ইংল্যান্ড ২: ইতালি ১
আসিফ নজরুল
১১ জুলাই ২০২১
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে উৎপলশুভ্রডটকম-এ লেখা কলামেই আসিফ নজরুল জানিয়েছিলেন, এবার ইউরোতে পাঁচটা দলের মাঝে সমর্থন বণ্টন করে দিয়েছেন শতকরা হিসাবে। সবচেয়ে বেশি ৪০ শতাংশ সমর্থন পেয়েছিল যে দল, সেই ইংল্যান্ড উঠে গিয়েছে ফাইনালে। মহারণের আগে ইংল্যান্ডের প্রতি পক্ষপাতিত্বর কথা জানালেন আবারও। ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে থাকল দুই ফাইনালিস্ট নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণও।
কাল রাতে আমি হানিফকে ফোন করি। সে আমার বাল্যবন্ধু, আর্জেন্টিনার কঠিন সাপোর্টার। তার বাসায় সারা দেয়াল জুড়ে সারাউন্ডিং সাউন্ড দিয়ে খেলা দেখার ব্যবস্থা আছে। তাকে বলি, 'খেলা দেখছিস নাকি রে!'
-দেখি মাঝে মাঝে। কোপা দেখি, মেসির খেলা!
-আমি তো এবার তোর দলের সার্পোটার।
-তাই নাকি! সে অবাক ব্রাজিল ভক্তের কথা শুনে।
আমি তাকে ব্রাজিলের পাজি প্রেসিডেন্টের কথা বুঝিয়ে বলি। চরম দুঃশাসন ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য সে ঘোর করোনাকালে কোপার আয়োজন করেছে ব্রাজিলে, পাগলের মতো প্রেডিকশন দিয়েছে, ফাইনালে ব্রাজিল জিতবে ৫-০ গোলে। এই ব্যাটার একটা শাস্তি হওয়া দরকার। এটা গতকাল ফেসবুকেও লিখেছি, জানাই হানিফকে। তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না ফোনে।
আমি বলি, 'ইংল্যান্ডের খেলা দেখেছিস?'
-নাহ্! এবার তার কণ্ঠে বিরক্তি, দেখে কী করব, জানতাম তো এমন হবে।
'এমন হবে'র খোঁচাটা রাহিম স্টার্লিং-এর সফট পেনাল্টি নিয়ে। এক সময় আমরা দুজনই ইংল্যান্ড হেটার ছিলাম। প্রায় পঁচিশ বছর আগে এক বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের সাথে রেফারির পক্ষপাতিত্বে জেতার পর থেকে আরও বেশি।
কিন্তু সেসব পুরানো দিনের কথা। আমি কি আর ইংল্যান্ড বিদ্বেষী আছি? নো, নট অ্যানি মোর। সেখানে পড়াশোনা করে আসার পর আর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা দেখার পর আমি তাদের বিরাট ভক্ত। এটা হানিফ জানে ভালো করে। তাহলে আমাকে স্টার্লিংয়ের পেনাল্টি নিয়ে খোঁচানো কেন? প্রতিশোধ নেয়ার কণ্ঠে বলি, 'আর তোমরা যে হাত দিয়ে গোল দিয়ে জেতো, সেটা কী?'
সে হাসে। কত বছর আগে ম্যারাডোনার হ্যান্ড অব গড! সেটা মনে করে অবশেষে আমিও হাসি। আহা কি খুশিই না হয়েছিলাম সেদিন!
আপোষের কণ্ঠে আমি বলি, পেনাল্টি সফট হলেও ডেনমার্কের সাথে বেটার টিম কিন্তু ইংল্যান্ডই ছিল!
-সেটা তো স্পেনও ছিল ইতালির সাথে!
-তা ছিল! স্পেনকে পেনাল্টি দিতে তো মানা করিনি।
হাসে সে। সঙ্গে বলে, 'আচ্ছা, ঠিক আছে, খেলা দেখতে আসবি তুই? তাহলে দেখব।'
আমি মনে মনে হিসাব করি। করোনাকালে খেলা দেখতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। করোনা না থাকলেও যেতাম না বোধ হয়। কারণ হানিফের বাসায় সব ইংল্যান্ড হেটার। ইতালি যা খেলছে, আজ রাতে ফাইনালে হেরেও যেতে পারে ইংল্যান্ড। জেনেশেুনে এই গঞ্জনার মধ্যে যাওয়ার কী দরকার! আমি অবশ্য করোনার অজুহাত দেই তাকে।
তারপর ফোন রেখে ভাবতে বসি। আসলে কি হারবে ইংল্যান্ড? তাদের রক্ষণভাগে চারজনই দুর্দান্ত খেলছে। এদের মধ্যে আবার ম্যাগুয়ের আর লুক শ আক্রমণেও অংশ নিতে ওস্তাদ। তাদের পর থাকে রাইস আর কেলভিন ফিলিপস, এই তরুণের রক্ষণভাগকে সাহায্য করার ক্ষমতা দেখার মতো। মাঝমাঠে ম্যাসন মাউন্ট আচমকা রক্ষণচেরা পাস দিতে সুনিপুণ। আক্রমণভাগে স্টার্লিং, কেন, সাকা খেলছে ফাটাফাটি।
আমার দুশ্চিন্তাটা কোথায় তাহলে? দুশ্চিন্তার প্রথম কারণ হচ্ছে ইংল্যান্ডের গোলকিপার। বিশেষ করে ডেনমার্কের সাথে এত বাজে বল ডিস্ট্রিবিউশন করেছে যে, এমন হলে ইতালি অবশ্যই সুযোগ নেবে। আর মাঝমাঠে রাইস ও ফিলিপ হচ্ছে নতুন খেলোযাড়, পেছনে প্রচুর পাস দেয়ার অভ্যাস আছে তাঁদের। এটা এত প্রেডিকটেবল যে, ইতালির কোচের নজর এড়াবে না তা।
দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, ইতালির খেলার এখনকার ধরনটা। আমরা যে ইতালিকে চিনতাম, তারা তিন খেলায় তিনটে ড্র আর দুটো গোল দিয়ে দ্বিতীয় পর্বে উঠত। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলেও দেখা যেত, মোট গোল করেছে ছয়টি বা সাতটি। সেই তারাই কিনা ফাইনালে আসার আগেই এবার গোল করেছে ১২টা! আরও অবাক ব্যাপার, দলটা এখন চিরায়ত রক্ষণশক্তি বজায় রেখেও দারুণ আক্রমণাত্মক খেলছে, বিশেষ করে হাফ চান্স থেকে তাদের গোল করার দক্ষতায় তাক লাগিয়ে দিচ্ছে সবাইকে।
তবে ইতালিরও সমস্যা আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা হিসেবে বিবেচিত সেন্ট্রাল ডিফেন্স। কিয়েলিনি আর বোনুচ্চির মতো বিশ্বসেরা দুই ব্যাক সেখানে খেলছেন অনেক বছর ধরে। কিন্তু তাদের বয়েস হয়েছে। ৩৫-এর কাছাকাছি এই দুই ‘বৃদ্ধ’ শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে সামাল দিতে পারবে স্টার্লিং-দের গতি আর স্কিলকে?
আরেকটা আশার দিক হচ্ছে ইতালির চেয়ে ইংল্যান্ডের রিজার্ভ বেঞ্চ শক্তিশালী। বিশেষ করে গ্রিলিশ বা সাঞ্চোর মতো খেলোয়ারদের ক্ষমতা রয়েছে একাই ক্লান্ত কোনো রক্ষণভাগ ছিন্নভিন্ন করে দেয়ার। মাঝমাঠে হেন্ডারসন বা নিচে ট্রিপিয়ার...বদলি খেলোয়াড় হিসেবে এরাও দারুণ হতে পারেন।
আমার লেখা পড়ে নিশ্চয়ই কারও বুঝতে বাকি নেই, ইংল্যান্ডের প্রতি আমার পক্ষপাত রয়েছে। সেটা সত্যি। ৫৫ বছর অপেক্ষা করেছে ফুটবলের জনক এই দেশটি আরেকটি বড় শিরোপা অর্জনের জন্য। ফুটবলের আর্থিক ভিতটা ধরে রাখতেও তাদের অবদান অসামান্য। তারা জিতলে তা ফুটবলের জন্য বেশি ভালো।
তবে ইতালি জিতলে বেশি দুঃখ পাব না আমি। কারণ এবার তারা সত্যি ভালো ও চিত্তাকর্ষক ফুটবল খেলেছে। ছোটবেলার অন্ধ সমর্থন করার মতো মনটা আর নেই আমার। ফাইনালেও যদি ইতালি বেশি ভালো খেলে, তাহলে ইতালিই জিতুক।
তবে আমি চাইব, ফাইনালে বেশি ভালোটা খেলুক আমার দল ইংল্যান্ড। খেলার রেজাল্ট হোক ইংল্যান্ড ২: ইতালি ১।