বাদ পড়ার ভয় জয় করেই এই নাছুম
নাজমূল আবেদীন ফাহিম
১৮ আগস্ট ২০২১
২০১২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেললেও নাছুম আহমেদ জাতীয় দলের নির্বাচকদের রাডার থেকে সরে গিয়েছিল অনেকটাই। তবে সাম্প্রতিক দুটি সিরিজের সাফল্য ওকে হয়তো আবারও ফেরত আনবে কক্ষপথে। হয়তো আরও আত্মবিশ্বাসী নাছুমকেও দেখা যাবে এতে।
নাছুম আহমেদ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছে সেই ২০১২ সালে। এরপর কখনো হয়তো চোখে পড়েছে, তবে বেশির ভাগ সময়েই পড়েনি। সব মিলিয়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়ার মতোই একটা অবস্থা হয়েছিল ওর।
খুবই মেধাবী একজন ক্রিকেটার নাছুম। একদম ছোটবেলা থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ও খুবই ন্যাচারাল একজন স্পিনার। তবে ওর একটা বড় দুর্বলতা ছিল আত্মবিশ্বাসের জায়গাতে। আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির কারণও ছিল, ও ভালো স্পিনার হওয়া সত্ত্বেও কোথাও সুযোগ পায়নি তেমন। আমাদের এখানে জাতীয় দলে না খেলা মানেই কিন্তু আলোচনা থেকে সরে যাওয়া। সেখানে 'এ' দল বা হাই পারফরম্যান্স দল থেকেও সরে যাওয়া তো বিশাল একটা গ্যাপই। আর কয়েক দিন আগে খবরে দেখলাম, নিজের জেলার ক্রিকেট থেকেও বহিষ্কৃত নাছুম। সব মিলিয়ে নাছুম নামটা তাই মিলিয়েই গিয়েছিল ক্রিকেটাঙ্গন থেকে।
নাছুম নিজেও জানত, ও ভালো বোলিং করে; আমরাও জানতাম ওর সামর্থ্য সম্পর্কে...কিন্তু ওর ভেতরে হারিয়ে যাওয়ার একটা ভয় ছিলই। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ক্রিকেটারদের এই ভয় থাকাটা অমূলকও না। এই যে, জায়গা হারানোর ভয়, জায়গা নিয়ে অনিশ্চয়তা...এটা ওকে খুব ডিস্টার্ব করেছে নিশ্চয়ই। ওর আগে কিংবা ওর সমসাময়িক অনেক ক্রিকেটারই তো এভাবে হারিয়ে গেছে।
সৌভাগ্যবশত নাছুম হারায়নি, ফিরে এসেছে আবার। আর ফিরে আসার পরও সাহস করে খেলাটা খুব কঠিন ছিল ওর জন্য। যে মানুষ একবার সর্বস্ব হারিয়েছে, সে কিন্তু আবার একটু ওপরে উঠতে শুরু করলেই ব্যর্থতার ভয় করে। মনে হয়, 'আমি যদি আবার ব্যর্থ হই, আর ফেরত আসতে পারব না।' নাছুমের মধ্যেও তাই 'আমি যদি আবার খারাপ করি, আবার জায়গা হারাব' জাতীয় ভয় কাজ করার কথা। বোলিংয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাওয়ার চিন্তাও হয়তো ও করেনি তখন, কেননা ঝুঁকি নিতে গেলেই মার খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ভালো খেলোয়াড় হতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হবে। যে বলটায় ছয় মারা যায় না এমনিতে, কিন্তু এই মুহূর্তে একটা ছয় খুব দরকার, একজন ভালো ব্যাটসম্যান সে বলটাতে ছয় মারার চেষ্টা করবে। একজন ভালো বোলার হতে গেলেও ঠিক তেমনিভাবে অ্যাটাকিং বোলিং করার ঝুুঁকি নিতেই হবে।
গত দুটি সিরিজে নাছুম হয়তো সেই ঝুঁকি নেওয়ার সাহসটাই অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক দুটি সিরিজে ওকে দলে জায়গা হারানোর ভয়টা কাটিয়ে উঠে খেলতে হয়েছে। জিম্বাবুয়ে সিরিজে মোটামুটি করলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে এসে নিজের সত্যিকারের রূপটা দেখাতে পেরেছে ও। পুরো সিরিজ জুড়েই খুব ভালো বোলিং করেছে। নতুন বলে বোলিং করেও সাফল্য পেয়েছে। অধিনায়কের আস্থাটা এখানে খুব গুরুতপূর্ণ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ওর হাতে প্রথম ওভারেই বল তুলে দিয়ে বোধ হয় একটা জুয়াই খেলেছিল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তবে প্রথম ওভারেই মাত্র ১ রান দিয়ে নাছুম পেয়ে গিয়েছিল ফিন অ্যালেনের উইকেট৷ আর এবারের অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও পাওয়ার প্লেতে ৯ ওভার বল করে ৪ উইকেট পেয়েছে ও। অধিনায়কের যে তাঁর ওপর আস্থা আছে, দল তাঁর ওপর নির্ভর করে...এই উপলব্ধিটাই কিন্তু নাছুমের ভালো পারফরম্যান্সের বড় কারণ। একটু দেরিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসা খেলোয়াড়দের মন থেকে নিরাপত্তাহীনতার বোধ দূর করে আত্মবিশ্বাস জোগাতে এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ৮ উইকেট নেওয়া নাছুমকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। একটা নিরাপত্তা যখন ও পাবে, নিজেকে আরও জানবে, বোলিংয়ে নতুন নতুন জিনিস যোগ করতে সাহস করবে, বৈচিত্র্য আনতে চাইবে। তখন আমরা হয়তো আরও ভালো বোলিং পাব ওর কাছ থেকে।
তবে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, ওর মতো ক্রিকেটাররা সব সময় দলে থাকবে না। তাই নাছুমের মতো ক্রিকেটাররা দলে না থাকলেও তাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওদের সঙ্গে কথা বলা দরকার, ওদের পাশে থাকা দরকার। দলে থাকবে কি থাকবে না, যখন থাকবে না তখন কী করবে...অর্থাৎ ভবিষ্যতের ছবিটা যদি ওদের সামনে পরিষ্কার হয়, তাহলে ওরা অনেক নিরাপদ বোধ করবে। নিজের দায়িত্বটা বুঝতে পারবে বলে ওরা নিজেরাও একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে।
নাছুমের মতো ক্রিকেটারদের কাছ থেকে তখন সব সময়ই সেরাটা পাওয়া যাবে।