কেপলার ওয়েসেলসের একান্ত সাক্ষাৎকার

`যতবার ভাবি, ততবারই লজ্জা পাই`

উৎপল শুভ্র

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

`যতবার ভাবি, ততবারই লজ্জা পাই`

কেপলার ওয়েসেলস। ছবি: জন গাস

অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে টেস্ট অভিষেক। পরে মাতৃভূমি দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ক্রিকেটে ফেরে তাঁর নেতৃত্বেই। ৪০টি টেস্ট খেলেছেন, ১০৯টি ওয়ানডে। দুটি ভিন্ন দেশের পক্ষে সেঞ্চুরি করার একমাত্র কীর্তি তাঁর। কেপলার ওয়েসেলসের খেলোয়াড়ি জীবন নিয়ে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলাম ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠের মিডিয়া সেন্টারের ছাদে বসে।

উৎপল শুভ্র: দুই দেশের পক্ষে খেলার ব্যাপার তো আছেই, এর বাইরেও আপনি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছেন সাতটি দলের হয়ে। একটু ব্যতিক্রমীই বলতে হবে...

কেপলার ওয়েসেলস: নানা কারণে এটি হয়েছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক কারণও ছিল। আমি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রথম বাইরে খেলতে যাই সাসেক্সে। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় কুইন্সল্যান্ডে। কুইন্সল্যান্ডের পক্ষে আমি ১৩ বছর খেলেছি। আমি বলব, আমার ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা ওখানেই কাটিয়েছি। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঁচটি দলে খেলেছি। একেক সময় একেক কারণে দল বদলেছি।

শুভ্র: দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ বলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হলে অন্য কোনো দেশের পক্ষে খেলতে হতো। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার পক্ষেই কেন?

ওয়েসেলস: প্রথম কারণ তো আপনি যেটা বললেন, দক্ষিণ আফ্রিকার নিকট ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার কোনোই সম্ভাবনা ছিল না। ইংল্যান্ড না হয়ে অস্ট্রেলিয়া কেন, এটা একটা প্রশ্ন বটে। আসলে কুইন্সল্যান্ডের পক্ষে খেলতে গিয়েই আমি অস্ট্রেলিয়াকে পছন্দ করে ফেলি। ওদের ক্রিকেট-সংস্কৃতি, যেভাবে ক্রিকেটটা খেলে, সবকিছুই ভালো লেগে যায়।অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেকে। ১৬২ রান করে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন যে উপলক্ষটা। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: টেস্ট অভিষেকটা যদিও অনেক বছর আগের কথা, তারপরও সেই অনুভূতিটা নিশ্চয়ই মনে আছে এখনো। সেঞ্চুরি দিয়ে অভিষেক, সেটিও ১৬২...

ওয়েসেলস: এ কি আর ভোলা যায়! তার ওপর এটি ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাশেজ, সেটিও আমার হোমগ্রাউন্ড ব্রিসবেনে। ওই ইনিংসটির সবচেয়ে বেশি যা মনে পড়ে, তা হলো, আমার সঙ্গে ব্যাটিং করার সময় গ্রেগ চ্যাপেল রান আউট হয়ে যায়। গ্রেগ তখন অধিনায়ক। বুঝতেই পারছেন আমার অবস্থাটা! জানতাম, রান না করে ড্রেসিংরুমে ফিরলে কপালে দুঃখ আছে (হাসি)।

শুভ্র: টেস্টে আপনার ছয় সেঞ্চুরির প্রথম চারটিই খুব বড় (১৬২, ১৪১, ১৭৯, ১৭৩)। এর রহস্য কী?

ওয়েসেলস: আমার লম্বা সময় ধরে ব্যাটিং করার ক্ষমতা ছিল। এর একটা কারণ ছিল, আমি শারীরিকভাবে খুব ফিট ছিলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং করেও ক্লান্ত হতাম না।

শুভ্র: শারীরিকভাবে ফিট থাকার সঙ্গে লম্বা ইনিংস খেলার যে সম্পর্কের কথা বললেন, সেটিই বোধ হয় ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে উপেক্ষিত দিক। টেকনিক-মানসিক শক্তি এসব নিয়ে এত কথা হয়, এটা খুব একটা মনোযোগ পায় না.....

ওয়েসেলস: ঠিক বলেছেন। অথচ ঘটনা হলো, বড় ইনিংস খেলতে হলে আপনাকে শারীরিকভাবে ফিট হতেই হবে। যখনই আপনি শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন, তখনই মনোসংযোগে চিড় ধরবে।স্ত্রী স্যালি ওয়েসেলসের সঙ্গে। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: পরাক্রান্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৬ অ্যাভারেজ সম্ভবত আপনার ক্যারিয়ারের হাইলাইট। ১৯৮৪ সিরিজে একটা শূন্য ছিল, বাকি পাঁচ ইনিংসে ৬১, ৯৮, ৭০, ৯০ ও ১৭৩। খুব বেশি ব্যাটসম্যানের তো এই কৃতিত্ব নেই...

ওয়েসেলস: নিঃসন্দেহে আমার সেরা সিরিজ। এই ছয়টা সপ্তাহ আমি আমার শারীরিক ও মানসিক দক্ষতার তুঙ্গে ছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে তখন বোলার কারা—গার্নার, মার্শাল, ওয়ালশ...ওই পেস অ্যাটাকের বিপক্ষে ধারাবাহিকভাবে রান করে যাওয়াটাকে আমি বড় একটা অর্জনই বলব।

শুভ্র: কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? অমন চারজন ফাস্ট বোলার টানা বোলিং করে যাচ্ছে, এক মুহূর্ত রিল্যাক্সড হওয়ার সুযোগ নেই..

ওয়েসেলস: বড় চ্যালেঞ্জ তো ছিলই। তবে আমার শুধু গার্নারকে খেলতেই একটু সমস্যা হতো। ওই লম্বা শরীর, প্রায় গুড লেংথ থেকে বল তুলত, ইয়র্কারও ছিল দুর্দান্ত। গার্নার আমাকে অনেকবার আউট করেছে। তবে বাকিদের খেলতে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। হ্যাঁ, গায়ে-টায়ে তো বল অনেকই লেগেছে। আমিও পাল্টা আক্রমণ করেছি। একটা সুবিধা ছিল, কাটটা খুব ভালো খেলতাম।১৯৯২ বিশ্বকাপে খেলতে নেমেছিলেন পুরোনো দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে শেষ টেস্টেও আপনার ৭০ রানের একটা ইনিংস আছে। তারপরও রেবেল ট্যুরে যোগ দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গিয়েছিলেন কেন?

ওয়েসেলস: পরিস্থিতিই আমাকে বাধ্য করেছিল। তখন অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ডের সম্পর্কে প্রচণ্ড টানাপড়েন চলছিল। বলতে পারেন, তীব্র শত্রুতাই। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া দলে আমি এক দক্ষিণ আফ্রিকান। বোঝেন অবস্থা! টিমমেটরা সব ঠিকই ছিল, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের আচরণ খুব ভালো ছিল না। পরে অবশ্য একটু আফসোসও হয়েছে। মনে হয়েছে, আমার বোধ হয় একটা ব্রেক নিয়ে কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখা উচিত ছিল। তবে এখন তো মনে হয়, ভালোই করেছিলাম। ভালোই করেছিলাম। নইলে তো ১৯৯২ বিশ্বকাপে ও প্রত্যাবর্তনের পর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্টে নেতৃত্ব দিতে পারতাম না।

শুভ্র: দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন—এই খবরটা জানার মুহূর্তটা কেমন ছিল?

ওয়েসেলস: আমরা, মানে খেলোয়াড়েরা তো ২৪ ঘণ্টা আগেও জানতাম না। আমি একটা ম্যাচ খেলছিলাম, হঠাৎ শুনলাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের ভারতে রওনা হতে হবে। প্রশাসকেরা নিশ্চয়ই আগে থেকে জানতেন, তবে খেলোয়াড়েরা কেউই না। অনুভূতির কথা আর কী বলব, দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারব, এটা তো কখনো কল্পনাই করিনি।

শুভ্র: ভারতে তো ওয়ানডে সিরিজ, এরপর ব্রিজটাউনে ফিরে আসার পর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্টে আপনি অধিনায়ক। দুই ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি। কিন্তু যেভাবে হেরেছিলেন, সব আনন্দই তো তাতে মুছে যাওয়ার কথা...

ওয়েসেলস: এটা বড় কষ্টের স্মৃতি। শেষ দিন হাতে ৮ উইকেট নিয়ে আমাদের মাত্র ৭৯ রান প্রয়োজন ছিল। আমি জানতাম, দলটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ম্যাচ জিতে গেছি ভাবলে ভুল হবে। কিন্তু দলের কিছু খেলোয়াড় অন্য রকম ভেবেছিল।কেপলার ওয়েসেলস

শুভ্র: টেস্টটা ব্রিজটাউনে হওয়াটাও নিশ্চয়ই সাহায্য করেনি, সেখানে তো পার্টির অবারিত আহ্বান। দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক খেলোয়াড় নাকি সারা রাত পার্টি করেছিল...

ওয়েসেলস: আর বলবেন ন!। তার ওপর শেষ দিনের আগে ছিল টেস্টের রেস্ট ডে, ওটা আরও সর্বনাশ করেছিল। তবে এটাও ঠিক, অ্যামব্রোস ও ওয়ালশ দুর্দান্ত বোলিং করেছিল। বল এমন রিভার্স সুইং করাচ্ছিল যে, আমাদের ব্যাটসম্যানরা সামলাতে পারেনি।

শুভ্র: ব্রিজটাউনে দুই ইনিংসে ৫৯ ও ৭৪, পরের টেস্টেই ভারতের বিপক্ষে ১১৮। তারপরও সেই সিরিজ শেষে অবসর নিয়ে ফেললেন কেন?

ওয়েসেলস: বয়সটা আসলে বেশি হয়ে গিয়েছিল। বলতে পারেন, বুড়ো হয়ে গিয়েছিলাম (হাসি)। আমি নিজেই সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যদিও অধিনায়কত্ব ছেড়ে তিন নম্বরে ব্যাটিং করার একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আমাকে।

শুভ্র: ভারতের বিপক্ষে ওই সিরিজের একটা ঘটনা আপনাকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা অনেক দিনের। টিভিতে দেখেছিলাম, একটা ওয়ানডেতে রান নেওয়ার সময় আপনি কপিল দেবের পায়ে ব্যাট দিয়ে মেরেছিলেন। এই অস্বাভাবিক কাণ্ডটা কেন করেছিলেন?

ওয়েসেলস: (বিব্রত হাসি) এই একটা ব্যাপার যা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। ঘটনাটা মুছে দিতে পারলেই ভালো হতো। আসলে ওই সিরিজটা ছিল খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। হঠাৎ মাথা গরম করে এমন একটা কাজ করে ফেলেছিলাম। যতবার ভাবি, ততবারই লজ্জা পাই।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×