যাদের দেখেই মনে হয়েছিল `বিশেষ কিছু`

যাদের দেখেই মনে হয়েছিল `বিশেষ কিছু`

তাঁর কাজই উদীয়মান প্রতিভাদের নিয়ে নাড়াচাড়া। এত দীর্ঘ সময় ধরে এই কাজটায় জড়িয়ে আছেন যে, সেখান থেকে সেরা পাঁচ প্রতিভা বাছার কাজটা সহজ ছিল না। উৎপল শুভ্রর অনুরোধে সেই কাজটাই করতে রাজি হলেন ক্রিকেট কোচ নাজমূল আবেদীন ফাহিম। সংখ্যাটা অবশ্য পাঁচ থেকে সাত হয়ে গেল, তারপরও বলে নিলেন, কারও কারও নাম বাদও পড়ে গিয়ে থাকতে পারে।

উৎপল শুভ্র যখন আমার কাছে এই তালিকাটা চাইলেন, বেশ একটু দ্বিধাতেই পড়ে গিয়েছিলাম। বিকেএসপিতে আর বিসিবিতে দীর্ঘকাল ধরে জড়িত থাকার সুবাদে অনেক ক্রিকেটারকেই দেখার সুযোগ হয়েছে। অল্প বয়সেই নিজের প্রতিভার পরিচয় রেখেছে, এমন ক্রিকেটারের সংখ্যাও তো কম নয়। সেখান থেকে পাঁচজনকে বেছে নেওয়া মোটেই সহজ না।

পাঁচজনের নাম লিখতে গিয়েও তাই সাতজনের নাম লিখতে হলো এবং এই তালিকাটাকেও মনে হচ্ছে অসম্পূর্ণ। তাৎক্ষণিকভাবে যে নামগুলো মাথায় এলো, তাদের কথাই বলছি। এর মানে এই না যে, এই সাতজনের বাইরে আর কারও মাঝে মেধা ছিল না বা আর কেউ অল্প বয়সেই প্রতিভার পরিচয় রাখেনি। এর বাইরেও আরও অনেকজনই এই তালিকায় আসতে পারত, হঠাৎ করে স্মৃতি হাতড়ে লিখতে হলো বলে এই সাতজনের নামই মনে করতে পারলাম।

সাত নম্বর দিয়ে শুরু করে একে যাওয়াই মনে হয় ভালো।

রকিবুল হাসান

৭.
রকিবুল হাসান

আমি যে সাতজনের কথা বলব, তাদের মধ্যে বাকি ছয়জনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অনেকের ক্যারিয়ার এখনো শেষ হয়নি বলে আরও কিছু পাওয়ার সুযোগও তাদের আছে। এর বাইরে যে একজনকে নিয়ে আমার বেশ আশা ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তেমন সাফল্য পায়নি, সেই ক্রিকেটারের নাম রকিবুল হাসান। খুব ভালো একজন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হতে পারত ও।

বয়সভিত্তিক দলে খেলার সময় বিগ হিটার হিসেবেও ওর বেশ খ্যাতি ছিল। বড় শট খেলতে পারার সঙ্গে সঙ্গে বড় ইনিংসও খেলতে পারত। আর ফিটনেস ভালো ছিল বলে ওর ফিল্ডিংটাও বেশ ভালো ছিল। এসব দেখে-টেখে আমার মনে হয়েছিল, ও অনেক দূর যাবে। হ্যাঁ, ও ওয়ানডে খেলেছে, টেস্ট খেলেছে…তবে যতদূর যাবে বলে ভেবেছিলাম, ততদূর ওর যাওয়া হয় নাই।

পরে তো অবসরই নিয়ে নিল। আমার মনে হয়, ও যেরকমভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিল, মাঝখানে এসে সেটা পুরোপুরি বদলে ফেলেছিল। এত বেশি পরিবর্তন ও সম্ভবত গ্রহণ করতে পারে নাই। সাকিব, তামিমের মতো ও যদি এখনো থাকত, বাংলাদেশের মিডল অর্ডারে বড় একটা শক্তির জায়গা হতে পারত।

তামিম ইকবাল

৬.
তামিম ইকবাল

তামিমকে আমি বিকেএসপিতে পাইনি, তবে বয়সভিত্তিক দলে পেয়েছিলাম। তবে ও যখন ছোট ছিল, তখন ও খুবই আক্রমণাত্মক ছিল। খুবই অ্যাটাকিং, সব সময়ই বোলারকে শাসন করতে চাইত। আর আমার ধারণা, তখন তামিমের কাছে ক্রিকেট মানেই ছিল ব্যাটিং। ব্যাট করতে খুব ভালোবাসত। এ কারণে বলছি, ফিটনেস ট্রেনিং কিংবা ফিল্ডিংয়ের দিকগুলোয় ওর খুব কম আগ্রহ লক্ষ্য করতাম।

এখন অবশ্য সব ব্যাপারেই ও বেশ মনোযোগ দেয়। বেশ ভালো ফিল্ডিং করে, নিয়মিত ফিটনেস ট্রেনিং করে। তবে ছোটবেলায় ও কেবল ব্যাটিং করতেই ভালোবাসত।

ছোটবেলা থেকেই ও নিজেকে একজন অসাধারণ ব্যাটসম্যান মনে করত। ও আর সবার চেয়ে ভালো, এই বিশ্বাসটা ওর মাঝে তখন থেকেই ছিল। ওর সঙ্গেই সাকিব ছিল, মুশফিক ছিল, রকিবুলও ছিল...আমরা তখন থেকেই অনুমান করতাম, এরা বোধ হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে। হয়তো কিছুদিন আগে কিংবা পরে, এরা সবাই জাতীয় দলে খেলবে। আর আমরা কিন্তু পরে সেটাই দেখেছি। ওদের যে ব্যাচটা অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলল, সেই দলের অনেক সদস্যই জাতীয় দলে খেলেছে।

লিটন দাস

৫.
লিটন দাস

লিটন যখন প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাট হাতে নামল, আমি সেদিন ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, 'হিয়ার কামস অ্যা স্টার।' যেটা আমি এর আগে কারও সম্পর্কে কখনো দিই না বা দিইনি। ওকে আমি বয়সভিত্তিক দল থেকে দেখছি, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দেখেছি… ওর যা কোয়ালিটি, তাতে ওর কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা অনেক অনেক বেশি। 

একটা বয়সের পর লিটনকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ও একদিন জাতীয় দলে খেলবে। দেখেই বোঝা যেত, ও একজন 'ক্লাস ক্রিকেটার'। অনায়াসে শট খেলতে পারে, কেউ বোঝার আগেই কেবল টাইমিং দিয়ে বলকে সীমানা ছাড়া করতে পারে। এটা কিন্তু বেশ বিরল। খুব কম ব্যাটসম্যানই এতটা কম শক্তি খরচে বলকে এভাবে বাউন্ডারির বাইরে পাঠাতে পারে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েক বছর খেলে ফেলেছে ও। খুব একটা খারাপ খেলেছে, তা নয়। তবে ওর কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা আরও অনেক বেশি। বাংলাদেশের জন্য ও অনেক কিছু করার সামর্থ্য রাখে।

সাকিব আল হাসান

৪.
সাকিব আল হাসান

সাকিব যখন বিকেএসপিতে এলো, অনেকের ভিড়ের মাঝে নিজের খেলাটা আলাদা করে দেখানোর সুযোগ ওর হয়নি। সব সময়ই একটু নিজের মধ্যে থাকার চেষ্টা করত, বেশ শান্ত-শিষ্ট থাকত। পরে যখন অনূর্ধ্ব-১৫ দলে সুযোগ পেল, তখনই প্রথম ওকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।

তখন তো ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের সাথে প্রতি বছরই সফর আদান-প্রদান হতো আমাদের। হয়তো কোনো বছর ওরা আসত, নয়তো আমরা যেতাম। তো সেবার আমরা গেলাম পশ্চিমবঙ্গে, কল্যাণীতে একটা নতুন স্টেডিয়ামে আমাদের প্রথম খেলা পড়েছিল। আমার মনে আছে, পিচ ব্যাটিংয়ের জন্য খুব ভালো ছিল না, প্রথম উইকেটটা বেশ তাড়াতাড়িই পড়ে গেল, সাকিব ওয়ান ডাউনে নেমে একটা চমৎকার ইনিংস খেলল। খুব সম্ভবত ৬৭ রান করেছিল ও সেদিন। বেশ কিছু ভালো কাট, ড্রাইভ, লফটেড শট ছিল ওর ইনিংসে, খুবই আক্রমণাত্মক ভঙিতে রান করেছিল..ঠিক এখনকার মতোই। এবং আমরা ম্যাচটা জিতেও ছিলাম।

এর আগে প্র‍্যাকটিসে ওকে টুকটাক দেখেছি, তবে সিরিয়াস ম্যাচে ওকে সেবারই আমার প্রথম দেখা। এরপর থেকে ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলে আমি দেখলাম, খুব ভালো করে না তাকালে ওর খেলাটা বোঝা যায় না, কিন্তু দলের জেতার পেছনে ওর অবদান কোথাও না কোথাও থাকেই। তা সেটা ব্যাট হাতে হোক, কিংবা বল হাতে, অথবা শুধুই ফিল্ডিং দিয়ে। ও ব্যর্থ হয়েছে, এমন ম্যাচের সংখ্যা খুব কম। দেখা যেত, একটা ম্যাচে রান না করলেই আবার টানা কয়েকটা ম্যাচে রান করে দিচ্ছে। আমাদের ম্যাচে ওর কোনো ভূমিকা নেই, এটা তখন থেকেই বিরল ঘটনা।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ও এত কিছু অর্জন করবে, এত এত রেকর্ড ওর নামের পাশে থাকবে, এটা হয়তো তখন ভাবি নাই। তবে ও বাংলাদেশ দলে খেলবে, খুব ভালোভাবেই খেলবে-- এটা তখন থেকেই অনুমান করেছিলাম। ও নিজের জন্য বা বাংলাদেশের জন্য যা অর্জন করেছে, এটা দেখাটা আমার জন্য আনন্দদায়ক এক অভিজ্ঞতা।

মুশফিকুর রহিম

৩.
মুশফিকুর রহিম

মুশফিক তো বিকেএসপিতেই ছিল, ও-ই বোধ হয় বিকেএসপির একমাত্র ছাত্র, যাকে দেখার পর আমার মনে হয়েছিল, এই ছেলেটা জাতীয় দলে খেলবে। ওই ১২-১৩ বছর বয়সেই ও খুব সাবলীল ব্যাটিং করত। এখন তো ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টির কারণে ব্যাটিং টেকনিক অনেকটাই বদলেছে, তবে ১০-১৫ বছর আগের গল্পটা তো ভিন্ন ছিল। তখনই মুশফিককে দেখতাম, একদম বলের পেছনে গিয়ে ডিফেন্স করত, স্ট্রেট ব্যাটে খেলত… মানে যাকে আমরা নিখুঁত ব্যাটিং টেকনিক বলি, ঠিক সেরকম।

ওই ১৩-১৪ বছর বয়স থেকেই ও খুব গোছানো, নিয়ম-নীতি মেনে চলে, কঠোর পরিশ্রম করে। তখন কিন্তু ও উইকেট কিপিংয়ের পাশাপাশি ওপেনিং ব্যাটসম্যানও ছিল। শুরুতে ও উইকেট রক্ষণের দায়িত্ব সামলে ইনিংস ওপেন করতেও নেমে যেত। পরে আমরা যখন বুঝতে পারলাম, উইকেট কিপিং আর ওপেন করা দুটো একসঙ্গে ওর জন্য চাপের হয়ে যাবে। তাই ওকে ধীরে ধীরে আমরা মিডল অর্ডারে নামিয়ে দিলাম। যাতে ওর ওপর চাপটা যেন কম হয়।

এরপর তো মুশফিক বয়সভিত্তিক দলে খেলতে শুরু করল, সেখানেও ওর সঙ্গে আমি ছিলাম। অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ পার করে সঙ্গে সঙ্গেই তো বলতে গেলে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে গেল। আর এখন বেশ ভালোই করছে।

 মাশরাফি বিন মুর্তজা

২.
মাশরাফি বিন মুর্তজা

মনে আছে, মাশরাফিকে আমি প্রথম দেখি ঢাকা স্টেডিয়ামে, এখন যা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। কী খেলা হচ্ছিল ঠিক মনে করতে পারছি না, কোনো বয়সভিত্তিক দল কিংবা স্কুল ক্রিকেটের ফাইনালই চলছিল বোধ হয়, বিকেএসপির বিপক্ষে বাইরের একটা দল খেলতে এসেছিল। আমি আর সারোয়ার ইমরান পাশাপাশি বসে খেলাটা দেখছিলাম। ওখানেই আমরা দেখলম, একটা ছেলে বিকেএসপির বিপক্ষে পেস বোলিং করছে, আর উইকেটকিপার অনেক পেছনে দাঁড়ানো, তবুও বল যেন উড়ে উড়ে কিপারের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। বেশ লম্বা, অ্যাথলেটিক রান আপ, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ওর বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানদের সমস্যা হচ্ছে--বাংলাদেশের ক্রিকেটে পেস বোলারদের কাছ থেকে যা দেখতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম না। তবে ওই বয়সভিত্তিক দলের ছেলেটা প্রথমেই বুঝিয়ে দিয়েছিল, ও আলাদা। 

পরে জানলাম, ছেলেটার নাম মাশরাফি। এর কিছুদিন পরই তো মাশরাফির উত্থান হলো, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই টেস্ট খেলে ফেলল। আর তখন তো বিকেএসপিতে সব ক্যাম্প-ট্যাম্প হতো, আমিও সেগুলোতে জড়িত থাকতাম, মূলত ব্যাটিংটাই দেখতাম। মাশরাফির সঙ্গে তখন ব্যাটিং ক্যাম্পে কাজ করার সুযোগ এসেছিল।

তবে মাশরাফিকে প্রথম দেখার অনুভূতি ওটাই, 'হি ইজ ডিফারেন্ট'।

মোহাম্মদ আশরাফুল

১.
মোহাম্মদ আশরাফুল

আশরাফুল যখন উঠে আসছে, তখন ওকে সবাই বোলার হিসেবেই জানত। শুধু তা-ই না, অনেকেই হয়তো জানে না, ও যখন 'এ' দলের হয়ে প্রথম ট্যুর করল, মালয়েশিয়ায় একটা ট্রাই নেশন সিরিজে, ওই ট্যুরে আশরাফুলকে লেগ স্পিনার হিসেবেই দলে নেওয়া হয়েছিল। আমি ওই দলটার কোচ ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই ও একটু লেট অর্ডারে ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়েছিল, তবে ওর ব্যাটিং যতটুকু দেখছি, তাতে আমার মনে হয়েছিল ব্যাটসম্যান হিসেবে ওর ভবিষ্যৎ আছে। একজন ভালো ব্যাটসম্যান বলতে আমরা যা বুঝি; ব্যালেন্স, টাইমিং, শট খেলায় নিয়ন্ত্রণ..তখনই আশরাফুলের মধ্যে এর সবই ছিল।

আমি কোচের রিপোর্টেও ওর ব্যাটিংয়ের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এটা কিন্তু সচরাচর ঘটে না। কেননা 'এ' দলে বোলার হিসেবে খেলা মানে কিন্তু ওর বোলিংটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিতই। আমার তাই ওর বোলিং-ফিল্ডিং নিয়েই লেখাটাই স্বাভাবিক হতো। কিন্তু আমি রিপোর্টে লিখেছিলাম যে, ওর ব্যাটিংটা দারুণভাবে আমার চোখে পড়েছে।

আশরাফুলকে নিয়ে আমার প্রথম ইম্প্রেশন এমনই ছিল। পরে তো ও ব্যাটসম্যান হিসেবেই পরিচিতি পেল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তারকাখ্যাতি পেল।  তবে সত্যি বলতে কি, ও যে এতটা ভালো ব্যাটসম্যান হিসেবে আবির্ভূত হবে, তখন তা ভাবিনি।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×