‘আকরাম আর ম্যাকগ্রার সঙ্গে এক দলে খেলার খুব ইচ্ছা ছিল’
উৎপল শুভ্র
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
খেলোয়াড়ি জীবনে কয়টা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। ‘কার্টলি টকস্ টু নো মান’—আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো বিখ্যাতই হয়ে গিয়েছিল কথাটা। অথচ
সাংবাদিক দেখলেই মুখ হাঁড়ি বানিয়ে ফেলাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কার্টলি অ্যামব্রোস খুব আমুদে মানুষ, কথাও বলেন দারুণ! ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সেন্ট ভিনসেন্ট টেস্টের সময় নেওয়া এই সাক্ষাৎকারটাও এর একটা প্রমাণ।
প্রথম প্রকাশ: ১২ ও ১৩ জুলাই, ২০০৯। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: ক্রিকেট-পরবর্তী অবসর জীবন কেমন কাটছে আপনার? খুব গান-টান করছেন নাকি?
কার্টলি অ্যামব্রোস: খুব ভালো কাটছে রে ভাই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে জীবনের সাড়ে বারো বছর দিয়েছি। আমার যা ছিল উজাড় করে দিয়েছি।আমার বিশ্বাস, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও নিজের একটা দাগ রেখে যেতে পেরেছি। এখন আমার পারিবারিক জীবন উপভোগ করার সময়। গান-বাজনাও করছি। সব মিলিয়ে খুব ভালো আছি।
শুভ্র: অনেক ব্যাটসম্যানের মুখেই শুনেছি, তাদের খেলা সবচেয়ে কঠিন বোলারের নাম ছিল কার্টলি অ্যামব্রোস। দুটি প্রশ্ন-প্রথমটা হলো, এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন উল্টোটা জানতে, আপনি যাদের বোলিং করেছেন তাদের মধ্যে কঠিনতম ব্যাটসম্যান মনে হয়েছে কাকে?
অ্যামব্রোস: ব্যাটসম্যানরা যদি আমাকে সবচেয়ে কঠিন বোলার বলে থাকে, এটাকে আমি বিরাট একটা স্বীকৃতি বলব। আর আমার দেখা কঠিন ব্যাটসম্যানের কথা বলছেন, সে তো অনেকেই ছিল। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড বুন, গুঁফোটা বড় কঠিন জিনিস ছিল। অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ সঙ্গে অনেক খেলেছি, ওরাও খুব কঠিন ছিল। ইংল্যান্ডের গ্রাহাম গুচ, অ্যালান ল্যাম্ব; পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদ--এরাও ছিল খুব লড়াকু ক্রিকেটার। ওদের টালমাটাল করাটা ছিল খুব কঠিন।
শুভ্র: শচীন টেন্ডুলকারের কথা যে বললেন না!
অ্যামব্রোস: কারণ আমি শচীনের বিপক্ষে খুব বেশি খেলিনি। তবে এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ও গ্রেট এক ক্রিকেটার।
শুভ্র: এত প্রাপ্তিতে উজ্জ্বল ক্যারিয়ারেও কি কোনো কিছু না পাওয়ার আক্ষেপ আছে?
অ্যামব্রোস: একটাই। বিশ্বকাপটা জিততে পারিনি। টুর্নামেন্ট তো আর কম জিতিনি, বলতে গেলে যত টুর্নামেন্টে খেলেছি প্রায় সবই। জিতেছি অসংখ্য টেস্ট-ওয়ানডে সিরিজও, বিশ্বকাপটা জিততে পারলে সব পূর্ণতা পেত। কিন্তু একবার শুধু সেমিফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয়টা আমাকে এখনো যন্ত্রণা দেয়।
শুভ্র: সেমিফাইনাল তো ১৯৯৬ বিশ্বকাপে। ওই ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়া জিতেছে না বলে তো বলা উচিত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের জয় উপহার দিয়েছে!
অ্যামব্রোস: ঠিক বলেছেন। আসলেই আমরা জয়টা হাতের মুঠো থেকে ফেলে দিয়েছি। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল আমরা হেসেখেলে জিতব। চন্দরপল আশির ঘরের একটা দারুণ ইনিংস খেলেছিল। এরপর আমরা কীভাবে যে ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়ার হাতে তুলে দিলাম! তবে আমার একটা সান্ত্বনা আছে, আমি আমার যথাসাধ্য করেছি।
শুভ্র: আপনার বোলিংটা প্রচলিত ফাস্ট বোলিংয়ের চেয়ে একটু আলাদাই ছিল। ওপরে বল করার বদলে একটু শর্ট অব লেংথে বল করেই টেস্টে আপনার ৪০৫ উইকেট। এই ব্যতিক্রমী বোলিংয়ের রহস্যটা কী?
অ্যামব্রোস: প্রথম কথা হলো, আমি কখনোই সুইং বোলার ছিলাম না। আমাকে বলতে পারেন সিম বোলার। উইকেটে পড়ার পর বল কী করবে সেটিই ছিল আমার বোলিংয়ের মূল ব্যাপার। যেটিকে আমার শক্তির দিক ছিল বলতে পারেন, তাহলো সারা দিন আমি একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বল করে যেতে পারতাম। বোলিংটাকে আমি সব সময়ই খুব সিম্পল রাখতে চেয়েছি। বেশি কিছু করার চেষ্টা করিনি। আমি এখনকার ফাস্ট বোলারদের অনেক বেশি কিছু করার চেষ্টা করতে দেখি। অথচ ওদের উচিত যেকোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়কে নিখুঁত করে তোলা। ওই যে বেশি কিছু করার চেষ্টা না করা, সেটাও ছিল আমার একটা শক্তির দিক। আমি জানতাম ধারাবাহিকভাবে এটা করে যেতে পারলে সাফল্য আসবেই।
শুভ্র: এক জায়গায় সারা দিন ধরে বোলিং করে যাওয়ার যে ক্ষমতার কথা বললেন, সেটির পেছনে নিশ্চয়ই অনেক পরিশ্রম আছে।
অ্যামব্রোস: ওটা আমি সহজাতভাবেই পেয়েছি। এরপর খেলতে খেলতে যা হয়, আরও নিখুঁত হয়েছি। আমার সাফল্যের মূলমন্ত্রই ছিল ওটা সিম্পল রাখো, বেশি কিছু করার চেষ্টা করতে যেয়ো না। আমার ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে দেখবেন, দিনের পর দিন আমি একই জিনিস করে গেছি। সেটি করেই যদি সাফল্য পাই, তাহলে অন্য কিছু করতে যাব কেন?
শুভ্র: আপনার কৈশোর-তারুণ্যে তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে দারুণ সব ফাস্ট বোলার। তাদের মধ্যে কাকে আদর্শ মানতেন?
অ্যামব্রোস: না, আদর্শ–টাদর্শ কেউ ছিল না। কারণ ক্রিকেট তো আমার প্রথম ভালোবাসাই ছিল না। কথাটা শুনে আপনি যেভাবে তাকালেন, সবাই-ই এমন অবাক হয়ে তাকায়। ক্রিকেট ভালো না বাসলে আমি এত সাফল্য পেলাম কীভাবে? কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমি ছিলাম বাস্কেটবলের পাগল।ফুটবলও খুব ভালো লাগত। ক্রিকেটও টুকটাক খেলতাম, তবে এটা তো ছোটবেলায় সবাই খেলেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দূরে থাক, আমি কখনো ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলারও স্বপ্ন দেখিনি। আমি ক্রিকেটার হলাম আমার মায়ের কারণে। আমার মা ক্রিকেটের পাগল। অতীত দিনের সব গ্রেট খেলোয়াড়ের নাম ছিল তাঁর মুখস্থ। তিনি সারাক্ষণ আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেন, কার্টলি, তোমাকে ক্রিকেটার হতেই হবে। বলতে পারেন,মায়ের এই ঘ্যানঘ্যানানি থেকে মুক্তি পেতেই আমি ঠিক করলাম, ক্রিকেটে একটু চেষ্টা করে দেখব। না পারলে মায়ের হাত থেকে তো অন্তত মুক্তি পাব! এভাবেই ২১ বছর বয়সে সুইট নামে আমার গ্রামের পক্ষে আমার ক্লাব ক্রিকেট খেলা শুরু। এটা ১৯৮৪ সালের কথা, এর চার বছর পরই আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে।
শুভ্র: নিজের দলের কেউ হোক বা অন্য কেউ, আপনার ক্যারিয়ারে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি?
অ্যামব্রোস: সেভাবে কারোরই নেই। কারণ আমি শুরু থেকেই সাফল্য পেয়েছি। ক্লাব ক্রিকেট খেলতে শুরু করেই ভালো করেছি। এর এক বছর পরই ১৯৮৫ সালে অ্যান্টিগা জাতীয় দলে ঢুকে গেলাম, সেখানেও শুরুতেই সাফল্য। এক বছর পর লিওয়ার্ড আইল্যান্ডস দলে, যথারীতি সাফল্য দিয়ে শুরু। এর পর তো টেস্ট ক্রিকেট। সব সময়ই আমার একটা আত্মগরিমা ছিল, আমি সব সময়ই সেরা হতে হয়েছি। আমার সৌভাগ্য, টেস্ট অভিষেকের সময় সতীর্থ হিসেবে পেয়েছি প্রয়াত ম্যালকম মার্শালকে। কোর্টনি ওয়ালশও ছিল। মার্শাল শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে অন্যতম সেরা বোলারই ছিলেন না, খেলাটা নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনাও ছিল দারুণ। উনি আমাকে সাহায্য করেছেন। আর ওই যে আগেই বললাম, আই ওয়াজ আ প্রাউড পারসন। আমি তাই তাড়াতাড়ি শিখতে বাধ্য হয়েছি। কারণ আমি কখনো আর দশজনের ভিড়ে হারিয়ে যেতে চাইনি।
শুভ্র: কোথায় যেন একটা লেখায় পড়েছিলাম, আপনি কখনো ‘গরিবের মার্শাল বা গার্নার' হতে চাননি। চেয়েছেন কার্টলি অ্যামব্রোস হতে।
অ্যামব্রোস: একদম ঠিক কথা। আমার শুরুর সময় জোয়েল গার্নারের সঙ্গে আমার খুব তুলনা হতো। জোয়েল তখন মাত্র অবসর নিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে তুলনাটাকে আমি খারাপ বলছি না। ওটা বড় একটা কমপ্লিমেন্টই ছিল। কিন্তু আমি সবসময়ই কার্টলি অ্যামব্রোস হতে চেয়েছি। কখনোই কাউকে অনুকরণ করিনি, কখনো কারও মতো হতে চাইনি। আমি যা করেছি, আমার মতো করেই করেছি।
শুভ্র: আপনার এত সব বোলিং কীর্তির মধ্যে সেরা বলে একটা বেছে নেওয়া কি সম্ভব?
অ্যামব্রোস: খুব কঠিন। অনেকই তো আছে। তার পরও কয়েকটার কথা বলতে পারি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৯২-৯৩ সিরিজের পার্থ টেস্টে ১ রানে ৭ উইকেটের ওই স্পেল আমার ক্যারিয়ারে বিশেষ একটা মুহূর্ত। কারণ ওটা আমাদের সিরিজ জিতিয়েছিল। আমাদের বেশ কজন গ্রেট প্লেয়ার অবসরে যাওয়ায় আমরা আন্ডারডগ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলাম। অধিনায়ক হিসেবে রিচি রিচার্ডসনের প্রথম সিরিজ, দলটাও ছিল খুব তরুণ। ব্রায়ান লারা মাত্র দুই টেস্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে গিয়েছিল ওই সফরে। সবাই ভেবেছিল, আমরা অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারব। জিতে ফেরাটা ছিল তাই দারুণ একটা আনন্দ।
ত্রিনিদাদে ইংল্যান্ডকে ৪৬ রানে অলআউট করে দেওয়াটা আরেকটা স্মরণীয় স্মৃতি (২৪ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন অ্যামব্রোস)। ২২ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোটাও। বারবাডোজের ওই টেস্টে ওরাই জিতবে বলে ধরে নিয়েছিল। এমন অনেক আছে, তবে আমার কাছে সব সময়ই ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের চেয়েও বড় ছিল দল। আমি যখন দলে ঢুকি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন বিশ্বের সেরা দল। সেই মর্যাদাটা ধরে রাখাটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রেরণা।
শুভ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্তমান দুর্দশা দেখাটা তো আপনার জন্য তা হলে খুব যন্ত্রণার ব্যাপার, তাই না?
অ্যামব্রোস: খুবই যন্ত্রণার। আমরা অবসর নেওয়ার অনেক আগে থেকেই কিন্তু লক্ষণটা দেখা যাচ্ছিল। আমি জানতাম, একসময় না একসময় আমাদের রাজত্ব শেষ হবেই। চিরদিন আপনিই জিতে যাবেন, এটা তো আর হয় না। তবে আমাদের অবস্থা যে এতটা খারাপ হবে, এটা আমি কল্পনাও করিনি। ভবিষ্যতে আবার যে আগের অবস্থায় ফিরে যাব, তার কোনো সম্ভাবনাও আমি দেখছি না। আমি যে এখন খুব একটা খেলা দেখি না, তার একটা কারণ বলতে পারেন এটিকেও—ওয়েস্ট ইন্ডিজের এমন দুর্দশা দেখাটা আমার জন্য খুব কষ্টের।
শুভ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামতে নামতে এই যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজেও তো এ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে আশাবাদী কাউকে পাচ্ছি না। টনি কোজিয়ার যেমন সেদিন বলছিলেন, এটা শুধু ক্রিকেটের সমস্যা নয়। ক্যারিবিয়ানের বিভিন্ন দেশের মধ্যে রেষারেষিরও বড় ভূমিকা এতে।
অ্যামব্রোস: হ্যাঁ, এটা অবশ্যই একটা সমস্যা। তবে সত্যি বলতে, এই সমস্যা সব সময়ই ছিল। আগের সঙ্গে এখনকার পার্থক্য হলো, সে সময়ের খেলোয়াড়েরা এমন অসাধারণ প্রতিভাবান ছিল যে, কে কোত্থেকে এসেছে তাতে কিচ্ছু আসত-যেত না। ওরা ঠিকই জিতত। এখনকার খেলোয়াড়েরা ওই পর্যায়ের নয়। এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখলে আমার খুব দুঃখ লাগে। আমরা ভুলটা কোথায় করেছি জানেন, যখন আমরা বিশ্বের সেরা দল ছিলাম, ভেবেছি সারা জীবনই আমরা এমন দারুণ প্রতিভাবান সব খেলোয়াড়ের জন্ম দিয়ে যাব। কিন্তু সেটা কি আর হয় নাকি? আর শুধু প্রতিভা দিয়েই হয় না, প্রতিভাকে পরিচর্যা করতে হয়। অন্য দেশগুলো পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে তা করেছে, আর আমরা নিশ্চিন্তে বসে থেকেছি। একদিন ওরা আমাদের ধরে তারপর ছাড়িয়ে গেছে।
শুভ্র: একটা সময় তো আমরাও এমন শুনতাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রতিভার ছড়াছড়ি। নারিকেল গাছ থেকে যেমন নারিকেল পড়ে, তেমনি একটার পর একটা ফাস্ট বোলার...
অ্যামব্রোস: ওটাই তো সমস্যাটা করেছে। আমাদের এখানে সবাই ভেবেছে, কাউকে ধরে মাঠে নামিয়ে দিলেই সে ফাটিয়ে দেবে। ক্রিকেটটা এখন আর এমন নেই। এখন সবকিছু অনেক গোছানো হতে হয়। একাডেমি–টেকাডেমি করে প্রতিভার পরিচর্যা করতে হয়, যাতে টেস্ট ক্রিকেটে এসে কাউকে অপ্রস্তুত বলে মনে না হয়। আমরা তা করিনি বলেই এখন তার মূল্য দিয়ে যাচ্ছি।
শুভ্র: আপনার দেখা সেরা ফাস্ট বোলার বলবেন কাকে?
অ্যামব্রোস: আমার সময়ের আগের কথা যদি বলেন, আমি স্যার রিচার্ড হ্যাডলিতে খুব গুণমুগ্ধ ছিলাম। নিউজিল্যান্ড দলটাকে তো বলতে গেলে তিনি একাই টেনে নিয়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের মতো তিন–চারজন ফাস্ট বোলার ছিল না। যা করার তাঁকে একাই করতে হয়েছে। তারপরও দিনের পর দিন কী দারুণ পারফরম্যান্স করে গেছেন! অলরাউন্ডারদের মধ্যে ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম ও পাকিস্তানের ইমরান খানকে খুব পছন্দ করতাম। গ্রেট ক্রিকেটার্স! তবে আমার সময়ের কথা যদি বলেন, যে দুজনে আমি সব সময় মুগ্ধ হয়ে ছিলাম, তারা হলো গ্লেন ম্যাকগ্রা আর ওয়াসিম আকরাম। সব সময় আশা করে এসেছি, বিশ্ব একাদশ বা এমন কোনো দলে আমরা তিনজন একসঙ্গে খেলব। ওদের দুজনের সঙ্গে বোলিং করতে পারব। কিন্তু এটা হয়নি।
শুভ্র: ব্যাটসম্যানদের কপাল ভালো যে হয়নি! এক দলে ম্যাকগ্রা-আকরাম-অ্যামব্রোস, ব্যাটসম্যানদের তো ম্যাচ শুরুর আগে দল বেঁধে আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা!
অ্যামব্রোস (অট্টহাসি দিয়ে): ইট উড হ্যাভ বিন ইন্টারেস্টিং। ইট উড হ্যাভ বিন ইন্টারেস্টিং। আমি শেন ওয়ার্নের সঙ্গে একবার খেলেছি। ল্যাশিংসের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ওর সঙ্গে খেলাটা ছিল দারুণ আনন্দের, এত বড় স্পিনার। ম্যাকগ্রা আর আকরামের সঙ্গে খেলার আশাও ছেড়ে দিইনি। কে জানে, কখনো খেলা হয়েও যেতে পারে।প্রশ্ন: হ্যাডলিকে এত পছন্দ করতেন বলেই কি তাঁর মতো আপনার হাতেও সব সময় ওই রিস্টব্যান্ডটা থাকত?
অ্যামব্রোস: ঠিক হ্যাডলিকে দেখে নয়। রিস্টব্যান্ডটা ছিল আমার ক্রিকেট-পোশাকের অংশ। আমার হাত খুব ঘামত, ঘেমে পিচ্ছিল হয়ে যেত। রিস্টব্যান্ডটা পরতাম সে কারণেই।
শুভ্র: আপনার রিস্টব্যান্ড নিয়ে তো অস্ট্রেলিয়ায় একটা ঘটনাও ঘটেছিল। ডিন জোন্স না কোন ব্যাটসম্যান যেন তাঁর সাদা বল দেখতে সমস্যা হচ্ছে বলে সেটি খুলে ফেলতে বাধ্য করেছিলেন। আপনি রেগেমেগে ওদের উড়িয়ে দিলেন এরপর!
অ্যামব্রোস: আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। আরে, সারা জীবন আমি রিস্টব্যান্ড পরে বোলিং করে গেলাম আর ওই ব্যাটা নাকি ওটা খুলে ফেলতে বলছে! আমি জানি না, ওর উদ্দেশ্যটা কী ছিল! হয়তো আমাকে একটু... করতে চেয়েছিল।এটা ছিল একটা বড় ভুল। রেগে গেলে আমি খুব বিপজ্জনক। ওটা ছিল একটা ওয়ানডে ম্যাচ, যেটি দেখে থাকলে আপনি জানেন, কৌশলটা কেমন বুমেরাং হয়েছিল। আমি ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছিলাম। (হাসি) ওই যে বলেছি, আমাকে রাগালে খুব বিপদ। কার্টলি অ্যামব্রোসকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখাটাই নিরাপদ।
শুভ্র: স্টিভ ওয়াহ ব্যাপারটা খুব ভালো জানেন!
অ্যামব্রোস: (হাসি) তাই নাকি?
শুভ্র: কেন আপনি স্টিভ ওয়াহর আত্মজীবনীটা পড়েননি?
অ্যামব্রোস: না, আমার তেমন পড়ার অভ্যাস নেই।
শুভ্র: সেটিতে স্টিভ ওয়াহ লিখেছেন, ১৯৯৫ সালের ওই পোর্ট অব স্পেন টেস্টে আপনি যখন তাঁর দিকে তেড়ে যেতে চাচ্ছিলেন, মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হয়েছিল মৃত্যু বোধহয় সমাসন্ন!
অ্যামব্রোস: হা। হা। হা। না, ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। গ্রেট ক্রিকেটার।
শুভ্র: স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে তো আপনার প্রায় হাতাহাতিই হয়ে যাচ্ছিল। রিচি রিচার্ডসন আপনাকে টেনে নিয়ে যাওয়ায় রক্ষা। এমন শারীরিক না হোক, বোলিংয়ের সময়ে কোনো ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে নিশ্চয়ই এমন লড়াই অনেক হয়েছে।
অ্যামব্রোস: এমন তো অনেকই হয়েছে, ব্যাটসম্যানরা আমার ওপর চড়াও হতে চেয়েছে। একটু ছন্দে এসে গেলে আমাকে মারা খুব কঠিন হবে জেনেই হয়তো ওরা এমন করত। ভাবত, শুরুতেই মেরে-টেরে আমার বোলিংটা এলোমেলো করেদেওয়া যাবে। এই চ্যালেঞ্জটা আমি উপভোগই করতাম। এমন পরিস্থিতি মাথা খাটাতে বাধ্য করে, আপনাকে আরও ভালো ক্রিকেটার বানায়। কখনো আমি জিতেছি, কখনো হেরেছি। তবে আমার মনে হয় জিতেছিই বেশি।
শুভ্র: আপনাকে মারা তো ছিল খুব কঠিন। আমার তো খুব বেশি মনে পড়ে না, আপনার এক ওভারে দুটির বেশি চার দেখেছি বলে!
অ্যামব্রোস: আরে না, ওয়ানডেতে তো কখনো কখনো মার খেয়েছিই। ১৯৮৮-৮৯-এ অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম সফরে স্টিভ ওয়াহ আমাকে পরপর তিনটি চার মেরেছিল। একবার শারজায় আমার এক ওভারে ২০ রান নিয়েছিল ইমরান খান। ওটা ছিল ম্যাচের শেষ ওভার। ওয়ানডে খেলাটাই এমন। তবে টেস্ট ক্রিকেটে কেউ আমাকে খুব মেরেছে বলে এমন মনে পড়ে না।
শুভ্র: একটা দীর্ঘ সময় আপনি আর কোর্টনি ওয়ালশ মিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাজত্বটা টিকিয়ে রেখেছিলেন। ব্যাটসম্যানরা ডুবিয়ে দিয়ে এসেছে, এমন অনেক ম্যাচও আপনারা জিতিয়েছেন? ব্যাটসম্যানদের ওপর কখনো রাগ হতো না?
অ্যামব্রোস: পেশাদার ক্রিকেটার কখনো ব্যাটসম্যান-বোলার ভাগ করে না। সবাই মিলে একটা দল। কাজেই ব্যাটসম্যানরা খারাপ করলে আমাদের দায়িত্ব ছিল সেটা পুষিয়ে দেওয়া। একইভাবে কখনো আমরা বোলাররা খারাপ করে প্রতিপক্ষ চার শ-টার শ তুলে ফেললে তখন ব্যাটসম্যানদের কাজ হতো আমাদের ম্যাচে ফিরিয়ে আনা। এটা সত্যি, আমাদের দলে তরুণ যেসব ফাস্ট বোলার এসেছিল, ওরা প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি। আমাদের ওপর তাই খুব চাপ পড়ত। তবে এ নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। আমরা উপভোগই করেছি।শুভ্র: টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা বোলিং জুটিও অ্যামব্রোস-ওয়ালশ। লোকে শুধু ব্যাটিংয়ে পার্টনারশিপের কথা বলে, বোলিংয়েও তো এটা জরুরি, তাই না?
অ্যামব্রোস: অবশ্যই। আমি আর ওয়ালশ শুধু বোলিং পার্টনারই ছিলাম না, আমরা খুব ভালো বন্ধুও। একে অন্যকে খুব ভালো বুঝতে পারতাম, মাঠে বেশি কথাবার্তাও বলতে হতো না। আমরা কখনোই একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিনি। যখন ওর দিন, ও উইকেট পাচ্ছে, আমি নিশ্চিত করেছি আমার দিক থেকে সহজে রান না হয়। একইভাবে যেদিন আমার দিন, ওয়ালশও তা-ই করেছে।
শুভ্র: আপনার সময়টায় বিশ্ব ক্রিকেটে লারা বনাম টেন্ডুলকার একটা তর্ক ছিল। আপনি কোন দলে?
অ্যামব্রোস: আমি এই তুলনাতেই যেতে চাই না। তুলনা আসলে হয়ও না। দুজনই গ্রেট ক্রিকেটার, তবে দু রকম। লারা অনেক বেশি ফ্ল্যাম্বোয়েন্ট, প্রচুর শট খেলত, ও ছিল সত্যিকার এক এন্টারটেইনার। টেন্ডুলকার আস্তে আস্তে ইনিংস গড়ে তুলত। লারাও তা করত না বলছি না। ইনিংস গড়ে তুলতে না জানলে আপনি ৫০১, ৪০০ রানের ইনিংস খেলতে পারেন না।
শুভ্র: ব্যাটসম্যান লারাকে নিয়ে আসলে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কিন্তু ফ্রাঙ্ক ওরেল, ক্লাইভ লয়েডদের মতো লারা তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে বদলে দিতে পারেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে কী লিগেসি রেখে গেছেন লারা?
অ্যামব্রোস: এঁরা সবাই একেক যুগের প্রতিনিধি। কারও সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। কারণ ক্রিকেট অনেক বদলে গেছে। ব্যাটসম্যান হিসেবে লারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য অনেক করেছে। হাজার হাজার রান করেছে। ব্যাটসম্যান লারার কোনো দোষ আপনি খুঁজে পাবেন না। তবে অধিনায়ক হিসেবে ও এমন কোনো সাফল্য পায়নি। ওর ক্যাপ্টেন্সি রেকর্ড মোটেই বলার মতো কিছু নয়। তবে এটিকে তাঁর বিরুদ্ধে ধরলে চলবে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের জন্য লারা অনেক করেছে।
শুভ্র: ক্যারিয়ারে অনেক কমপ্লিমেন্টই তো পেয়েছেন। সবচেয়ে স্মরণীয় কোনটি?
অ্যামব্রোস: কমপ্লিমেন্ট এত পেয়েছি যে, একটা আলাদা করা কঠিন। তবে আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত হলো, ওভালে শেষ টেস্ট খেলার পর আমাকে বিদায় দিতে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের দেওয়া গার্ড অব অনারটা। এমন কিছু আমি আঁচ করতে পারিনি। ওরা দুপাশে দাঁড়িয়ে, আমি মাঝখান দিয়ে শেষবারের মতো বেরিয়ে যাচ্ছি—ওটা ছিল খুব আবেগময় মুহূর্ত। এটাকে আমার মনে হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার সাড়ে বারো বছরের অবদানের স্বীকৃতি।