপটে উঠে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
শুভ্র: আগামী বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতির একটা ছক নিশ্চয়ই ঠিক করা হয়েছে। সেটা কী জানাবেন?
সাবের হোসেন: আগামী এশিয়া কাপ তো আমাদের জন্য প্রস্তুতির দারুণ একটা সুযোগ। কারণ এই টুর্নামেন্টে আমরা যে তিনটি দেশের সঙ্গে খেলব, তারা কখনো না কখনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিল, শ্রীলঙ্কা তো বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নই। আগামী বিশ্বকাপেও কিন্তু অন্যতম ফেবারিট থাকবে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারত। সার্ক ক্রিকেটকে যেমন আমরা আইসিসি ট্রফির আগে একটা প্রস্তুতিমূলক টুর্নামেন্ট হিসেবে দেখেছিলাম, এশিয়া কাপকেও আমরা সেভাবে দেখব। এখানে হয়তো আমরা কিছু এক্সপেরিমেন্ট করব, কিছু নতুন খেলোয়াড়কে ট্রাই করে দেখব। এরপর আগামী বছর জানুয়ারি মাসে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হবে। দলগুলোর নাম এখনই বলছি না, এটা জুনে আইসিসির মিটিংয়ের পর বলব। এরপর আগামী বছর মে এবং জুন মাসে আমরা ছয় থেকে আট সপ্তাহের একটি ট্যুরে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার চিন্তা করছি। পরের বছর ওই একই সময়ে হবে বিশ্বকাপ, তাই আমরা সেই কন্ডিশনের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর খুব সম্ভব ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাব। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে কী করব, তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে সে বছর ঢাকায় এশিয়া কাপ হওয়ার কথা। আমরা চেষ্টা করব, এশিয়া কাপ জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করতে। বিশ্বকাপ শুরুর তিন/চার সপ্তাহ আগেই আমরা ইংল্যান্ড চলে যাব কয়েকটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে।
শুভ্র: আইসিসি ট্রফি সাফল্যের পর দেশের মানুষের প্রত্যাশা কিন্তু অনেক বেড়ে গেছে। এই প্রত্যাশার চাপটা কি অনুভব করছেন?
সাবের হোসেন: প্রত্যাশা তো বেড়েছেই, সঙ্গে চাপও আছে। তবে আমি একটা ব্যাপারে বলতে চাই। দেখুন, গত সার্ক ক্রিকেটে পাকিস্তানের বিপক্ষে আমাদের প্রথম ম্যাচে যে দর্শক ছিল, বাকি সব ম্যাচ মিলিয়ে হয়তো সেই দর্শক হয়েছিল। আমাদের পারফরম্যান্স খুব ভালো হয়নি, দর্শক তাই মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি আশা করছি, এমন আর হবে না। আমরা কিন্তু বিশ্ব জয় করে ফেলিনি। অনেকে বলছেন, আমরা বিরাট কিছু করে ফেলেছি। কিন্তু আসলে তো আমরা মাত্র যাত্রা শুরু করলাম। এখন আমাদের অনেক সময় খারাপ রেজাল্ট হবে, মন খারাপ করার মতো অনেক কিছু ঘটবে, কিন্তু আমরা যদি বিশ্বাস করি যেম দশ বছর পরে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আমরা এটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই, তহালে সেই দশ বছর পরের দিকে তাকাতে হবে। মাঝখানে কিন্তু আমদের অনকে হোঁচট খেতে হবে, সেজন্য আমাদের মানসিক প্রস্তুতি থাকা উচিত। আমাদের হতোদ্যম হয়ে পড়লে চলবে না। প্রত্যাশা তো থাকবেই। কারণ জাতীয় পর্যায়ে আনন্দ করার মতো কিছু তো আমরা খুবই পাই। ক্রিকেট তো আপাতত আমাদের তা দিল। তাই বলে সব সময়ই যে রেজাল্ট ভালো হবে, তা তো আর সম্ভব নয়। ভারতেরও এমন হয়েছে, পাকিস্তানেও হয়েছে। আমাদের তাই একটা ম্যাচুরিটি আসতে হবে। আমার মনে হয়, এটাও একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আসবে।