হকির গপ্পো

মেজর চাকলাদার (অব.)

২ জুলাই ২০২১

হকির গপ্পো

`স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে খেলার ৫০` ধারাবাহিকে কয়েকদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৫ এশিয়া কাপ হকির গল্প। ওই টুর্নামেন্ট দিয়েই দেশে এসেছিল হকির জোয়ার। যা পড়ে মেজর চাকলাদার (অব.) লোভ সামলাতে পারলেন না ওই টুর্নামেন্ট নিয়ে স্মৃতিচারণার। তাঁর পরিচয়টাও জানিয়ে দিই, সেবারের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই।

আমাদের সময় বর্ষাকালে হকির অনুশীলন হতো বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের পাশে একটা পরিত্যক্ত লন টেনিস মাঠে। সাদেক ভাই পাঁচজন করে দু'দল করে দিতেন, অনেক খেলোয়াড়ই বৃষ্টি ভেজা ঘাসের উপর টুকটাক স্টিক-ওয়ার্ক করত। জানত যে, সময় হলে সাদেক ভাই টেনিস মাঠের খেলোয়াড় বসিয়ে দিয়ে ডেকে নেবেন। এর ফলে প্রায় সবাই-ই খেলার সুযোগ পেত। সাদেক ভাই সবাইকে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সাব্বির ইউসুফ, মহসীন, ইব্রাহীম সাবের, প্রতাপ শংকর হাজরা, আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া, শামসুল বারী ভাই…সবাইকেই বসিয়ে দিতেন।

তখন ইউনিভার্সসিটি মাঠ ছিল সব খেলোয়াড়ের প্র‍্যাকটিসের জায়গা। ফুটবলার জহির ভাই, মানে জহিরুল হককে দেখতাম, প্রায় পঞ্চাশ গজ দূর থেকে গ্যালারির একটা পিলার টার্গেট করে বল মারছেন, রিটার্ন বলটা ড্রপ খাওয়ামাত্র আবার সেই পিলারে মারছেন... একবার-দুবার নয়, অনেকবার, কী অ্যাকুরেসি!

হকিতে পাঁচজনের খেলায় প্রচুর দমের প্রয়োজন আর প্রাতঃস্মরণীয়দের সাথে খেলতে পারাটা আমার হকির ভিত তৈরিতে বিরাট সাহায্য করেছিল। আমার বাবা মরহুম শামসুদ্দিন চাকলাদার তাঁর সময় দেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি একটা কথা সব সময় বলতেন, 'সব সময়ই মাঠে খেলতে হবে এমন নয়, বরং বড় খেলোয়াড়দের খেলা দেখো, তা দেখে অনেক কিছু শিখতে পারবে।' আমি সেটাই করেছি। আর্মি থেকে আমাকে কমান্ডো ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়েছিল, এটা আমার ফিটনেসের সঙ্গে হার না মানা মানসিকতাও তৈরি করে দিয়েছিল।

আমাকে যখন বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক করা হয়, সাদেক ভাই যেভাবে পক্ষপাতহীন হয়ে পাঁচজন করে খেলোয়াড় বাছতেন, সেটা মাথায় রেখে কাজ করেছিলাম। টিম ম্যানেজার আর কোচ ছিলেন সাব্বির ইউসুফ ভাই আর মহসীন ভাই। ওনাদের হকি-জ্ঞান ছিল বিশাল। সব মিলিয়ে আমরা ‘৮৫-র এশিয়া কাপে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলাম দেশকে ভালো কিছু উপহার দেওয়ার জন্য।

১৯৮৫ এশিয়া কাপ হকির বাংলাদেশ দল

আমরা ছিলাম হোটেল পূর্বাণীতে। প্রথম খেলা ছিল ইরানের বিপক্ষে, হোটেল তো স্টেডিয়ামের খুব কাছে, আমরা মাইক্রোবাসে করে রওনা হয়েছিলাম। আমাদের মাইক্রোবাস ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের কাছে আসার পর পুলিশ আমাদের আর যেতে দিল না। বলল, গাড়ি আর সামনে যাবে না, হেঁটে যান। কী আর করা, হেঁটেই এগোতে লাগলাম। টিম নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামোর গেট দিয়ে ঢুকছি, দেখি, ইরান দল বাস থেকে নেমে ভেতরে যাচ্ছে। একটা কথাই মাথায় এলো, 'ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর'।

দুই অধিনায়ক টস করছি। আমি হেড চেয়ে হেডই পেলাম। ইরানের ক্যাপ্টেন বলল, 'কয়েন ঘাসে কিছুটা খাড়া হয়ে পড়েছে, আবার টস হতে হবে।' এবার আম্পায়ার কয়েন হাতের মধ্যে রেখে টস করল, এবারও আমার পক্ষেই। ইরানের বিপক্ষে ৩-১ গোলে জিতেছিলাম। আরও গোল হতো, তবে জুম্মন লুসাই ততক্ষণে দুই গোল করে ফেলেছে, আমি টিসা আর কিসমতকে বললাম, 'গোল না করে শর্ট কর্নার নাও, জুম্মন যাতে হ্যাটট্রিক করতে পারে।' জুম্মন সেদিন হ্যাটট্রিক করেছিল। যদিও আমাদের গোলকিপারের ভুলে ইরান একটা গোল শোধ করেছিল।

বাংলাদেশ-ইরান ম্যাচের দৃশ্য

পরের খেলা ছিল জাপানের সাথে। মাইক্রোবাস ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের কাছে আসার পর হেঁটে যাব ভেবে দাঁড়াতে বললাম ড্রাইভারকে। পুলিশ এসে বলল, 'কী করছেন! নামবেন না, গাড়ি স্টেডিয়ামের গেটে  যাবে।' বুঝলাম, এটা আমরা অর্জন করেছি।

ভালো ফলাফল পেতে হলে মাঠের থেকেও মাঠের বাইরের শৃঙ্খলা বেশি দরকার। আমি টিমের সবাইকে বলে দিয়েছিলাম, সন্ধ্যার পর কেউ হোটেলের বাইরে থাকবে না। আর রুমে বাইরে থেকে আসা কারও সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে আমাদের হকি ফেডারেশনের তখনকার সভাপতি জেনারেল মতিনের কাছে অনেকেই অনুযোগ করেছিল। স্যার হোটেল পূর্বাণীতে আমাদের সাথেই ছিলেন এবং আমাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের সাথে আমি ২-৩-৫ পদ্ধতি বাদ দিয়ে ৪-২-৪ পদ্ধতিতে টিম নামিয়েছিলাম। ২-৩-৫ পদ্ধতি সেন্টার হাফ নির্ভর এবং আক্রমণাত্মক, দুই উইংয়ের ক্রস থেকে গোল করে ফরোয়ার্ড। আমাদের দলে আবদুস সাদেক কিংবা জামাল হায়দারের মতন সেন্টার হাফ ছিল না। আমার তাই মনে হয়েছিল, আমাদের জন্য ৪-২-৪ ফর্মেশনটাই সবচেয়ে ভালো, আর পাকিস্তানের মতো টিমের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক দল নামানো মানে তো আত্মহত্যা করা।

এই টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আমি করাচিতে পাকিস্তানের এই দলের সাথে ক্যাম্প করার সুযোগ পেয়েছিলাম, এশিয়ান হকি ফেডারেশন থেকে সিলেক্টেড হয়েছিলাম বলে। ওদের সবার খেলা নিয়ে তাই ভালোই ধারণা ছিল।

পাকিস্তানের সঙ্গে দারুণ লড়াই করে হেরে যাওয়ার পর কান্নায় ভেঙে পড়া লুলুকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন অধিনায়ক। পাশে ম্যানেজার সাব্বির ইউসুফ

খেলার আগের রাতে হকির সঙ্গে জড়িত বেশ ক’জন এসেছিল আমার রুমে। তাদের সবার কথার মূল বক্তব্য হলো, 'ইজ্জত বাঁচাও, পাঁচ গোলের বেশি খেও না।' আমি বললাম, 'আমাকে যা বলেছেন, বলুন। তবে বাকিরা এখন ঘুমাবে, কেউ ওদের রুমে যাবেন না।'

পাকিস্তান তখন হকিতে বিশ্বের সেরা দল। তবে মাঠে আমরা সমানে-সমানে লড়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত যদিও ১-০ গোলে হেরে যাই, তবে্ আমরাও কিন্তু বেশ কয়েকটা গোলের সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলাম। টিসা যদি নিজেই গোলে মারত, তাহলে আমরা গোল পেয়ে যেতাম। কিন্তু ও দুবারই বল ঠেলে দিয়েছিল কিসমতকে। কিসমতও একবার ফ্রি বল গোলকিপারের প্যাডে মেরে দিয়ে নিশ্চিত গোল হাতছাড়া করেছিল।

 সেই ম্যাচে পাকিস্তানের জয়সূচক গোলদাতা হাসান সরদার এরপর থেকে ঢাকায় এলেই্ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাই ওর সঙ্গে। ম্যাচ নিয়ে কথা হয়, গোলটা নিয়ে কথা বলে। বলে, 'গোলকিপার গোললাইন না ছাড়াতে পোস্টের দু'দিকেই গোল করার মতন স্পেস ছিল। তবে তোমরা যা খেলেছিলে, আমাদের তাজ্জব করে দিয়েছিলে।'

`ঢাকায় এলেই সেই ম্যাচে পাকিস্তানের জয়সূচক গোলদাতা হাসান সরদার যোগাযোগ করে। সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাই`কীভাবে মাঠে দর্শক আনতে হয়, ১৯৮৫ এশিয়া কাপের হকি দল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। সেই দলটার এত ভালো খেলার মূলে আমার অধিনায়কত্বের কিছুটা ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল, আর সভাপতি জেনারেল মতিনের অকুণ্ঠ সমর্থন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পরের টুর্নামেন্ট মানে দক্ষিণ কোরিয়াতে এশিয়ান গেমসের আগে জেনারেল মতিন বিদায় নিলেন সভাপতি পদ থেকে, আর আমি আর্মি কোর্সে গিয়ে দলের সাথে থাকতেই পারলাম না। আর্মি কোর্স প্রতি বছরই হয় , পরের কোর্সে না-ই যেতে পারতাম, তবে কোর্সে যেতে বাধ্যই করা হলো আমাকে। দলের বাঁধন সেই যে ছিঁড়ল, তা জোড়া দেবার মতো পরিবেশ আর তৈরি হলো না। আর তা না পারাতে প্রতিভার দন্তহীন হাসি দিয়েই সবার সহানুভূতি পাবার চেষ্টাতে দিন, মাস, বছর, যুগ পার হচ্ছে।

আরও পড়ুন: যে টুর্নামেন্ট দিয়ে দেশে এসেছিল হকির জোয়ার

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×