স্বপ্নের ফাইনাল, না আতঙ্কের ফাইনাল?

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

স্বপ্নের ফাইনাল, না আতঙ্কের ফাইনাল?

এই ছবি দেখে ভুল বুঝবেন না। বরং ফুটবল নিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা চরম বৈরীতার বিপরীত চিত্র এখানে। ছবি: উৎপল শুভ্র

শেষ পর্যন্ত হয়নি। আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠলেও জার্মানির বিপক্ষে সেমিফাইনালে বিখ্যাত সেই ৭-১ ছিটকে দিয়েছে ব্রাজিলকে। এর আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল বোধ হয় এবার হয়েই যাচ্ছে। তবে সেই সম্ভাবনা যতটা রোমাঞ্চ জাগাচ্ছিল, ততটাই অস্বস্তি। কিছুটা আতঙ্কও!

প্রথম প্রকাশ: ৭ জুলাই, ২০১৪। প্রথম আলো।

‘যুদ্ধ’টা কি তাহলে হবেই? বিশ্বকাপের ড্র হওয়ার পর থেকেই যা নিয়ে আলোচনা, শেষ সপ্তাহে এসে সেই সম্ভাবনার গায়ে আরও রং লেগেছে। ১৩ জুলাই মারাকানায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল!

বিশ্বকাপ ফাইনাল দূরে থাক, চিরবৈরী দুই দক্ষিণ আমেরিকান পরাশক্তি একই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও ওঠেনি এর আগে। ‘স্বপ্নের ফাইনাল’ ‘স্বপ্নের ফাইনাল’ বলে কোরাসটা এখন তাই আরও তুঙ্গে, কিন্তু সত্যি সত্যি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মারাকানায় মুখোমুখি হলে সেটি না দুঃস্বপ্নের ফাইনালে রূপ নেয়! পরিস্থিতিটা এমনই বিস্ফোরণোন্মুখ যে, সেটি আসলে ফুটবল ম্যাচ হবে না, হবে যুদ্ধই।

ব্রাজিলিয়ানরা তা একদমই চাচ্ছে না। গত পরশু সন্ধ্যায় দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালের পর ব্রাসিলিয়ার ব্যস্ততম সুপার মার্কেটে বরং একটি চাওয়া মুখে মুখে ঘুরে ফিরল—ব্রাজিল-হল্যান্ডা! হল্যান্ডা মানে হল্যান্ড এবং ফাইনালে তাদেরই চাচ্ছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাকে নয়।

২০১৪ বিশ্বকাপ দেখতে আসা আর্জেন্টিনিয়ানদের ছোট্ট একটা দল। ছবি: উৎপল শুভ্র

৬৪ বছর আগে মারাকানায় অলিখিত ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে পরাজয় এখনো ব্রাজিলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাতীয় বিপর্যয় বলে বিবেচিত। যে ম্যাচের স্মৃতি মুছে ফেলতে জার্সি পর্যন্ত বদলে ফেলে ব্রাজিল। নীল কলারের সাদা জার্সির বদলে বিখ্যাত হলুদ জার্সির জন্মরহস্যও তাতে লুকানো। সেই ম্যাচের সময় জন্মই হয়নি, এমন ব্রাজিলিয়ানদের মুখও ‘মারাকানাজো’ বলতেই বেদনাবিধুর হয়ে ওঠে। কিন্তু ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হারলে সেই ‘মারাকানাজো’-ও নির্ঘাত জাতীয় বিপর্যয়ের তালিকায় দুই নম্বরে চলে যাবে। কাল সকালে ব্রাসিলিয়ার হোটেলের তরুণ রিসেপশনিস্ট যেটি ভাবতেই শিউরে উঠলেন, ‘মারাকানায় বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে গেলে সেটি হবে নরকের সমতুল্য।’ বলেই আবার সংশোধনী দিলেন, ‘না, নরকের চেয়েও খারাপ।’

ব্যাপারটা যে শুধুই একটি ফুটবল ম্যাচে জয়-পরাজয়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না, সেটির ‘কৃতিত্ব’ অবশ্যই আর্জেন্টাইনদের। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ব্রাজিল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর্জেন্টাইনরা। ‘দাপিয়ে বেড়ানো’ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই। আর্জেন্টাইন সমর্থক মানেই হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি, একের পর এক গান এবং বিশাল সব ব্যানার। অন্য সব দেশের সমর্থকদের সঙ্গে পার্থক্য হলো, নিজের দেশকে সমর্থনের পাশাপাশি ব্রাজিলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করাটাকে অবশ্যপালনীয় একটা কর্তব্য হিসেবে নেওয়া। যা নিয়ে উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে পরিস্থিতিটা এখন এমন যে, ব্রাজিলিয়ান নিরাপত্তাকর্মীরাও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনালকে রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন।

আমরা সবাই ব্রাজিল, আমরা সবাই নেইমার। ছবি: উৎপল শুভ্র

এমনিতেই আর্জেন্টাইন ফুটবল সমর্থকদের জঙ্গিপনার ‘সুনাম’ আছে। একসময় যে ‘হুলিগান’ কথাটা মূলত ইংলিশ সমর্থকদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো, সেটি পর্যন্ত বলতে গেলে নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিয়েছে তারা। ঘরোয়া ফুটবলে নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নিত্যকার ঘটনা। বিশ্বকাপে এসে অবশ্য সবাই একজোট। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচের আগের রাতে কোপাকাবানা সৈকতে চিরশত্রু রিভার প্লেট আর বোকা জুনিয়র্সের দুই সমর্থক যেমন নিজেদের এক আর্জেন্টিনার পতাকায় জড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এই এক মাস আমরা সবাই বন্ধু।’

‘বারাস ব্রাভো’ নামে কুখ্যাত আর্জেন্টাইন সমর্থক গোষ্ঠী এই বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পুলিশ তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে একযোগে কাজ করছে। তার পরও নিষিদ্ধ তালিকার একজন, পাবলো ‘বেবেতো’ আলভারেজ সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন ব্রাজিলে। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দেখে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পুলিশকে ব্যঙ্গ করে টুইটও করেছেন। সবুজ রং করা চুল, নকল গোঁফ ও ফ্ল্যামেঙ্গোর জার্সি গায়ে ঢুকে পড়েছিলেন ব্রাসিলিয়ার গ্যালারিতেও। তার পরও তাঁকে শনাক্ত করে পত্রপাঠ বুয়েনস এইরেসে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

একটু আগেও রিওর মেট্রোতে এই দলটা সমস্বরে গাইছিল ব্রাজিলকে উত্যক্ত করতে বাঁধা সেই গান। ছবি: উৎপল শুভ্র

এমন ‘আলভারেজ’ যে আরও আছেন, সেটির প্রমাণ সুইজারল্যান্ড ম্যাচের পর অ্যারেনা করিন্থিয়ানসে শ তিনেক চেয়ার ভাঙচুর। ব্রাসিলিয়ায় এর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে গত পরশু প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল গ্যালারিতে। ম্যাচ শেষ হওয়ার ঘণ্টা খানেক পরও মাঠ ছাড়ার নাম নেই দেখে জোর করেই বের করে দেওয়া হয়েছে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের। এর আগ পর্যন্ত গলা ছেড়ে গান গেয়ে গেছে তারা। ব্রাজিলকে ব্যঙ্গ করে রচিত ওই গানটাই বেশি। যে গানের কাছাকাছি বঙ্গানুবাদ হয় এমন—

ব্রাজিল আমাকে বলো, নিজের ঘরে

এমন নতজানু হয়ে থাকতে কেমন লাগছে

অনেক বছর চলে যাওয়ার পরও শপথ করে বলতে পারি

ম্যারাডোনা তোমাদের কেমন বোকা বানিয়েছিল

ক্যানি (ক্যানিজিয়া) কেমন চমকে দিয়েছিল

এখনো আমরা তা ভুলিনি

সেই ইতালি (বিশ্বকাপ ১৯৯০) থেকে শুরু করে

এখনো তোমরা কেঁদেই যাচ্ছ

এবার তোমরা দেখবে মেসিকে

বিশ্বকাপ হবে আমাদের

পেলের চেয়ে ম্যারাডোনা বড়। 

শুধু আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা গাইলে কথা ছিল। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের পর ড্রেসিংরুমের উৎসবে আর্জেন্টিনা দলও নাকি এই গান গেয়েছে। সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেট দুনিয়ায়। ব্রাজিলিয়ানরাও জবাব দিচ্ছে। তবে সেটিতে ঝাঁজ বড় কম। পাঁচবার বিশ্বকাপ জয়ের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি গানে। আরেকটি গান পেলে-ম্যারাডোনা বিতর্কের জবাব। সেটি এ রকম—

এক হাজার গোল

এক হাজার গোল

শুধুই পেলে

শুধুই পেলে

ম্যারাডোনা তো কোকেন টানে।

আর্জেন্টাইনরা এমন ‘নরম-সরম’ জবাবে বিজয়ীর হাসি হাসছে। আরও আক্রমণাত্মক হচ্ছে তাদের ভাষা। কখনো কখনো যা ভব্যতার সীমাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নেইমারের অমন মর্মান্তিক বিদায়ে লিওনেল মেসি সমবেদনা জানিয়েছেন। আলেসান্দ্রো সাবেলা কাব্যিকভাবে বলেছেন, নেইমারের মতো খেলোয়াড়দের অমন হলে ফুটবলও কাঁদে। অথচ বেলজিয়ামের বিপক্ষে জয়ের পর আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা নকল মেরুদণ্ড দেখিয়ে নেইমারের চোট নিয়েও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে ছাড়েনি। সুইজারল্যান্ড ম্যাচের আগে মাঠের পাশে ইতেকারা স্টেশনে দুদলের সমর্থকদের মধ্যে একবার লেগে যাওয়া ছাড়া এখনো বড় কিছু হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে মারাকানায় সম্ভাব্য ফাইনাল আতঙ্কই ছড়াচ্ছে।

লিওনেল মেসিকে `মেয়ে` সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন এই ব্রাজিল সমর্থক। ছবি: উৎপল শুভ্র

মজাটা হলো, সাফল্যের বিচারে অনেক পিছিয়ে থেকেও মাঠের বাইরে আর্জেন্টাইনরাই ‘জিতছে’। ব্রাজিল পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে, আর্জেন্টিনা দুবার। ১৯১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বুয়েনস এইরেসে দুই দেশের প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনা ৩-০ গোলে জিতেছিল। কিন্তু বিশ্বকাপে জয়-পরাজয়ের হিসাবে ব্রাজিলই এগিয়ে। ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপে দুদলের সর্বশেষ যে ম্যাচের কথা বলে ব্রাজিলকে খোঁচা দেওয়া হচ্ছে, সেই বিশ্বকাপের পর ব্রাজিল দুটি বিশ্বকাপ জিতেছে, ফাইনাল খেলেছে আরেকবার। আর্জেন্টিনা সেবারের পর সেমিফাইনালেই উঠল এই প্রথম। আলেসান্দ্রো সাবেলা আর্জেন্টাইন এই মনস্তত্ত্বের খুব ভালো একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘সেই ছেলেবেলা থেকেই আমি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, ফুটবলে আমরাই বিশ্বসেরা। অথচ তখন পর্যন্ত আমরা একটা বিশ্বকাপও জিতিনি। আমরা এ রকমই। এটাই আমাদের সংস্কৃতি।’

সেই সংস্কৃতির বিশ্বকাপকে এখন ‘বিশ্বযুদ্ধ’ বানিয়ে ফেলার উপক্রম!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×