সাকিবের লাথি মনে করিয়ে দিল হকির সেই ঘটনা
মেজর চাকলাদার (অব.)
১৬ জুন ২০২১
স্টাম্পে সাকিবের ‘লাথি’ অনেকের কাছেই দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ! কিন্তু অনিয়ম কি শুধু ক্রিকেটেই? সাকিবের ঘটনায় স্মৃতির ঝাঁপি খুলে হকিতেও পাতানো ম্যাচের এক ঘটনাকে সামনে নিয়ে এলেন জাতীয় হকি দলের সাবেক অধিনায়ক।
ইউরো কাপ ফুটবল শুরু হয়ে গেল, শুরু হয়ে গেছে কোপা আমেরিকাও। ফুটবল বিশ্ব এখন গরমাগরম। অক্টোবর-নভেম্বরে টি-২০ বিশ্বকাপ হওয়ার কথা। ভারতে না সংযুক্ত আরব আমিরাতে, এটাই শুধু প্রশ্ন। এর আগেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আবার জিম্বাবুয়ে সফরে যাবে। প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের পর শুরু হয়ে যাবে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজও। আরও কত কী আছে, মনে রাখাই মুশকিল। ক্রীড়া-বিশ্ব এখন একের পর এক খেলার পসরা সাজিয়ে বসেছে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ তোলপাড় সাকিব আল হাসানকে নিয়ে। আম্পায়ারের 'ভুল' সিদ্ধান্তে তিনি মহা ক্ষিপ্ত। আর সেটির প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে যা করেছেন, তাতে উত্তপ্ত ক্রীড়াঙ্গন। আম্পায়ারের ভুল যত না ‘এলবিডব্লিউ’ এড়িয়ে যাওয়া, তার থেকে বেশি ‘এলবিডব্লিউ দেব না’ এই সিদ্ধান্তে স্থির থাকা।
সাকিব দেশের ক্রীড়া-পোস্টার। আম্পায়ারের ওই ‘ভুল’-এর পেছনে অনেকেই অন্য শক্তির ‘খেল’ দেখছেন। এ কারণেই হয়তো সাকিবের প্রতিবাদও এমন তীব্র হয়েছে। সাকিব শাস্তি পেয়েছেন, পেতেই হবে, জেন্টলম্যানস্ গেম বলে কথা! তবে যারা ফলাফল ‘এধার-ওধার’ করার মজা লুটছে, তাদের ধরবে কে?
ভাই-বন্ধু ক্রীড়াঙ্গনে ছিল, আছে, থাকবে। স্টাম্পে সাকিবের লাথি, আমার মানসপটে জাগিয়ে তুলেছে সত্তর দশকের হকির আরেক ঘটনা। তখন হকিতে শক্তিশালী দল ছিল সোনালী ব্যাংক। আবাহনী তো শক্তিশালী ছিলই। মোহামেডান দল ছিল সালাম ভাই নির্ভর, নুরু ভাইয়ের ওপর রাগ করে যিনি ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব থেকে চলে যান মোহামেডানে। হকি ফেডারেশনের দণ্ডমুন্ডের কর্তা ছিলেন ওয়ারী ক্লাবের মমিন ভাই আর ভিক্টোরিয়ার আলমগীর আদেল ভাই। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং থেকে বের হয়ে প্রথমে কামাল স্পোর্টিং, তারপর আবাহনীতে চলে যান আবদুস সাদেক এবং তাঁর দলের ইব্রাহিম সাবের, মহসীনসহ সবাই। শুধু প্রতাপ শংকর হাজরা যাননি। ঢাকার হকির ‘আমেরিকা’ তখন আবদুস সাদেকের আবাহনী ।
তখন ভিক্টোরিয়া এক দুর্বল দল আর ওয়ারী ছিল মাঝারি শক্তি। ১৯৭৪ কি ’৭৫ সালের ঘটনা। ভিক্টোরিয়া আর এক পয়েন্ট পেলেই প্রথম বিভাগে দলটির থেকে যাওয়া নিশ্চিত হয়। আমি তখন সোনালী ব্যাংকে খেলি। ওয়ারীর মনু খুব বন্ধু মানুষ। তার টানেই ওয়ারী ক্লাবে গিয়ে দেখি, দলকে মমিন ভাই ‘ব্রিফ’ করছেন, ‘ভিক্টোরিয়াকে কেউ গোল দেবে না। ওদের সাথে আমরা ড্র করব।’
ওয়ারীর ফরোয়ার্ডে খেলে মনসুর। পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। ক্লাস শেষ করে আসতে দেরি হওয়ায় ব্রিফিংয়ে থাকতে পারে নাই। দল হকি স্টেডিয়ামের দিকে তখন রওনা হয়ে গেছে। মনসুর বলল, ‘তুই দাঁড়া, আমি ড্রেস পরে তোর সাথেই মাঠে যাব।’ মোজা পরার আগে মনসুর পায়ের পাতার তলায় সরিষার তেল মালিশ করল। তখন বুঝলাম, মনসুর প্রতিটি খেলায় এত আছাড় খায় কেন। ‘পায়ের পাতায় তেল মাখছ কেন?’--আমার এই প্রশ্নে মনসুরের জবাব, ‘এতে স্পিড বাড়ে।’ মনে মনে কই, 'তুই তো খালি ধপাস ধপাস আছাড় খাস।'
ফরোয়ার্ড হলে কী হবে, মনসুর পুরো সিজনে একটাও গোল দিতে পারেনি। খেলা শুরু হলো। মিল-মহব্বতের খেলা! সবার গা ছাড়া ভাব। সেকেন্ড হাফ প্রায় শেষ। ‘ডি’-এর সামনে মনসুর ফাঁকায় একটা বল পেয়ে যায়। গোল-খরা কাটানোর নেশা ততক্ষণে পেয়ে গেছে ওকে। ম্যাচের আগে ব্রিফিংও শুনে নাই। সুতরাং ধুমছে হিট এবং গোল।
মমিন ভা্ই আর আদিল ভাই পাশাপাশি বসে খেলা দেখছিলেন। গোল হওয়া মাত্র আদিল ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাঠ ছেড়ে চলে যাবেন। মমিন ভাই তাঁকে থামানোর চেষ্টা গেলেন। শেষ পর্যন্ত দুই আম্পায়ারের কাছে গিয়ে মমিন ভাই বলে আসলেন, গোল শোধ না হওয়া পর্যন্ত খেলা চলবে। ২২ খেলোয়াড়, দুই আম্পায়ারের চেষ্টায় যখন গোল পরিশোধ হলো, তখন ম্যাচের দৈর্ঘ্য নির্ধারিত সময় ছাড়িয়ে পাঁচ মিনিটেরও বেশি হয়ে গেছে!
সেই গোলে প্রথম বিভাগেই রয়ে গেল ভিক্টোরিয়া।
ক্রীড়াজগৎটা এক মহাসমুদ্র। এর গভীরে হাজারো ঘটনা, অনুঘটনা। আর তাতে বিরাজমান বিচিত্র সব চরিত্র। সাকিবের ঘটনাই বলুন কিংবা বহু আগের হকির এই ঘটনা—সে সব কিন্তু আপনাকে বৈচিত্র্যময় স্বাদই দেবে!
• লেখক সাবেক জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক।