আগামীর রঙ নাও তুমি

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

৭ এপ্রিল ২০২১

আগামীর রঙ নাও তুমি

বন্ধু নিজের নামে জুড়েছে ‘ডটকম’। এ-ও যে এক আত্মপ্রকাশ! হাতে-লেখা কাগজে ফ্যাক্স, কালিঝুলিমাখা প্রথম কাগজ-এর প্রিন্ট নিয়ে হাতেকালি-মুখেকালি জীবন বহু বছর পেরিয়ে আসার পর ল্যাপটপ এবং রঙিন কাগজের যুগও পেছনে এখন। নিজেকে প্রকাশের নতুন মাধ্যম, ই-জানলা।

‘জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি দেখল।’

কবেকার পড়া, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আত্মপ্রকাশ। ভুলে গিয়েছি বেশির ভাগ। থেকে গিয়েছে লাইনটা। ওই শেষ শব্দের কারণে, ‘দেখল’।

সত্যিই কতভাবে বৃষ্টি দেখেছি আমরা। দু’চোখ ভ’রে, চোখ বন্ধ করে, আনন্দে-বিষাদে, ‘আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবণরাতি’ রবীন্দ্রনাথে, কবীর সুমনে, ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে’। এমন হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিও ‘দেখেছি’। চলন্ত রেলগাড়ির জানলার পাল্লা সামান্য তুলে হাতে নিয়েছি বৃষ্টির ছাট। কখনো গাড়ির কাচ নামিয়ে, নিছক কৌতূহলে। কিন্তু লেখায় এমন ব্যবহার? ‘জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি দেখা’? মনে পড়ে না। এত সহজ, এত স্বাভাবিক, তবুও! তাঁকে বাংলা আধুনিক গদ্যসম্রাট বললে অত্যুক্তির প্রশ্ন নেই। নিরলংকার, সাবলীল। সমালোচক লিখেছিলেন, সুনীলের গদ্য আলোচালের সাদা ঝুরঝুরে ভাতের মতো। কী স্বাদু, সাধু!

বন্ধু উৎপল শুভ্র সম্পর্কে লিখতে বসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়ার কারণ আসলে ওই উপন্যাসের নাম– আত্মপ্রকাশ!

বন্ধু নিজের নামে জুড়েছে ‘ডটকম’। এ-ও যে এক আত্মপ্রকাশ! হাতে-লেখা কাগজে ফ্যাক্স, কালিঝুলিমাখা প্রথম কাগজ-এর প্রিন্ট নিয়ে হাতেকালি-মুখেকালি জীবন বহু বছর পেরিয়ে আসার পর ল্যাপটপ এবং রঙিন কাগজের যুগও পেছনে এখন। নিজেকে প্রকাশের নতুন মাধ্যম, ই-জানলা। সমুদ্রের গা-ঘেঁষা হোটেলে থাকলে যেমন জানলাটা খুলে দিলেই পৃথিবীটা হঠাৎ এত্ত বড় হয়ে যায়, তেমন। নিজের মতো যাপন। ডেটলাইনের তাগাদাহীন। আমার মতো নিতান্ত কালেভদ্রে কাগজপত্রে লিখেও এই ‘এক্ষুনি লিখে ফেলতেই হবে, না হলে মহাবিশ্বের কী বিরাট ক্ষতি’ ভাবনা নিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাঁটাচলার বাজারে হঠাৎ যেন পনেরোই আগস্ট বা ছাব্বিশে মার্চ! বাচ্চাগুলোর হাতে দেশের পতাকার প্রতিরূপ, ছোট ছোট হাতে দুলছে-খেলছে, প্রভাতফেরি, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। মন ভালো করে দেওয়া সকাল।

রোজকার খবরচর্চা থেকে বেরিয়ে আসা আমার কাছে ঠিক তাই-ই। এক আনন্দ উদ্‌যাপন। এই স্বাধীনতা মুবারক! কে কী বললেন আর কে কী করলেন, অবশ্যই জরুরি। রোজকার ডালভাত, হলুদমাখা আটপৌরে শাড়ি বলেই তো ঢাকাই জামদানি মহার্ঘ! বলুন না, রোজ বেনারসি পরা যায়?

শুভ্রর অবস্থান এই মুহূর্তে সেখানে। রোজ বিরিয়ানি! ঘটনাপরম্পরার ধারাবিবরণী নয়, নির্যাস তুলে-আনা, সাজিয়ে দেওয়া পাঠকের সামনে। খুলে-দেওয়া অন্য জানলা। খেলার মধ্যে থেকে খেলার সীমানা পেরোনো। বহুপঠিত ‘বিয়ন্ড আ বাউন্ডারি’-র মতো। খেলার যে অংশটা নিছক খেলায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, অনায়াসে সীমানা পেরোয়, ধায় অসীমের সন্ধানে। সে-লেখা শব্দে ধরতে মুনশিয়ানা প্রয়োজন। আমাদের কেজো-গদ্যের সে-কলজে নেই। যাঁর আছে, যিনি পারেন, বেছে নিয়েছেন ঠিক। এ-পথেই বন্ধন, এ-পথেই মুক্তি! ‘খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত’।

খেলায় নিহিত এই আনন্দের অন্বেষণ শুভ্রর বড় প্রিয়। দেখা হয় অল্প। চার-পাঁচ বছরে হয়তো একবার। আলোচনায় সিংহভাগ জুড়ে তখন খেলা দেখার আনন্দ, খেলার লেখার আনন্দ। মনে থেকে যায় ২০১৪ বিশ্বকাপে প্রথমবার সাও পাওলো থেকে রিও ডি জেনিরো যাত্রাপথ। পাঁচ ঘণ্টার পাহাড়ঘেরা পথে আমাদের জন্য প্রচুর বাধাবিঘ্ন। মাঝে বাস দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। একটা ছোট ব্রিজের আগে। ওদিকটা স্থাণু। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ছেড়ে পরমানন্দে রাস্তায়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শীর্ণ জলধারা, অনেকটা দূরে। বুঁদ হয়ে দেখি, ছবি তুলি, আবার ফিরে যাই সেই আলোচনায়। খেলার লেখা কেমন হওয়া উচিত। সূক্ষ্ম দিকগুলো নিয়ে শুভ্রর অভিজ্ঞতা বলে যায়, আমার স্থুল কান পেতে রই।

ঢাকা থেকে মেসি-ম্যাচ করে ফিরব। ম্যাচের মাঝেই হাতে তুলে দেয় বই, ‘বিশ্ব যখন ফুটবলময়’। আমি পরদিন ভোরে উঠে পড়ি ঢাকা-কলকাতা বাসে। দিনের আলোয় চলন্ত বাসে গোগ্রাসে গিলে ফেলি। ফুটবল সেখানে কোথায়? আবার, ফুটবল ছাড়া আছেটাই-বা কী! সন্ধের অন্ধকার নামার পর বাসের আলো-নেভানো অভ্যন্তরে জাবর কাটি চোখ বুজে। ঘিরে রাখে অদ্ভুত তৃপ্তি। ঝড়ের মতো পড়ে যাওয়ার গতির পর শান্তি আসে প্রকৃতির নিয়মে। সুখপাঠ্য সেই স্মৃতি অমলিন হয়ে থেকে যায়, আজীবন। শচীন টেন্ডুলকারের বিদায়ী টেস্ট ম্যাচ ওয়াংখেড়েতে। বাংলা সংবাদমাধ্যমের পাতায় পাতায় ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’। অনেক কষ্টে নিরাপত্তারক্ষীদের নজর এড়িয়ে কোনো রকমে প্রেস বক্স পর্যন্ত নিয়ে-যাওয়া সিগারেট জ্বালিয়ে আমাদের একান্ত আলোচনায় ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’ শ্রীকান্ত আচার্য কেমন গেয়েছেন, কেন ওই রবি-কলি আরও সুপ্রযুক্ত হতো। ‘কিছু বা সে ভিজিয়ে দেবে দুই চাহনির চোখের পাতা…মনের কথার টুকরো আমার কুড়িয়ে পাবে কোন উদাসীন।’

মুশকিলটা আমার! শুভ্র ওর এই নতুন আনন্দযজ্ঞে আমাকেও শামিল করতে চায়। শরিক করে নিতে চায় তাঁর আনন্দযাত্রায়। বন্ধুকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে। তাঁর মহত্ত্ব, তাঁর উদারতা। আমার যে ওষ্ঠাগত প্রাণ! আমার কি-বোর্ডের নিতান্ত কেজো ‘key’-গুলো যে কখনো সেই আনন্দঘন পথের চাবিকাঠি খুলে দেয় না!

ঘণ্টার পর ঘণ্টা পিটিয়ে যেতে বলুন, চেষ্টায় জানকবুল! এমন আওয়াজ তুলি ল্যাপটপের কি-বোর্ডে, লড়ঝড়ে সিএনজির মতো অবিশ্রান্ত ঘ্যাড়ঘ্যাড় করতে করতে কানের পোকা খেয়ে নেয়। আমরা যাকে ময়দানের লবজ-এ বলি, ‘বাক্স-বাজানো’। সেটাই পারি, সেটাই করি। হাত চলে, পেটও। কিন্তু উদরের উপরিভাগে শারীরিক যন্ত্রগুলোর মন্ত্রশুদ্ধির সুললিত সংগীতের সুর পাই যে কোথায় শুভ্র ভাই!
অনর্থক, তাই নিজের অদক্ষতার প্রমাণ আরও না বাড়িয়ে এই অক্ষম প্রচেষ্টা এখানেই থামুক। ‘খেলাডটকম’ খুলে ফেলেছে বন্ধু। আমাদের বড় প্রিয় কবীর সুমন ধার করে তাই এই আনন্দসফর-এ শুভ্রকে জানাই, আগামীর রঙ নাও তুমি!

* লেখক ১৯৯২ থেকে ক্রীড়া সাংবাদিকতায়। যুগান্তর, আজকাল, দ্য স্টেটসম্যান, টাইমস অব ইন্ডিয়া, মিড ডে ইত্যাদি দৈনিক সংবাদপত্র এবং আরও বহু পত্রপত্রিকা এবং ওয়েবসাইটে খেলা নিয়ে লিখেছেন। ভালোবাসার প্রথম এবং প্রধান খেলা ফুটবল।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×