সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকার: পর্ব-৩
সাকিবের চোখে সাকিবের সেরা, বিশ্বের সেরা
উৎপল শুভ্র
২২ ডিসেম্বর ২০২১
তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে উঠে এসেছে সাকিবের খেলোয়াড়ি জীবনের বড় সব অর্জন...সেরা ব্যাটিং-বোলিংয়ের সঙ্গে সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্সও। সঙ্গে তাঁর প্রিয় ব্যাটসম্যান, প্রিয় অলরাউন্ডার, কঠিনতম বোলার...কথা বলেছেন দুবার সাসপেন্ড হওয়া নিয়েও।
উৎপল শুভ্র: কদিন আগেই টেস্ট ক্রিকেটে আপনার ৪০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ‘ডাবল’ হলো। সেটিও সবচেয়ে কম টেস্টে। ইয়ান বোথামের যেখানে ৬৯ টেস্ট লেগেছিল, আপনার লেগেছে ৫৯ টেস্ট। এই জাতীয় কোনো রেকর্ড হলেই আমার এটা ভেবে আফসোস হয়, টেস্ট ক্রিকেটটাকে অবহেলা না করলে আপনি কোথায় যেতে পারতেন। কারণ শেষ পর্যন্ত তো গ্রেটনেস নির্ধারিত হয় টেস্ট ক্রিকেটে পারফরম্যান্স দিয়ে। এটা নিয়ে আপনার আফসোস হয় না?
সাকিব আল হাসান: চাওয়া-পাওয়ার তো শেষ নেই। তবে আমি রিগ্রেট করি না। কোনো কিছু নিয়েই কখনো আফসোস করি না। শেষ পাঁচ বছরে অনেক টেস্ট মিস করেছি। এত টেস্ট মিস না করলে হয়তো ৭৫টা টেস্ট খেলা হয়ে যেত। এটাও তো বড় অর্জন হতো। এখন যেমন আমাদের মাঝে শুধু মুশফিক ভাইয়েরই মনে হয় ১০০ টেস্ট খেলার সুযোগ আছে। অন্য কেউ-ও খেলে ফেলতে পারে, তবে সম্ভাবনা কম। আমি ৭৫টা টেস্ট খেললে হয়তো ১০০ টেস্ট খেলার একটা লক্ষ্য ঠিক করা যেত। তবে এখন মনে তো হয় আর সুযোগই নেই।
শুভ্র: এবার আপনার জায়গাটায় আসি। মানে আলোচনার বিষয় অলরাউন্ডার। প্রথমে বলেন, অতীত-বর্তমান মিলিয়ে আপনার প্রিয় অলরাউন্ডার কে?
সাকিব: (একটু ভেবে) প্রিয় ওরকম কোনো অলরাউন্ডার আসলে নেই আমার। তবে অনেককে ভালো লাগত। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফকে ভালো লাগত, আবদুল রাজ্জাককে ভালো লাগত। আরও কাউকে কাউকে ভালো লাগত। কিন্তু যাদের বেশি ভালো লাগত, তারা সবাই পেস বোলিং অলরাউন্ডার, কেউই স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার না। স্পিনিং অলরাউন্ডারদের মধ্যে এখন যেমন (রবীন্দ্র) জাদেজা শেষ দুই বছর বা আরও বেশি সময় ধরে খুবই ভালো খেলছে। যেটা আসলে আমি কখনো ভাবিইনি। জ্যাক ক্যালিসকে ভালো লাগত। এখন বেন স্টোকসকে ভালো লাগে।
শুভ্র: এই মুহূর্তে আপনার চোখে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার কে? বেন স্টোকস না আপনি? র্যাঙ্কিং ভুলে যান।
সাকিব: র্যাঙ্কিং দরকার নেই। স্টোকস।
শুভ্র: ইমপ্যাক্টের কারণে, নাকি ব্যাটিং-বোলিং দুইটা আলাদা করে দেখলে আপনার চেয়ে বেশি ইফেক্টিভ মনে হয়...কোন কারণে?
সাকিব: এনি ডে আমি আমার আগে স্টোকসকে চুজ করব। আমার এত অ্যানালাইসিস করার দরকার নাই। আমার কাছে মনে হয় ও আমার চেয়ে বেটার প্লেয়ার।
শুভ্র: ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে আপনার পড়াশোনা কেমন? আপনি কি গ্যারি সোবার্স, ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, ইমরান খানদের মতো গ্রেট অলরাউন্ডারদের সম্পর্কে জানেন?
সাকিব: না ভাই। নাম জানি। আর কিছু জানি না।
শুভ্র: নাম তো জানবেনই। দেখা গেল, আপনি এমন কিছু করে ফেললেন, যা স্যার রিচার্ড হ্যাডলির পর আর কেউ করেনি। এমন কিছু তো করেছেনই, যা এর আগে শুধু আপনার বোথাম আর ইমরানই করতে পেরেছেন।এভাবেই জেনেছেন?
সাকিব: হ্যাঁ, ওরকমই বলা যায়। হয়তো কোনো একটা ম্যাচ দেখছি, বিশ্বকাপের হাইলাইটস। ইমরান খানের কিছু একটা দেখাচ্ছে...এই আর কি! জ্যাক ক্যালিসকে তো দেখেছিই। আমার চোখে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। রেকর্ডের বিচারে তার ধারেকাছেও কেউ নেই। ওর সব রেকর্ড এক করলে শচীনের (টেন্ডুলকার) দ্বিগুণ হয়ে যাবে পারফরম্যান্সের বিচারে। এসব বিচারে ওকেই আমার মনে হয় বেস্ট। তো যে সেরা, তাকেই যখন দেখে ফেলেছি, তা থেকে বুঝে নিয়েছি বাকিরা কেমন হতে পারে (হাসি)।
শুভ্র: মার্ক বাউচার আমাকে বলেছিলেন, লারা-টেন্ডুলকার নিয়ে এত কথা, আমাকে অপশন দিলে ‘আমি ক্যালিসকেই আমার দলে নেব’।
সাকিব: (হাসি) বাউচার হয়তো এটা ফ্রেন্ড হিসেবেই বলেছে। ওরা দুজন তো বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু আসলেও তো ক্যালিসের ওপর কেউ নাই।
শুভ্র: আপনার সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স যদি একটা বেছে নিতে বলি... জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আপনার যে ১০ উইকেট আর সেঞ্চুরি আছে, তা আর আছে শুধু বোথাম ও ইমরানের। এটাকেই আপনি আপনার সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স মনে করেন, নাকি অন্য কোনোটাকে?
সাকিব: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমরা যে টেস্টটা জিতলাম (২০১৭ সালে মিরপুরে দুই ইনিংসেই ৫টি করে উইকেট, যথাক্রমে ৮৪ ও ৫ রান)।
শুভ্র: কেন এটাই সেরা?
সাকিব: অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলা, জীবনে যাদের হারাইনি, নাক উঁচা, আসতেও চায় না। যেতেও চায় না অনেক দেশে। এর আগেও একবার এমনও হয়েছে, ব্যাগ-ট্যাগ এসেছে, ওরা আসেনি। এসব মিলে আর কি।
শুভ্র: অলরাউন্ড পারফরম্যান্স তো হলো। এবার আলাদা করে ব্যাটিং আর বোলিং পারফরম্যান্স। পরিসংখ্যানে কোনটা সেরা, সেটি তো আমরা জানিই। আমি জানতে চাচ্ছি, আপনার নিজের বিবেচনায় সেরা বোলিং পারফরম্যান্স কোনটি?
সাকিব: টেস্টে সাউথ আফ্রিকার সাথে সাউথ আফ্রিকায় প্রথমবার যখন গেছি (২০০৮ সালে)। দুই টেস্টের একটাতে ৫টা, আরেকটাতে ৬টা উইকেট পেয়েছিলাম। ওই সময় আমি লাইফের বেস্ট বোলিং করছিলাম। একটা বোধ হয় ব্লুমফন্টেইনে, আরেকটা সেঞ্চুরিয়নে।
শুভ্র: বেস্ট ব্যাটিং পারফরম্যান্স? টেস্ট আর ওয়ানডে আলাদা হতে পারে। এমন কোনো ইনিংস, যখন আপনার মনে হয়েছে, আমি যা চাইছি তা করতে পারছি।
সাকিব: ওয়ানডেতে মনে হয় তিনটা ইনিংস আছে। দুইটা ইনিংস ওয়ার্ল্ড কাপে ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে (পরপর দুই ম্যাচে ১২১ ও অপরাজিত ১২৪)। আরেকটা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশে, ৯১ বা ৯২ করেছিলাম। ফাইনালে উঠতে আমাদের নেট রান রেট বাড়াতে হতো।
শুভ্র: অপরাজিত ৯২, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। আর টেস্ট যদি যদি বলি...
সাকিব: পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪৪। আরেকটা নিউজিল্যান্ডে ২১৭।
শুভ্র: পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪৪...২০১১ সালে, তাই তো?
সাকিব: ২০১১ না আরও পরে...২০১৪-১৫-এর দিকে?
শুভ্র: না, ২০১১-ই। ২০১১-এর ডিসেম্বরে। ওই টেস্টে তো আপনি ৫ উইকেটও পেয়েছিলেন...
সাকিব: ৫ না, ৬।
শুভ্র: হু, ৬ উইকেট। আমি ৫ উইকেট বলছি, ইনিংসে ৫ উইকেট বোঝাতে। আচ্ছা, এই যে ৫টা পারফরম্যান্সের কথা বললেন, এর মধ্যে কোনটাতে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে বলে মনে হয়েছিল। বোলিংয়ের সময় হয়তো বল হাত থেকে বেরোনো থেকে শুরু করে সব মনমতো হচ্ছে, ব্যাটিংয়ে যা ইচ্ছা করতে পারছেন...
সাকিব: ওটা সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে যখন খেলছিলাম, তখন হচ্ছিল।
শুভ্র: এমন দিনে আসলে কী হয়, আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জন্য ওই ‘ইন দ্য জোন’ ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?
সাকিব: ওই সময় সবকিছু ভালো ছিল। বলের সিম পজিশন, ফ্লাইট, ড্রিফট, পেস...সবকিছুই ভালো ছিল।
শুভ্র: এরপর বোলিংয়ে হয়তো স্ট্রাগল করছেন, ওই বোলিংয়ের ভিডিও কি দেখেন তখন? আপনার কি এসব অভ্যাস আছে?
সাকিব: ওই ভিডিওগুলো আমার কাছে আছে। শুধু আমার কাছে না, তাইজুলদের কাছেও আছে। ওরাও দেখে। চেষ্টা করি ওখানকারটা কপি করার, যদিও পুরোপুরি হয় না। তবে কাছাকাছি পৌঁছায়।
শুভ্র: ব্যাটিংয়ে আসি। আপনার শুরুর কিছু দিন পরই ডেভ হোয়াটমোর আপনাকে চার নম্বরে তুলে দিলেন। আমাদের অনেকের কাছেই তখন তা সারপ্রাইজিং লেগেছে।
সাকিব: (হাসতে হাসতে) আপনি আশরাফুল ভাইয়ের ভক্ত ছিলেন, এজন্য সারপ্রাইজিং লেগেছে। যে আশরাফুল ভাইকে না দিয়ে আমাকে দিয়েছে।
শুভ্র: (হাসি) আরে না, আশরাফুল ব্যাপার না; আসলে চার নম্বর পজিশনটা তো একটা বড় জায়গা...
সাকিব: বড় জায়গায় তো বড় প্লেয়ারই খেলবে। ছোট প্লেয়ার খেলবে নাকি? (হাসি)।
শুভ্র: ইয়ার্কি বাদ, আমি যে কারণে চার নম্বরের কথাটা বলেছি, তা হলো, শুরুতে আপনার পরিচয় ছিল ‘ব্যাটসম্যান, যে বোলিং করতে পারে’। পরে একটা সময়ে হয়ে গেল ‘আপনি বেশি বোলার, কম ব্যাটসম্যান’। ২০১৯-এ এসে উল্টো। বিশ্বকাপে আপনাকে দেখে প্রপার একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান মনে হয়েছে। মাঝখানে যেখানে আপনার ব্যাটিং সবসময় চান্সি মনে হতো, মনে হতো যেকোনো সময় আউট হয়ে যেতে পারেন। সেদিন আবার পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে তিন/চারটা কাভার ড্রাইভ দেখে মনে হলো, ব্যাটসম্যান সাকিব ইজ ব্যাক। আমার প্রশ্ন হলো, আপনি নিজে ব্যাটসম্যান সাকিবকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেন?
সাকিব: ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, সবসময় ওটা একরকম থাকে না। খুবই টেকনিক্যাল সাবজেক্ট তো। ক্রিকেটের সবই টেকনিক্যাল, তবে ব্যাটিং সবচেয়ে বেশি। টেকনিক্যালি রাইট থাকতে হয়, মেন্টালি রাইট থাকতে হয়, ফিটনেস ঠিক থাকতে হয়। ক্রিকেটীয় বিচারে একেবারে আদর্শ জায়গায় থাকতে হয়। সবকিছু যখন ঠিক থাকে, তখন পারফরম্যান্সটা সবচেয়ে ভালো হয়। এর মধ্যে যদি কোনো একটা কম থাকে, তাহলেও হয় না। আর সবকিছু আসলে একটা জায়গায় রাখা কঠিনও। শুধু ব্যাটসম্যান হলে এক কথা, শুধু ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিলেই হয়। কিন্তু অলরাউন্ডারদের তো দুইটাই দেখতে হয়। এর মধ্যে অনেকটা সময় ছিলাম ক্যাপ্টেন। তো ব্যাটিং করা, বোলিং করা, ফিল্ডিং করা, টিম চালানো, ক্যাপ্টেনসি করা সবকিছু মিলিয়ে সব সময় সব জায়গায় মনোযোগ দেওয়া যায় না। ওই কারণে মনে হয়, যতটুকু হয়েছে, ঠিকই আছে। রিগ্রেট করার কিছু নাই। তবে যদি আরও কিছু বেশি রান করতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো। যেটা মনে হয় আমি ক্যাপাবল ছিলাম।
শুভ্র: আপনার এত অর্জনের মধ্যে একটা বলুন, যেটা নিয়ে আপনার গর্ব হয়।
সাকিব: ২০১৯ ওয়ার্ল্ড কাপ।
শুভ্র: ওই বিশ্বকাপে আপনার যা পারফরম্যান্স, তাতে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কারটা না পেয়ে রাগ হয়নি?
সাকিব: যারা দিয়েছে, তারা ভালো বলতে পারবে। কিন্তু আমি খুশি ছিলাম। পারফরম্যান্সে বা আমি যা করেছি, তাতে।
শুভ্র: আপনি আশা করেছিলেন না?
সাকিব: আশা তো অবশ্যই করেছিলাম। আশা না করার কোনো কারণ তো ছিল না।
শুভ্র: কৈশোরে আপনার প্রিয় ব্যাটসম্যান ছিলেন সাঈদ আনোয়ার, এটা তো জানিই। নিজে খেলা শুরুর পর বড় বড় অনেক ব্যাটসম্যানকে কাছ থেকে দেখেছেন, ফিল্ডিং করার সময় হয়তো কাউকে এমন একটা শট খেলতে দেখলেন বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানের জন্য যা অসম্ভব...এদের মধ্য থেকে যদি এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ বেছে নিতে বলি, চাইলে আপনি একজনও বেছে নিতে পারেন...
সাকিব: এবি ডি ভিলিয়ার্স।
শুভ্র: এটা কি তাঁর ব্যাটিংয়ে যে একটা ঔদ্ধত্য আছে, এ কারণে? কখন কী করবে, তার তো কোনো ঠিক নাই!
সাকিব: হতে পারে। ও তো সব জায়গার প্লেয়ার। এমন না যে এক জায়গায় পারে, আরেক জায়গায় পারে না। ওপেন থেকে শুরু করে ৭/৮ যেখানেই নামাবেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে যাবে।
শুভ্র: সেটাও আবার এমন না যে, শুধু এক ফরম্যাটে...
সাকিব: সব ফরম্যাটেই। সারা দিন ডিফেন্স করে ১ রান করতে পারে। আবার এক ঘণ্টায় এক শ-ও মেরে দিতে পারে।
শুভ্র: ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে এক দলে তো খেলেননি কখনো?
সাকিব: না, একসঙ্গে খেলার সুযোগ হয়নি। একবার বিপিএলে হতে গিয়েছিল, একটা ঝামেলায় হয়নি। রংপুর (রাইডার্স, ২০১৯) সই করিয়ে ফেলায় রংপুরে খেলেছিল।
শুভ্র: কথাবার্তা তো হয়েছে?
সাকিব: দেখা হলেই কথাবার্তা হয়। বিপিএলের সময় অনেক কথা হয়েছে। এমনিতেও দেখা হলেই কথা হয়।
শুভ্র: ওর কোনোকিছু কি বিশেষভাবে আপনার চোখে লেগেছে? প্রশ্নটা করার কারণ, ডি ভিলিয়ার্স তো একেবারেই অন্যরকম একজন ক্রিকেটার। কিছুটা অবিশ্বাস্যও। আপনার ব্যাপারে যেমন আমরা বলি, আপনি কোনো কিছু গায়ে মাখেন না, চাপ হজম করে নিতে পারেন; ওর এমন কিছু বিশেষত্ত্ব কি চোখে পড়েছে?
সাকিব: বেশির ভাগ ওয়ার্ল্ড ক্লাস প্লেয়ারদের ক্ষেত্রেই দেখেছি, ওরা বেশি কিছু বলে না। কোনো কিছুকে কমপ্লিকেটেড বানিয়ে ফেলে না, সিম্পল রাখে। বেশির ভাগ কথা হয় খেলাটা এনজয় করছে কি না, এ নিয়ে। এটাই আসলে ইম্পর্ট্যান্ট।
শুভ্র: প্রিয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ডি ভিলিয়ার্সই কি একমাত্র, আরও দু-একজনের কথা বলবেন?
সাকিব: নাহ্। ও একাই থাক।
শুভ্র: এবার বোলার। শেন ওয়ার্নকে তো বোধহয় পাননি, মুরালিধরনকে খেলেছেন। আপনি স্পিনার বলেই জিজ্ঞেস করছি, এই দুজনের মধ্যে আপনার চোখে সেরা কে?
সাকিব: মুরালি। শেন ওয়ার্নের সঙ্গে খেলিনি। বেশি কিছু জানি না তাই। কোনো সন্দেহ নেই, মুরালি সেরা। আপনি যদি ওর (ইনিংসে) ৫ উইকেটের সংখ্যা দেখেন, ৬৭ না ৬৮ না (৬৭)? এবার এতগুলা সেঞ্চুরির হিসাব করেন। মুরালি বাই ফার দ্য বেস্ট বোলার।
শুভ্র: মুরালিকে খেলা কতটা কঠিন? আমি অনেক ব্যাটসম্যানের অভিজ্ঞতাই শুনেছি। আপনারটাও শুনতে চাই।
সাকিব: পরের দিকে খেলতে খেলতে একটু ক্লিয়ার হয়েছে। একটা মানুষের একটা অভ্যাস হয়েই যায়। তবে প্রথম দিকে আমি কিছুই বুঝতাম না ওর বল। কোনটা যে কোনদিকে যাবে! হয়তো দুসরা মারছে, হঠাৎই বোল্ড!
শুভ্র: মুরালি কি পেসার-স্পিনার মিলিয়েই আপনার খেলা কঠিনতম বোলার?
সাকিব: হ্যাঁ।
শুভ্র: এবার একটা অভিযোগ। অর্জুনা রানাতুঙ্গা যেমন মাঠ ও মাঠের বাইরে নেতৃত্ব দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে অন্য একটা ধাপে নিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশকেও তা নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাটা আপনার ছিল। মাশরাফিরও হয়তো ছিল, কিন্তু মাশরাফি তো টেস্ট থেকেই ছিটকে পড়লেন। আপনি যদি তিন ফরম্যাটেই মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে ক্যাপ্টেনসিটা করতেন, তাহলে হয়তো তা হতো। কিন্তু যদি বলি, আপনি আমাদের বঞ্চিত করেছেন, আপনার জবাব কী হবে?
সাকিব: আামি কিভাবে বঞ্চিত করব? প্রথমে তো বোর্ডকে বিশ্বাস করতে হবে। বোর্ড যদি বিশ্বাস করত, আর ওরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তাহলে তো করার সম্ভাবনা থাকতই।
শুভ্র: বোর্ড তো আপনাকে আবারও অধিনায়ক করেইছিল। পরে না হয় অন্য কারণে অধিনায়কত্ব গেছে, কিন্তু এর আগেই তো চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে হারার পর আপনি সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ক্যাপ্টেনসি ছেড়ে দিতে চান।
সাকিব: আসলে ডিপেন্ড করে। সব সময় মাইন্ড সেট আপ তো একরকম থাকে না। ২০১৮-১৯-এর দিকের কথা আমি বলিনি। এটা তো অনেক পরে। আফগানিস্তানের সঙ্গে টেস্ট হারলাম কবে? ১৮ না ১৯-এ?
শুভ্র: ১৯-এ।
সাকিব: ১৯-এ এসে তো আমার লাইফ কত চেঞ্জ হয়ে গেছে, আমি অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছি। তখন আর ওইভাবে কিছু প্ল্যান করিনি। তবে আগে থেকে হলে হয়তো অন্যভাবে করতে পারতাম। তবে এটা নিয়ে আর আফসোস করি না।
শুভ্র: ২০১১ সালে আপনি দীর্ঘ মেয়াদে ক্যাপ্টেন হওয়ার পর আপনার একটা বড় ইন্টারভিউ করেছিলাম। তখন আপনি ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে আপনার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। যা শুনে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে আছে, আপনি বলেছিলেন, সৌরভ গাঙ্গুলী যেমন ভারতের ক্রিকেটকে একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় নিয়ে গেছেন, আপনিও ওই জায়গায় নিতে যেতে চান।
সাকিব: হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসলে ২০১৪-এর পর থেকে আমার এসব হয়তো একটু কমে গিয়েছিল।
শুভ্র: ২০১৪ মানে কি ওই সাসপেনশন?
সাকিব: মে বি। ওটা ওই সময় আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। ওই সময়ের পর হয়তো আর ওইভাবে চিন্তাভাবনা করিনি। যদিও এখন বলা মুশকিল, চিন্তাটা কী ছিল। কিন্তু ওই সময়ের পর থেকেই হয়তো চিন্তাভাবনাটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে।
শুভ্র: এতদিন পর পেছনে ফিরে আপনি কি মনে করেন, ওই সাসপেনশনটা অযৌক্তিক ছিল? নির্দিষ্ট কোনো কারণ তো বলা হয়নি।সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কাউকে ছয় মাস সাসপেন্ড করার কথা তো আমি কখনো শুনিনি।
সাকিব: (হাসতে হাসতে) আমিও এটা শুনি নাই।
শুভ্র: আমি নানা কিছু শুনেছি। কিন্তু এখনো আমি নির্দিষ্ট কারণ জানি না। আপনাকে কি কোনো কারণ বলা হয়েছিল?
সাকিব: কারণ তো নেই, সেটা আমিও জানি।(হাসি) নইলে সাসপেন্ড করে আবার সাসপেন্ড উইথড্র করত না কেউ! মানে, কারণ থাকলে কেউ তো আর নিষেধাজ্ঞা তুলে দিত না।
শুভ্র: ওই ছয় মাস না হয় বুঝলাম অন্যায়। কিন্তু আপনি সর্বশেষ যে কারণে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেন, তা তো আমি আপনার সঙ্গে মেলাতে পারি না। আপনি এত ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলেছেন, সবকিছু জানেন। এটাকে ভুল বললে সেই ভুলের ব্যাখ্যা কী? আসলে কী ঘটেছিল?
সাকিব: এটা নিয়ে আসলে বারবার বলার কিছু নেই। ব্যাপারটা হলো, আমি ঢিলামি করেছি। আর একদম কেয়ারই করিনি বিষয়টা। এটাই আর কি কারণ। এছাড়া আর কিছু না।
শুভ্র: আপনি তো জানতেন এটা কেয়ার না করলে বড় শাস্তি হয়। আপনি নিজেই তো এর আগে যখন কেউ এমন অ্যাপ্রোচ করেছে, তখন রিপোর্ট করেছেন।
সাকিব: অ্যাপ্রোচ করছে, ঠিক আছে। আবার এটা যখন করছে, তখন ভেবেছি, যাক, ঠিক আছে, পাঠাবো নে। এরপর কী এক ঝামেলা চলে আসল একটা। এই আর কি! এর চেয়ে কম-বেশি কিছুই না।
শুভ্র: আইসিসির দেওয়া হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ থেকে তো আমরা জানি, আপনি ওদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। এর ব্যাখ্যাটা কী?
সাকিব: ওটার ব্যাখ্যা আমার কাছেই থাক।
শুভ্র: আপনার কাছে তো আছেই। মানুষের কাছে পরিষ্কার করলে ভালো না, কেন দেখা করতে চেয়েছিলেন?
সাকিব: না। মানুষের অতো জানার দরকার কি? আমার লাইফ সম্পর্কে মানুষের এমনিতেই অনেক আগ্রহ।