‘মাতারা হারিকেন’-এর ভেতর-বাহির
উৎপল শুভ্র
২ এপ্রিল ২০২১
এক ইনিংসে ১১ ছক্কা মারার কীর্তি গড়েছিলেন ২৫ বছর আগে এই দিনেই, যে রেকর্ড টিকে ছিল প্রায় এক যুগ। বগুড়ায় বসে নেওয়া এ সাক্ষাৎকারের শুরুটাও ছক্কাময়। তাঁর অনায়াস ছক্কা মারার রহস্য উন্মোচনের চেষ্টার সঙ্গে কথা হয়েছিল জয়াসুরিয়ার প্রিয় সিক্স হিটারদের নিয়েও। পরে যা ডালপালা ছড়িয়েছিল শ্রীলঙ্কার সুনামি, জয়াসুরিয়ার জীবনবোধেও।
প্রথম প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬। প্রথম আলো।
সনাৎ জয়াসুরিয়ার সঙ্গে কথা বলার পর আপনার মনে সবচেয়ে বেশি যা দাগ কাটবে, সেটি হলো তার সারল্য। বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন, কিন্তু জয়াসুরিয়ার গায়ে এখনো যেন মাতারার গন্ধ। মাতারা শ্রীলঙ্কার সেই গণ্ডগ্রাম, যেখানে প্রায় সবার পেশা মাছ ধরা। জয়াসুরিয়াই এই গ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত রপ্তানি। ভদ্র, বিনয়ী, মৃদুভাষী... অথচ হাতে একটা ব্যাট পেলেই কেমন পাল্টে যান এই লোকটিই। গত মঙ্গলবার বগুড়ায় ‘মাতারা হারিকেন’-এর মুখোমুখি হয়েছিলেন উৎপল শুভ্র
উৎপল শুভ্র: ক্রিকেট বল জোরে মারার দিক থেকে হয়তো আপনি সর্বকালের সেরাদের মধ্যেই পড়বেন। তা আপনার দেখা সেরা পাঁচ হিটার কারা?
সনাৎ জয়াসুরিয়া: গিলক্রিস্ট, ফ্লিনটফ, আফ্রিদি, ধোনি... আর কে, আর কে!
শুভ্র: আপনাকে যোগ করলেই তো পাঁচজন হয়ে যায়।
জয়াসুরিয়া: না না, আমি নিজেই নিজেকে কীভাবে রাখি!
শুভ্র: তাহলে ক্রিস কেয়ার্নস?
জয়াসুরিয়া: কেয়ার্নস তো রিটায়ার করে ফেলেছে। নইলে ও থাকতে পারত। ও হ্যাঁ, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসও তো আছে।
শুভ্র: এদের মধ্য থেকে এক নম্বর হিসেবে কাউকে বেছে নিতে পারবেন?
জয়াসুরিয়া: একজনকে বেছে নেওয়া কঠিন। গিলক্রিস্ট ও সাইমন্ডসের কথা বলা যায়।
শুভ্র: এমন হার্ড হিটার হতে হলে সবচেয়ে বেশি কী প্রয়োজন? অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হয় বলে মানসিকভাবে নিশ্চয়ই খুব শক্তিশালী হতে হয়।
জয়াসুরিয়া: সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। তবে যাদের কথা বললাম, তাদের সবার সহজাত খেলাই ওটা। সবারই উচিত সহজাত খেলাটাই খেলা, ওরা তা-ই খেলে।
শুভ্র: প্রতিভাও তো লাগে, তা-ই না? সবার তো আর এমন ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং করার ক্ষমতা থাকে না।
জয়াসুরিয়া: শুধু প্রতিভা দিয়ে কিছু হয় না। এর সঙ্গে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রমও। খেলাটা এখন এতটাই অন্য রকম যে, সাফল্য পেতে আপনাকে সব সময়ই খাটতে হবে।
শুভ্র: খেলাটা অন্য রকম মানে, যখন শুরু করেছিলেন, সেই তুলনায় খেলাটা কি অনেক বদলে গেছে?
জয়াসুরিয়া: খেলা বদলাচ্ছে, আইন বদলাচ্ছে। আপনাকেও তাই কখনো কখনো নিজের খেলায় পরিবর্তন করতেই হবে। তা ছাড়া ইদানীং ভিডিওতে দেখে প্রতিপক্ষ আপনার খেলার চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। এসব চিন্তা করলে খেলাটা এখন অন্য রকমই। ব্যাটসম্যান-বোলার সবাই যার যার মতো করে এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
শুভ্র: সেরা ফর্মের জয়াসুরিয়ার সামনে কোনো বোলারই ব্যাপার নয় জানি। তারপরও এমন কোনো বোলার কি আছে, যাকে মারা একটু কঠিন বলে মনে হয়?
জয়াসুরিয়া: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব দলেই দু-একজন খুব ভালো বোলার থাকে। তবে মারা কঠিন, এমন বোলারের কথা বললে গ্লেন ম্যাকগ্রা ও শন পোলকের কথাই বলব। ওদের মতো যারা ধারাবাহিকভাবে লাইন-লেংথ ঠিক রেখে ঠিক জায়গায় বল করে যেতে পারে, তাদের মারা সব সময়ই কঠিন।
শুভ্র: আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন কোনটি? সেটা ক্রিকেটীয়ও হতে পারে, এর বাইরেরও হতে পারে।
জয়াসুরিয়া: একটা তো অবশ্যই বিশ্বকাপ জেতার দিন। অন্যটা যেদিন আমার প্রথম মেয়ের জন্ম হলো, সেদিন। এটি একেবারেই অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা। ওর বয়স পরশু (২১ ফেব্রুয়ারি) চার হবে। আমার দুটি সন্তান, ট্যুরে থাকলে ওদেরই এখন সবচেয়ে বেশি মিস করি।
শুভ্র: পছন্দের কোনো ব্যাটসম্যান ছিল? ছেলেবেলার ‘হিরো’ টাইপের!
জয়াসুরিয়া: ছোটবেলায় ভিভ রিচার্ডসকে খুব পছন্দ করতাম। রিচার্ডস, ডেসমন্ড হেইন্স—এদের ব্যাটিং দেখতে দেখতেই আমি বড় হয়েছি। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের ব্যাটিং খুব ভালো লাগত।
শুভ্র: বই-টই পড়ার অভ্যাস আছে?
জয়াসুরিয়া: (হেসে) না, খুব একটা না।
শুভ্র: তাহলে অবসরে কী করতে পছন্দ করেন?
জয়াসুরিয়া: আমি অনেক টিভি দেখি। শ্রীলঙ্কান টেলিড্রামাগুলো আমার খুব পছন্দের। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কান মিউজিক শুনি। শ্রীলঙ্কায় থাকলে নিয়মিতই মিউজিক্যাল শো দেখতে যাই।
শুভ্র: শুধু শ্রীলঙ্কায় নয়, আপনি বিশ্বের জনপ্রিয়তম ক্রিকেটারদেরই একজন। অথচ এত বছরেও আপনার কথাবার্তায়-ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন দেখিনি। এই মাটিতে পা রাখতে পারার রহস্যটা কী?
জয়াসুরিয়া: আমি কখনোই এটা ভুলিনি যে, একদিন খেলা ছাড়ার পর আবার আমাকে সাধারণ মানুষের কাতারেই ফিরে যেতে হবে। আমি যখন বাইরে বেরোই, কখনোই মনে রাখি না যে, আমি একজন ক্রিকেটার, আমি বিশেষ কোনো মানুষ। শ্রীলঙ্কায় বাস করা অন্য সবার মতো আমিও একজন—আমি ব্যাপারটা এভাবেই দেখি। এভাবে দেখলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। নইলে জনপ্রিয়তা আপনার মাথা ঘুরিয়ে দিতেই পারে।
শুভ্র: আচ্ছা, সুনামির ধাক্কা কি শ্রীলঙ্কা সামলে উঠতে পেরেছে?
জয়াসুরিয়া: ওহ্, সুনামি! শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে এর চেয়ে খারাপ কিছু কমই হয়েছে। কোনো দিন এ ধরনের কিছু ঘটতে পারে—শ্রীলঙ্কান মানুষদের কল্পনাতেও ছিল না তা। এই শব্দটাই তো আমরা আগে কোনোদিন শুনিনি। কত পরিবার যে ধ্বংস হয়ে গেছে! কেউ হয়তো পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একা বেঁচে আছে। তবে এটিও ঠিক যে, আমাদের জনগণকে মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে তারা এখন প্রস্তুত। তবে যে ধ্বংসলীলা হয়েছে, বাইরের দেশগুলোর সহায়তা না পেলে শুধু শ্রীলঙ্কার পক্ষে এই ভয়াবহ বিপর্যয় সামলানো সম্ভব হতো না।
শুভ্র: সুনামিদুর্গতদের জন্য আপনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু করেননি?
জয়াসুরিয়া: আমি আমার সাধ্যমতো করেছি। আমার নিজের পরিবারই তো সুনামির শিকার, যন্ত্রণাটা আমি তাই ভালোই বুঝি। সুনামির ঢেউ মাতারায় সৈকতের পাশের একটা মার্কেট থেকে আমার মাকে প্রায় ভাসিয়েই নিয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্য ভালো, কয়েকজন মিলে তাকে উদ্ধার করে। ভালো চোট পেয়েছিলেন তিনি। মাতারায় আমাদের বাড়িটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুনামিতে আমার নিজের পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এটি আমার জন্য বাড়তি আবেগের ব্যাপার।
শুভ্র: আপনি তো তখন শ্রীলঙ্কা দলের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে, তাই না?
জয়াসুরিয়া: হ্যাঁ, নিউজিল্যান্ডে। ওহ, কী যে সময় গেছে! টেলিফোন কাজ করছিল না। টেলিভিশনে ওসব দেখছি, অথচ পরিবারের কারো খোঁজখবর নিতে পারছি না। সে এক ভয়ঙ্কর সময়!
শুভ্র: এবার একটা কঠিন প্রশ্ন করি। নিজের খেলা ইনিংসগুলোর মধ্যে সেরা পাঁচটি ইনিংস বেছে নিতে পারবেন? কঠিন প্রশ্ন বলছি, কারণ স্মরণীয় ইনিংস তো আর আপনি কম খেলেননি।
জয়াসুরিয়া: টেস্টে সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংস ৩৪০ (ভারতের বিপক্ষে কলম্বোয়), এরপর ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২১২। শারজায় একটি ওয়ানডে ম্যাচে ১৮৯ (ভারতের বিপক্ষে), ভারতের বিপক্ষে মুম্বাইয়ে অপরাজিত ১৫১ (১৯৯৭ সালে ইন্ডিপেনডেন্স কাপে), এই কদিন আগে ভিবি সিরিজে সিডনিতে সেঞ্চুরি। সিডনির তিনটি সেঞ্চুরিই—তিন বছর আগে ভিবি সিরিজে সিডনিতে পরপর দু ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলাম। এগুলোই আমার স্মরণীয় ইনিংস।
শুভ্র: কী আশ্চর্য, আপনার স্মরণীয় ইনিংসের তালিকায় ১৯৯৬ বিশ্বকাপ বা সিঙ্গাপুর সিঙ্গার সিরিজের কিছু নেই!
জয়াসুরিয়া: ওহো, একদম ভুলে গেছি। সিঙ্গাপুরের হান্ড্রেডটাকেও রাখতে হবে (৪৮ বলে সে সময়ে ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছিলেন জয়াসুরিয়া)।
শুভ্র: আপনার ব্যাটিং এমনই বিনোদন যে, সম্ভব হলে চিরদিনই তা দেখতে চাইত সবাই। তবে তা তো আর হওয়ার নয়। অবসর নেওয়ার আগে নির্দিষ্ট কিছু অর্জনের লক্ষ্য আছে? আরেকটা প্রশ্ন, মানুষ আপনাকে কীভাবে মনে রাখুক বলে চান?
জয়াসুরিয়া: এখন যেমন পারফর্ম করছি, আমি চাই এমন পারফর্ম করতে করতেই বিদায় নিতে। আর মানুষ কীভাবে মনে রাখবে—এ নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই। আমি শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের জন্য কী করেছি, মানুষ যদি তা মনে রাখে, রাখবে। আর যদি মনে না রাখে, তাহলেই বা আমার কী করার আছে? আমার পক্ষে তো বলে বেড়ানো সম্ভব নয়—আমি এই করেছি, আমি ওই করেছি।
শুভ্র: যে মাতারা থেকে কেউ কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেনি, সেখান থেকে উঠে এসে আজ আপনি বিশ্ব ক্রিকেটের বড় এক তারকা। নিজের জীবনের দিকে যখন ফিরে তাকান, তখন কী মনে হয়?
জয়াসুরিয়া: খুব ভালো লাগে। আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি, আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমাকে অনেক কষ্ট করে ওপরে উঠতে হয়েছে। কারণ আমাদের পরিবার ছিল খুব গরিব। স্কুল ক্রিকেট খেলাটাও আমার জন্য ছিল বিলাসিতা, এমনকি কলম্বোয় আসাটা পর্যন্ত সহজ ছিল না। আশির দশকের ওই সময়টার সঙ্গে যদি আজকের সময়টার তুলনা করি, মানতেই হবে ক্রিকেট আমাকে অনেক দিয়েছে। আমার বাবা-মা, ভাইয়েরা—পুরো পরিবারেরই স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমি সত্যি খুব সুখী মানুষ।
শুভ্র: আপনার কাছে টাকার অর্থ কী?
জয়াসুরিয়া: টাকাকে আমি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে মনে করি না। মানুষের মন জয় করাটাই আমার কাছে আসল ব্যাপার। টাকার মালিক যে কেউই হতে পারে, কিন্তু সবাই মানুষের মন জয় করতে পারে না।