‘আমার শুধু বোলিং করে যেতে ইচ্ছে করে’
উৎপল শুভ্র
৪ এপ্রিল ২০২১
আগের দিন কুন্ডেসালে তাঁর বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। ভাষার প্রতিবন্ধকতা জয় করে কথা বলে এসেছি তাঁর বাবার সঙ্গেও। এটা কাজে লেগেছিল এই ইন্টারভিউটা পাওয়ায়। নইলে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা ট্যুরের শুরু থেকেই ঘুরিয়ে যাচ্ছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে বসে দেওয়া ইন্টারভিউটাতে মুরালি কাটা কাটা উত্তর দিলেও মজাই লেগেছিল কথা বলে।
প্রথম প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০০৭। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: কাল আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করে খুব চমৎকৃৃত হয়েছি। এমন মৃদুভাষী, বিনয়ী... রীতিমতো মাটির মানুষ!
মুত্তিয়া মুরালিধরন: আমরা এ রকমই। ক্যান্ডির সব পরিবারই এমন সাদাসিধে, বাড়তি কোনো শো-শা নেই।
শুভ্র: সেটাই দেখলাম। সর্বকালের সেরা অফ স্পিনার জন্ম দেওয়ার গর্ব-টর্বও কিচ্ছু নেই। উল্টো আপনার কোচ, অর্জুনা রানাতুঙ্গা... এদেরকেই সব কৃতিত্ব দিলেন।
মুরালিধরন: আমার ক্যারিয়ারে তাঁদের অনেক অবদান। আমার প্রথম কোচ আজ এখানে ছিলেন। ছয় বছর বয়স থেকে উনি আমার কোচ। আর আমি যখন শ্রীলঙ্কা দলে আসি, অর্জুনা তখন অধিনায়ক। তাঁর কাছেও আমার অনেক ঋণ।
শুভ্র: টেস্টে ৬৮৮ ও ওয়ানডেতে ৪৩২ উইকেট পাওয়া বোলারকে এখনো ছেলেবেলার কোচের কাছে ফিরে যেতে হয়!
মুরালিধরন: সেটাই তো স্বাভাবিক। অন্য যে কারো চাইতে উনি আমাকে বেশি চেনেন। আমার সম্পর্কে বেশি জানেন।
শুভ্র: এখন পর্যন্ত যা করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট, নাকি কোনো অতৃপ্তি আছে?
মুরালিধরন: খুব সন্তুষ্ট।
শুভ্র: উত্তরগুলো একটু বেশি ছোট হয়ে যাচ্ছে! আপনি এত ভালো কথা বলেন, মাইক্রোফোনের সামনে এমন স্বল্পবাক হয়ে যান কেন?
মুরালিধরন: (হাসি) আর কী বলব! খুবই সন্তুষ্ট। আমার মনে হয় না, আর কারও এমন ক্যারিয়ার আছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমি এখনো খেলছি। দেখা যাক, শেষে কী হয়!
শুভ্র: শেন ওয়ার্নকে মিস করেন? সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ড নিয়ে ওর সঙ্গে লড়াইটা?
মুরালিধরন: ওয়ার্নকে আমি কেন মিস করতে যাব! সে এক দেশের হয়ে খেলেছে, আমি অন্য দেশের হয়ে খেলি। দুজনের কোনো মিল নেই। ওর যেমন অনেক স্মরণীয় পারফরম্যান্স আছে, তেমনি আমারও আছে। ওয়ার্নকে মিস করতে যাব কোন দুঃখে?
শুভ্র: আপনি যেমন সন্দেহাতীতভাবে সর্বকালের সেরা অফ স্পিনার, শেন ওয়ার্নও তেমনি সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার। এই বিভাজন বাদ দিয়ে যদি সর্বকালের সেরা স্পিনার বেছে নিতে হয়...
মুরালিধরন: আমি জানি না। আমি শুধু বুঝি, নির্দিষ্ট দিনে কে কেমন বল করে, এটাই আসল কথা। তবে আমার দেখা সেরা স্পিনার শেন ওয়ার্ন। আমি ওকে নিজের চোখে বছরের পর বছর দুর্দান্ত বোলিং করে যেতে দেখেছি। ও-ই সেরা। আমার সময়ে আরও অনেক ভালো স্পিনার এসেছে। অনিল কুম্বলে খুব ভালো। সাকলায়েন মুশতাক একটা সময় ছিল দুর্দান্ত। হরভজন সিং, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি এরা সবাই গ্রেট স্পিনার। মুশতাক আহমেদের কথাও বলতে হবে। আমার সময়ে বিশ্ব ক্রিকেটে ভালো অনেক স্পিনার ছিল। বিশ্ব ক্রিকেটে গত দু দশক ছিল স্পিনারদেরই জয়জয়কার।
শুভ্র: যে ‘দুসরা’ আপনার বোলিংয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, সেটি তো সাকলায়েন মুশতাকেরই আবিষ্কার।
মুরালিধরন: হ্যাঁ, সাকলায়েনই এটা শুরু করেছিল। ও কীভাবে এটা করে, তা দেখে আমিও তা রপ্ত করেছি।
শুভ্র: শেন ওয়ার্নের রেকর্ড ভাঙতে আর মাত্র ২০টি উইকেট চাই। রেকর্ডটি ভাঙতে কি উন্মুখ হয়ে আছেন?
মুরালিধরন: হ্যাঁ, অবশ্যই। রেকর্ডটা তো আমারই ছিল। কোর্টনি ওয়ালশের রেকর্ডটা চার-পাঁচ বছর টিকে থাকার পর আমিই তা প্রথম ভেঙেছিলাম। এরপর শেন ওয়ার্ন আমাকে ছাড়িয়ে যায়। এখন আবার আমার সুযোগ এসেছে।
আমি দারুণ সব ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বোলিং করেছি। তবে শেষ পর্যন্ত ব্রায়ান লারাকেই এগিয়ে রাখব। স্পিনটা লারা দুর্দান্ত খেলত। আমার তো মনে হয়, স্পিনের বিপক্ষে ও-ই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান।
শুভ্র: ওয়ানডেতেও তো আপনার চেয়ে বেশি উইকেট আছে মাত্র একজনের। ওয়াসিম আকরামের ৫০২ উইকেট আর আপনার ৪৩২। এই রেকর্ডটি ভাঙতে চান না?
মুরালিধরন: ওটা নিয়েও ভাবার কিছু নেই। আমি আগামী বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলব, তত দিনে আমার ৫০০-৬০০ উইকেট তো হয়েই যাবে। আমি টেস্ট-ওয়ানডে দুটিই উপভোগ করি। কাউন্টি ক্রিকেটে খেলছি বলে গত কিছুদিন ওয়ানডেটা একটু কম খেলছি। আগামী বছর থেকে টেস্ট-ওয়ানডে দুটিই আমার একই রকম মনোযোগ পাবে।
শুভ্র: আপনি যাদের বিপক্ষে বোলিং করেছেন, তাঁদের মধ্যে সেরার স্বীকৃতি দেবেন কাকে?
মুরালিধরন: আমি দারুণ সব ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বোলিং করেছি। তবে শেষ পর্যন্ত ব্রায়ান লারাকেই এগিয়ে রাখব। কারণ আমাদের বিপক্ষে এখানে একটা সিরিজে ও অসাধারণ খেলেছিল, ৩ টেস্টে করেছিল প্রায় ৬৯০ রান (২০০১ সালে ৬৮৮ রান)। অবিশ্বাস্য কিছু ইনিংস খেলেছিল ও।
শুভ্র: ওই সিরিজ সম্পর্কে সে সময়ে আপনাদের কোচ ডেভ হোয়াটমোরের কাছে আপনার প্রতিক্রিয়া শুনেছি। আপনি নাকি পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন! ওই সিরিজে লারার ব্যাটিং সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলবেন?
মুরালিধরন: এক কথায় বললে অসাধারণ! স্পিনটা লারা দুর্দান্ত খেলত। আমার তো মনে হয়, স্পিনের বিপক্ষে ও-ই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। তবে ওই সিরিজটা কিন্তু আমরা ৩-০-তে জিতেছিলাম। আমি পেয়েছিলাম ২৮ উইকেট। সেদিক থেকে দুজন সমানে-সমানই ছিলাম বলতে পারেন। তবে ও বোধ হয় দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করেছিল।
শুভ্র: দীর্ঘ সময় শ্রীলঙ্কার বোলিং বলতে মুরালি আর ভাসকেই বোঝাত। এখন আর তা নয়। এটা কি আপনার জন্য ভালো হলো?
মুরালিধরন: এটা তো আমাকে সাহায্যই করছে। আমাদের দলে এখন দারুণ কিছু ফাস্ট বোলার আছে। ভবিষ্যতে আমার ওপর চাপটা তাই অনেক কম থাকবে।
আমার কাজই হলো বোলিং করা। বোলিং করার মতো মজা আমি আর কিছুতেই পাই না। আমি ব্যাটসম্যান নই। আমার তাই শুধু বোলিং করে যেতে ইচ্ছে করে।
শুভ্র: কিন্তু অন্য দিক দিয়ে দেখলে, আপনার তো ক্ষতিই হয়েছে এতে। এখন উইকেট ভাগ হয়ে যাচ্ছে!
মুরালিধরন: (হাসি) ভাগ হওয়াটা তো ভালো! তার পরও আমি প্রতি টেস্টে ৬-৭টি উইকেট পাচ্ছি। দুই ইনিংসে ৬-৭টি উইকেট আমি পাবই। এক টেস্টে ৬-৭ উইকেট তো খারাপ নয়।
শুভ্র: বোলিং করতে কি কখনো আপনার ক্লান্তি আসে না? শুনেছি, আপনার হাত থেকে বল নেওয়া অধিনায়কের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ!
মুরালিধরন: আমার কাজই হলো বোলিং করা। বোলিং করার মতো মজা আমি আর কিছুতেই পাই না। আমি ব্যাটসম্যান নই। আমার তাই শুধু বোলিং করে যেতে ইচ্ছে করে।
শুভ্র: আপনার ক্যারিয়ারে স্মরণীয় পারফরম্যান্সের তো অভাব নেই। যদি এর মধ্যে সেরা পাঁচ বেছে নিতে বলি।
মুরালিধরন: ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওভাল টেস্টে আমি ১৬ উইকেট নিয়েছিলাম। এটিই আমার সেরা। এই ক্যান্ডিতেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমার ইনিংসে ৯ উইকেট আছে। গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নটিংহ্যামে এক ইনিংসে ৮ উইকেটও স্মরণীয়। এর বাইরেও অনেক স্মরণীয় পারফরম্যান্স আছে। তবে আমি এই তিনটিকেই সবচেয়ে এগিয়ে রাখতে চাই।
শুভ্র: সর্বকালের সেরা অফ স্পিনার বলে আপনাকে মেনে নিয়েছে সবাই। আপনি কি মনে করেন, কোনো অফ স্পিনারের আর কিছু দেখানোর আছে?
মুরালিধরন: আমি মনে করি, একজন স্পিনার শুধু দুভাবেই বল করতে পারে। (হাত দিয়ে দেখিয়ে) হয় বল এদিকে টার্ন করবে, নয়তো ওদিকে। অনেকে অনেক কথা বলতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বল ওই দুটিই। কোনো বোলার যদি দুটিই নিখুঁতভাবে করতে পারে, সেটিই ব্যাটসম্যানকে আউট করার জন্য যথেষ্ট।
শুভ্র: তামিল-সিংহলিজ গৃহযুদ্ধের মধ্যে আপনি এক তামিল, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় তারকা। আপনাকে তাই অনেকেই দেখে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। আপনি নিজে কী মনে করেন?
মুরালিধরন: এই ক্যান্ডিতেই আমার জন্ম। আমি সব ধর্ম, সব জাতির মানুষের সঙ্গে মিলেমিশেই বড় হয়েছি। কে হিন্দু, সিংহলিজ, মুসলমান বা খ্রিষ্টান—এসব কখনোই ভাবিনি। আমার কাছে তাই মানুষে মানুষে পার্থক্য নেই। তবে অন্য কোনো জায়গায় অন্য কিছু মানুষের হয়তো অন্য রকম কিছু মনে হয়েছে। সমস্যাটা সেখানেই, আর সেই সমস্যা চলছেই।
শুভ্র: আপনি কি এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারেন না? তামিল টাইগারদের প্রতি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারেন না?
মুরালিধরন: যেভাবে বলছেন, এই সমস্যার সমাধান এত সহজ নয়। আমি মনে করি, এটা সমাধানের দায়িত্ব যারা সরকারে আছে তাঁদের। আমি শুধুই একজন ক্রিকেটার, ক্রিকেট খেলাই আমার কাজ। ক্রিকেট আর রাজনীতি এক নয়। আমি রাজনীতিতে নাক গলাতে চাই না।
শুভ্র: বাংলাদেশ দল সম্পর্কে কী বলবেন? কোনো উন্নতি দেখছেন?
মুরালিধরন: যদি টেস্ট ক্রিকেটের কথা বলেন, একটুও না।
আরও পড়ুন......
• মুরালিধরন ‘জিনিয়াসের’ ব্যাখ্যা খুঁজতে কুন্ডেসালে মুরালিধরনের বাড়িতে
• সবার ওপরে মুরালিধরন
• ক্রিকেটীয় রূপকথা লিখে শেষ মুরালির
• সেই মুরালি এই মুরালি