সোহানের অনেক গুণ, `নিঃস্বার্থ ক্রিকেটার`-ও তার একটি
নাজমূল আবেদীন ফাহিম
২০ আগস্ট ২০২১
নুরুল হাসান সোহান ন্যাচারাল উইকেটকিপার, ব্যাটিংয়েও বিভিন্ন রকম ইনিংস খেলতে পারে। তবে ওর সবচেয়ে বড় গুণ, ও একেবারে নিঃস্বার্থ একজন ক্রিকেটার। জাতীয় দলে নিয়মিত সুযোগ পায়নি। সামনেও যদি না পায়, নিজেকে উজ্জীবিত রাখতে ওকে একটা প্ল্যাটফর্ম দেওয়া উচিত। তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই লাভ।
নুরুল হাসান সোহান একেবারে নতুন ক্রিকেটার নয়। 'সম্ভাবনার পাঁচ তরুণ' সিরিজে তাঁর অন্তর্ভুক্তি নিয়েও দেখলাম অনেকে বলছেন, 'সোহান কিভাবে তরুণ'? বয়সের দিক থেকে হয়তো প্রচলিত অর্থে তরুণ নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের বিচারেও নয়, তবে দলে অনিয়মিত থাকায় ম্যাচ খেলার বিচারে ওকে তরুণই বলতে চাই। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলার সময়ই সোহান সবার চোখে পড়েছে। ওর খুবই দুর্ভাগ্য বলতে হবে, জাতীয় দলে উইকেটকিপারের জায়গাটা দীর্ঘ একটা সময় ধরে মুশফিকুর রহিমের জন্য বরাদ্দ। এখন আবার লিটন দাসও এসেছে। খুব একটা সুযোগ তাই ও পায়নি।
তবে লিটন যেহেতু টপ অর্ডারে ব্যাট করে, মুশফিকও একটু ওপরের দিকেই, সেখানে লেট মিডল অর্ডারে সোহানকে খুবই কার্যকর একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে আমি অন্তত দেখি। ওর ব্যক্তিত্বই এমন যে, ওকে খুবই কঠোর পরিশ্রমী, নিজের কাজের প্রতি সৎ একজন ক্রিকেটার মনে হয়। এই পর্যন্ত ও পরিশ্রম করেই এসেছে। ওর সম্পর্কে আমি অন্য কোনো কথা শুনিনি, অন্য কিছু দেখিনি। ওর আরেকটা ইতিবাচক গুণ হচ্ছে, শারীরিকভাবে ও খুবই স্ট্রং। ওর হাইট ভালো, শরীরের কাঠামো ভালো… এই দিকটায় অন্যদের তুলনায় ও একটু 'গড গিফটেড'। শরীরে পাওয়ার আছে, সেটাও বোঝা যায়।
সোহান বিভিন্ন রকম ইনিংস খেলতে পারে। সিঙ্গেল নিতে পারে, ইনিংসের যেকোনো সময় আচমকা একটা চার-ছয় মেরে দিতে পারে। শর্টার ফরম্যাটের ক্রিকেটে এটা কিন্তু বেশ বড় একটা গুণ। ওর খেলার যে ধরন, একটু উল্টাপাল্টা নড়াচড়া করে, বোলারকে ডিস্টার্ব করে…ওইভাবেই ও রান করে। এর মধ্যে ফিজিক্যাল আর মেন্টাল একটা কো-অর্ডিনেশন খুঁজে পায় ও। যার প্রমাণ আমরা গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে পেয়েছি, ১৬ ম্যাচ খেলে ৩৫.৩৬ গড়ে ৩৮৯ রান করেছিল সোহান। স্ট্রাইক রেটও ছিল প্রায় দেড় শ ছুঁইছুঁই (১৪৯.৬১)।
এবার ও যখন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পুরো সিরিজটা খেলল, ওর সঙ্গে খুব একটা কথা বলিনি আমি। শুধু একটা কথাই বলেছি, কোনো অবস্থাতেই নিজের স্বাভাবিক খেলা থেকে যেন দূরে সরে না যায়। তবে সেটা বোধ হয় ও করে নাই। যদিও এর মধ্যেই দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে দারুণ কার্যকর একটা ইনিংস খেলেছে, আফিফের সঙ্গে মিলে ম্যাচ বের করে এনেছে। দেখা যাক, সামনে কী করে।
আরেকটা গুণের কথা না বললেই নয়, ওকে আমার খুবই নিঃস্বার্থ একজন ক্রিকেটার মনে হয়েছে। নিঃস্বার্থ বলতে, দলের যদি একটা ছয়ের দরকার পড়ে, নিজের উইকেটকে ঝুঁকিতে ফেলেও ও ছয় মারতে চেষ্টা করবে। এটাও বেশ বড় একটা গুণ।
আর কিপিংয়ের কথা যদি বলি, তো ও খুব ন্যাচারাল একজন উইকেটকিপার। অনেকে থাকে না, বেসিক শিখে শিখে কিপার হয়, ও সেরকম না। ও বল দেখে, বল ধরে। ওর কিপিং দেখলে অনেক সময় মনে হবে একটু আনঅর্থোডক্স। ক্রিকেট ম্যানুয়াল ফলো করছে না। কিন্তু ও বল ছাড়বে না। একটু অদ্ভুত লাগলেও ও বল আটকাবেই। আর ওর যে উচ্চতা, এরকম লম্বা খেলোয়াড়রা সাধারণত অ্যাক্রোব্যাটিক হয় না। কিন্তু ব্যতিক্রম হয়ে ও দারুণ অ্যাথলেটিক, অ্যাক্রোব্যাটিক। যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা কাভার করতে পারে, পেস বোলিংয়ে লম্বা ডাইভ দিয়ে বল ধরতে পারে। এক হাতে কিংবা দুই হাতে, খুবই সহজাত একজন উইকেটকিপার ও।
তবে একটা কথা কী, ও যখন ডোমেস্টিক ক্রিকেট খেলে বেড়ে উঠেছে, আমার কাছে ওকে খুবই দুর্ভাগা ক্রিকেটার মনে হয়েছে। দুর্ভাগা এ কারণে বলছি, আমাদের দেশে জাতীয় দলে কেউ যদি খেলতে না পারে, তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো প্ল্যাটফর্ম নাই। অন্যান্য দেশে হয় কী, জাতীয় দলে না খেলতে পারলেও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে খেলেই যথেষ্ট সম্মান পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেট, অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্ড কিংবা ভারতের রঞ্জি ট্রফির কথাই ধরুন; প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে সেখানে খুবই দামি বিবেচনা করা হয়। ওখানে কে কী করছে, কার কী রেকর্ড হচ্ছে… এসব ব্যাপারকে আলাদা জায়গা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একজন খেলোয়াড় যদি জাতীয় দলে না খেলে, তারপর প্রিমিয়ার লিগ খেলে বা জাতীয় ক্রিকেট লিগ খেলে সেই পরিচিতিটা কিন্তু পাওয়া যায় না।
সোহানের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার ছিল, জাতীয় দলে ওকে সুযোগ দেওয়া না গেলেও অন্তত এমন একটা প্ল্যাটফর্ম ওকে দেওয়া, যেখানে ও নাম-দাম সব পেত। জাতীয় দলে না খেললেও এর ঠিক নিচের লেভেলটায় ওর খুব ভালো খেলার কথা, ওকে নিয়ে প্রচুর আলোচনা হওয়ার কথা। সেটা হয়নি কিন্তু। কেবল এ কারণটাতে আমাদের অনেক খেলোয়াড় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, নষ্ট হয়ে যায়। তাদের তো এই চিন্তা করারই সুযোগ নেই যে, 'আমি জাতীয় দলে খেলতে পারলাম না, সমস্যা নেই। আমি দারুণ একটা ফার্স্ট ক্লাস টিমের প্লেয়ার। আমি পারফর্ম করি। আমার কথা খুব আলোচনা হয়, টিভিতে আমার নাম আসে, পেপারে আসে।' এরকম ভাবনার কোনো সুযোগই নেই ওদের সামনে। এটা খুবই নিরুৎসাহজনক একটা ব্যাপার।
পরের সিরিজে মুশফিক যখন দলে ফিরবে, লিটন ফিরবে; তখন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, সোহান একাদশে থাকবে কি না। একাদশে না থাকলেও স্কোয়াডে থাকবে কি না। যদি দলে ওর জায়গা না থাকে, তখনও ওকে আশা হারাতে না করব। আর সামনে যেহেতু আমাদের অনেক খেলা, কর্তৃপক্ষ চাইলেই ওকে খেলার সুযোগ করে দিতে পারে। একটা সিরিজে সব ম্যাচ যদি না-ও হয়, একটা-দুইটা ম্যাচে সোহানকে নামানো যেতেই পারে। তাহলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যে চর্চাটা থাকা দরকার, সোহানের সেটা থাকবে। আমাদের দেশে ওই পর্যায়ে না খেললে শীর্ষ পর্যায়ে খেলার আবহটা যে থাকে না।
আমার প্রত্যাশা থাকবে, ম্যানেজমেন্ট ওকে যে ফরম্যাটে যোগ্য মনে করছে, সেই ফরম্যাটে ওকে যেন টাইম-টু-টাইম সুযোগ দেওয়া হয়। তাহলে ও নিজেকে মোটিভেটেড রাখতে পারবে। আমাদের সিনিয়র ক্রিকেটাররা যখন অবসর নেবে, কিংবা চোটে পড়বে, ওকেই দায়িত্ব নিতে হবে। ওকে রাডারে রাখা গেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই লাভ।