নেইমারের প্রশ্ন–চাপ? কিসের চাপ?
৪ জুলাই ২০২১
পুরো দেশ নেইমার-নেইমার করছে। দাবি জানাচ্ছে, নিজেদের দেশে আয়োজিত বিশ্বকাপ জিততেই হবে। মুছে দিতে হবে মারাকানোজোর দুঃস্বপ্ন। কিন্তু চোট পেয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার আগ পর্যন্ত নেইমারকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। বরং প্রেস কনফারেন্সে যতবার এই চাপের কথা উঠেছে, তিনি হেসে তা উড়িয়ে দিয়েছেন। এই `চাপ` যে ১৩ বছর বয়স থেকেই ছায়াসঙ্গী বলে তা আর গায়েই লাগে না!
প্রথম প্রকাশ: ২৫ জুন ২০১৪। প্রথম আলো।
হাল্কের ওপর ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকের খুব রাগ। তা ব্রাজিলের ৭ নম্বর যা খেলেছেন, রাগ হতেই পারে। না, কারণ ওটা নয়। ‘বক্সে নেইমার ফাঁকায় ছিল। অথচ ওকে বলটা না দিয়ে নিজে মাতব্বরি করতে গেল। নইলে নেইমারের হ্যাটট্রিকটা হয়ে যেত। ফেলিপে (স্কলারি) ওকে তুলে নিয়ে ঠিক কাজ করেছে’—সংবাদ সম্মেলনে বসে গজগজ করছিলেন ওই রেডিও সাংবাদিক।
নেইমারকে দেখে অবশ্য মনে হলো না, তিন ম্যাচে দ্বিতীয়বার হ্যাটট্রিক হাত ফসকে যাওয়ায় তাঁর কোনো দুঃখ আছে। হাসিমুখে সংবাদ সম্মেলনে এলেন। ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার নেওয়ার সময় সেটি আরও চওড়া হলো। সামনের সারিতে বসে থাকা পরিচিত ব্রাজিলিয়ান টিভি উপস্থাপককে আলিঙ্গন করে মঞ্চে গিয়ে বসলেন এবং ঘোষণা করলেন, লোকজন কী সব চাপের কথা বলছে। কিসের চাপ?
নেইমারের সব সংবাদ সম্মেলনেই প্রশ্নটা কমন থাকছে। এই যে পুরো ব্রাজিল তাঁর কাঁধে চেপে বসেছে, এই চাপটা আসলে কেমন? গত পরশু প্রথম প্রশ্নও এটাই। নেইমার সেই পুরোনো জবাবটাই দিলেন। তবে এমন ভঙ্গিতে যেন বারবার শুনতে শুনতে প্রশ্নটাতে কৌতুক বোধ করতে শুরু করেছেন।
‘আমি তো কোনো চাপটাপ দেখছি না। সব সময়ই বলে এসেছি, সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসা স্বপ্নকে যখন আপনি সত্যি করছেন, তখন চাপ বলে কিছু থাকে নাকি!’ বলার পর পাশে বসে থাকা স্কলারির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। স্কলারি মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে যেন বললেন, ‘শাবাশ, এই তো চাই।’
নেইমারের কাছে স্কলারির চাওয়া অবশ্য শুধু গোল করাতেই সীমাবদ্ধ নেই। তাঁর কোচিং দর্শন বলে, তুমি যত বড় খেলোয়াড়ই হও না কেন, বল পায়ে না থাকলে তোমাকেও প্রতিপক্ষের পেছনে ছুটতে হবে। মার্কিং করতে হবে। ২০০২ বিশ্বকাপে রোনালদোও এ থেকে ছাড় পাননি। এই বিশ্বকাপের আগে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেও পাশে বসা নেইমারকে সেই দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ক্যামেরুনের বিপক্ষে ম্যাচের পরও নেইমারের প্রশংসা করতে গিয়ে বড় করে তুলে ধরলেন এটিকেই, ‘ও আক্রমণও করছে, ডিফেন্সও করছে। অনেক অবদান রাখছে দলে।’
আসলেই তাই। টেলিভিশনে খেলা দেখে বোঝার উপায় নেই, যতক্ষণ মাঠে থাকেন, কী পরিশ্রমটাই না করেন নেইমার! এই বল নিয়ে প্রতিপক্ষের গোলের দিকে ছুটে যাচ্ছেন তো পরক্ষণেই নেমে যাচ্ছেন রক্ষণকে সাহায্য করতে। সবচেয়ে যা নজর কাড়ে, যা-ই করছেন যেন মনের আনন্দে। চাপ বলে কিছু অনুভবই করছেন না—এই অবিশ্বাস্য দাবিটাও অবিশ্বাস করার কোনো কারণ থাকে না তাঁকে দেখলে।
নেইমারের সবকিছুতেই যেন একটা কৌতুকপ্রিয়তা খেলা করে। এমনকি বিশ্বকাপের মাঠেও। ক্যামেরুন ম্যাচে বল নিয়ে এমন সব কারিকুরি করলেন, যেন পাড়ার মাঠে খেলতে নেমেছে এক কিশোর। যে খেলছে মনের আনন্দে। সেই আনন্দে খেলতে খেলতেই দুটি গোলও করে ফেললেন। তিন ম্যাচে চার গোলে এই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে ৫৩ ম্যাচে ৩৫ গোল করে ছুঁয়ে ফেললেন রিভালদোকেও। সামনে আছেন মাত্র পাঁচজন—বেবেতো (৩৯), জিকো (৫২), রোমারিও (৫৫), রোনালদো (৬২) ও পেলে (৭৭)৷ সান্তোসের উদীয়মান কিশোর প্রতিভা এরই মধ্যে কতটা পথ হেঁটে ফেলেছেন, তার প্রমাণও মিলছে এতে।
নিজে খেলছেন, দলকে খেলাচ্ছেন। জীবনের প্রথম বিশ্বকাপেই প্রেরণার উৎস হয়ে উঠছেন বয়সে-অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে থাকা সতীর্থদের। মেক্সিকো ম্যাচের পরই যেমন ফ্রেডকে বলেছেন, ‘গোঁফ রাখো, ঠিকই গোল পাবে।’ দুষ্টুমির হাসি দিয়ে এমনভাবে কথাটা জানালেন, যেন আট বছর পর বিশ্বকাপ-গোলের সঙ্গে ফ্রেডের দেখা হওয়ার মূল কারণ ওটাই।
ক্যামেরুনের সঙ্গে পারফরম্যান্সে তাঁর মনে হচ্ছে, ব্রাজিল ঠিক পথেই আছে, ‘শুধু বড় ব্যবধানে জিতেছি বলে বলছি না, আজ আমরা যেভাবে খেলেছি, যেমন ইচ্ছেমতো আক্রমণ করেছি, তাতে আমি খুব খুশি।’ দ্বিতীয় রাউন্ডে চিলির বিপক্ষে ‘কঠিন ম্যাচ’-এর আগে এমন একটা পারফরম্যান্স বাড়তি মাত্রা পাচ্ছে নেইমারের কাছে। ‘চিলি খুব কঠিন হবে। আসলে ফুটবলই দিন দিন কঠিন হচ্ছে। এখন আর বিশ্বকাপে দুর্বল দল বলে কিছু নেই’—এমন সিরিয়াস কথা বলার পরও মুখে এক চিলতে হাসি।
ম্যান অব দ্য ম্যাচের সংবাদ সম্মেলন খুব সংক্ষিপ্ত হয়। পরশুই যেমন তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে উঠে গেলেন নেইমার। তবে চাপটাপ প্রসঙ্গে কথা বলছেন তো আজ থেকে নয়। সেসব থেকে কিছু তুলে দিতে ইচ্ছা করছে—
১. চাপের কথা যদি বলেন, ১৩ বছর থেকেই সেটি আমার ছায়াসঙ্গী।
২. মানুষ টিভিতে আমাকে দেখে অনেক কিছু ভেবে নেয়, তবে আমি আসলে অন্য রকম। কোনো কিছুতেই চাপ অনুভব করি না।
৩. কোনো কিছু নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়াটা আমার ধাতেই নেই। আমাকে যদি না মনে করিয়ে দেন যে আমি নেইমার, আমি ব্রাজিল ও বার্সেলোনা দলে খেলি, তাহলে হয়তো আমি তা ভুলেই যাব।
৪. সবাই বলে, দলে সবচেয়ে বড় নাম বলে তোমার ওপর অনেক চাপ। কিন্তু আমি তো চাপের কিছূ দেখিই না। বরং বলব, আমি খুব সুখী।
এটা বোধ হয় বলার প্রয়োজন পড়ছে না যে, এই বিশ্বকাপে নেইমারের সুখ আর ব্রাজিলের সুখ একই সূত্রে গাঁথা।