`আমরাও খেলতে জানি, একটু সময় লাগবে, এই যা!
উৎপল শুভ্র
৫ অক্টোবর ২০২১
ইংল্যান্ডে প্রথম টেস্ট সিরিজের পর বাংলাদেশ খেলেছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ত্রিদেশীয় ন্যাটওয়েস্ট ওয়ানডে সিরিজ। যেটিতে হারিয়েছে সে সময়ের বিশ্বসেরা দল পরাক্রান্ত অস্ট্রেলিয়াকে। টেস্ট সিরিজে মাত্র ৪ উইকেট পেয়েছেন মাশরাফি, ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে ৫ ম্যাচে মাত্র ১টি। যেটি তত দিনে তিন-তিনবার অপারেশন টেবিলে উঠে যাওয়া তরুণ ফাস্ট বোলারের দুর্দান্ত বোলিং একটুও বোঝাতে পারছে না। কেন্টের ক্যান্টারবুরিতে সফরের শেষ ম্যাচের পর নেওয়া এই সাক্ষাৎকারের শিরোনামটাই বলে দিচ্ছে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ দলকে দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলেন মাশরাফি।
প্রথম প্রকাশ: ২৯ জুন ২০০৫। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: ইংল্যান্ড পেস বোলারদের স্বর্গ-এমনই তো জানে সবাই। তা ইংল্যান্ডে প্রথম সিরিজ খেলার পর কী মনে হলো?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: ইংল্যান্ডে আসার আগে আমিও শুনেছিলাম, এখানে মাঠ-উইকেট সব নাকি পুরোপুরি বোলারদের পক্ষে। কিন্তু এখানে আসার পর প্র্যাকটিস ম্যাচে খেলার সময়ই বুঝতে পেরেছি, এখানে অনেক কষ্ট করতে হবে। আসার আগে ভেবেছিলাম, এখানে বল করলে বলই যা করার করবে। আসলে তা নয়। আরেকটা সমস্যা আমাদের দেশে পুরোনো বলে ভালো করা যায়। সিমের আড়াআড়ি ধরে বল করলে বাউন্সটা অসমান হয়, ব্যাটসম্যানদেরও সমস্যা হয়। এখানে বল পুরোনো হয়ে গেলে কাজটা খুব কঠিন হয়ে যায়। তার ওপর যে দুটি দলের সঙ্গে খেলেছি, তারা বিশ্বের এক ও দুই নম্বর দল। দু'দলই, বিশেষ করে ইংল্যান্ড এ ধরনের উইকেটে খেলেই অভ্যস্ত।
শুভ্র: সব মিলিয়ে এই সিরিজটা আপনার কেমন গেল?
মাশরাফি: সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, পুরো সিরিজে আমি ফিট ছিলাম। গড়ে ৮০-৮২ মাইল গতিতে বোলিং করেছি, সর্বোচ্চ ছিল ঘণ্টায় ৮৪ মাইল। আমি আগে তা করতে পারিনি। টেস্ট সিরিজে শেষ দিকে ওরা সব বলেই চালিয়েছে বলে আমার ইকোনমি রেট কখনো কখনো চার হয়ে গেছে, তবে আমার মনে হয়, আমি ভালো জায়গাতেই বল করেছি। বোলিং করে মজাও পেয়েছি। যদিও দুই ইনিংসে দুই-দুই করে চারটির বেশি উইকেট পাইনি, অনেক সময় লাকও ফেভার করেনি। তবে সবকিছুর পর টানা দুই মাস যে আমি খেলে যেতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে বড়।
শুভ্র : ফিট থাকাটাই যে আপনার কাছে বড় মনে হচ্ছে, তার কারণ নিশ্চয়ই আপনার ইনজুরির ইতিহাস। ইনজুরিতে পড়ার আগে যেমন বোলিং করতেন, এখনো কি তা করতে পারেন? জোরে বল করার ক্ষেত্রে তো একটু আপস করতেই হয়েছে।
মাশরাফি: চাইলে আমি এখনো জোরে বল করতে পারি। কিন্তু তা করার চেষ্টা করি না, কারণ এখন আমি বুঝি গতির চেয়ে কোথায় বল ফেলছি সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আগে আমি শুধু জোরেই বল করতে চাইতাম, অনেক কিছুই জানতাম না। এখন সুইংয়ের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ অনেক ভালো। আউট সুইঙ্গারটা আমার ন্যাচারালই ছিল, ইনসুইংটা শিখতে হয়েছে, ইমরান স্যার (কোচ সারওয়ার ইমরান) আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। ভারতের বিপক্ষে শেবাগ-টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়কে আমি ইনসুইংয়ে এলবিডব্লিউ করেছি। দ্রাবিড় তো আউটসুইং ভেবে আমার বল ছেড়ে দিতে গিয়ে আউট হয়েছে। এখন আমি সিমের ওপর কীভাবে বেশি বল ফেলা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি। হার্মিসন আমাকে বলেছে, আমি তো আগে এমন কোনো বোলার ছিলাম না। সিমের ওপর বেশি বল ফেলতে পারি বলেই এখন সাফল্য পাই। সিমের ওপর বল পড়লে বাড়তি বাউন্স করে, কখনো স্কিড করে।
শুভ্র: ইনজুরির কথা না তুলতে চাইলেও আপনার ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলতে গেলে সেটি এসেই যায়। ইনজুরিতে হারানো সময়টা নিয়ে নিশ্চয়ই আক্ষেপ হয়?
মাশরাফি: আমার শুধু মনে হয়, ইনজুরিতে না পড়লে এত দিনে আমার ১০০ উইকেট হয়ে যেত। দুবারই আমি সেরা ফর্মে থাকা অবস্থায় ইনজুরিতে পড়েছি। নিউজিল্যান্ডে ইনজুরিতে পড়ার আগে আমি ৩ উইকেট নিয়েছিলাম, কেয়ার্নস আর প্যারোরের মতো ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে ১২ ওভারের একটা স্পেলে মাত্র ৫ কি ৬ রান দিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে যখন ইনজুরিতে পড়লাম, তিন ইনিংসে আমার ৮ উইকেট। একটাই আফসোস হয়, ওই সময়টা নষ্ট না হলে এত দিনে আমি আরও অনেক কিছু শিখতে পারতাম।
শুভ্র: এই সিরিজে নিয়মিতই দেখা গেছে, আপনি একদিক থেকে খুব টাইট বোলিং করছেন, কিন্তু অন্য প্রান্তের বোলার আর চাপটা ধরে রাখতে পারছেন না। এটা তো খুবই হতাশাজনক, তাই না?
মাশরাফি: আমি একটা জিনিসে বিশ্বাস করি, আমার বোলিং তো আমার কাছে। আমিও দেশের পক্ষে খেলছি, তাপস-নাজমুলও দেশের পক্ষেই খেলছে। দেশের জন্য ওদের ফিলিংস তো আমার চেয়ে কম নয়। ওরাও ভালো বোলার, নইলে তো আর এখানে খেলার সুযোগ পেত না। আমিও তো এখানে অনেক ম্যাচেই শুরুতে ব্রেক থ্রু দিতে পারিনি। যে ম্যাচটিতে দিয়েছি, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সেই ম্যাচে আমরা জিতেছি। ওই ম্যাচে তাপসও বেশ কবার ব্রেক থ্রু দিয়েছে।
শুভ্র: পেস বোলাররা তো জোড়া বেঁধে শিকার করে। তা পার্টনার হিসেবে কাকে আপনার পছন্দ?
মাশরাফি: আমি যখন শুরু করি, তখন আমার সঙ্গে ছিল মঞ্জু ভাই (মঞ্জুরুল ইসলাম) ও শরীফ। এরপর তাপসের সঙ্গেই আমি সবচেয়ে বেশি বোলিং করেছি। হয়তো এ কারণেই ওর সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটাও সবচেয়ে ভালো।
শুভ্র: বলতে গেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরুর দিনটি থেকেই আপনি বাংলাদেশের মূল স্ট্রাইক বোলার। নির্ভার হয়ে খেলার সুযোগই হয়নি আপনার। এই চাপটাকে আপনি কীভাবে সামলেছেন?
মাশরাফি: সত্যি বলছি, আমার সেভাবে চাপ-টাপ কিছু মনে হয়নি। টেস্টে খুব কমই হয়েছে যে, আমি ব্রেক থ্রু দিতে পারিনি। সাত না আটবার আমি ইনিংসে ৩ উইকেট নিয়েছি, তিনবার নিয়েছি ৪ উইকেট। খুব খারাপ তো করিনি। যখন খারাপ সময় আসবে, তখন হয়তো চাপ মনে হবে।
শুভ্র: কিন্তু এখন পর্যন্ত তো টেস্টে আপনার ইনিংসে ৫ উইকেট নেই!
মাশরাফি: এটা আমারও দুঃখ। আমাদের ট্রেনারও (স্টুয়ার্ট কার্পিনেন) বলে, টেস্টে তোমার অ্যাভারেজ ৩০, এটা খারাপ নয়। তবে যদি এটা ২৫ হতো আর ইনিংসে দুবার ৫ উইকেট থাকত, তাহলে তা আরো ভালো হতো। আমার লক্ষ্যও এখন এটাই।
শুভ্র: ইংল্যান্ডের এক কাগজ লিখেছে, আপনার পর বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় সেরা বোলার স্টুয়ার্ট কার্পিনেন!
মাশরাফি: আপনি তো ইংল্যান্ডের লোকজনকে চেনেন, এদের কাজই হলো ছোটকে আরও ছোট করে দেখানো।
শুভ্র: ইংলিশ মিডিয়া ভালোই যন্ত্রণা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে!
মাশরাফি: শুরুর দিকে খারাপ লেগেছে। তবে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর আর এসব মনে থাকেনি। এর আগে আমরা ভারত-পাকিস্তানকে হারানোর পরও আমাদের দেশের অনেকে অনেক আজে-বাজে কথা বলেছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের পর আর কিছু বলার সুযোগ নেই। কারণ সবাই জানে, অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের সবচেয়ে পজিটিভ দল। এক রান বাকি থাকতেও ওরা ম্যাচ ছাড়ে না। এই জয় প্রমাণ করেছে, আমরাও খেলতে জানি। আমাদের একটু সময় লাগবে, এই যা।
শুভ্র: কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬ ওভারের প্রথম স্পেলে ৫ রান দিয়ে ১ উইকেট...ওয়ানডেতে এটাকেই কি আপনার জীবনের সেরা স্পেল বলবেন?
মাশরাফি: অস্ট্রেলিয়ায় ডারউইনে শেষ ওয়ানডেতে এই গিলক্রিস্ট আর হেইডেনের বিপক্ষেই আমি ৬ ওভারে ১১ রান দিয়েছিলাম। এবার শুধু ৬ ওভারে ৫ রান দিয়েছি বলেই নয়, যেভাবে বোলিং করেছি, তাতে এটাই আমার সেরা স্পেল।