ইউরো বনাম কোপা, পাঁচ ম্যাচের সিরিজ হলে কেমন হয়!

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

১৩ জুলাই ২০২১

ইউরো বনাম কোপা, পাঁচ ম্যাচের সিরিজ হলে কেমন হয়!

ইউরো-কোপা শেষ হলো একই দিনে। তবে শেষের রেশ রয়ে গেছে এখনো। চলছে পর্যালোচনা, কেমন ছিল ইউরো, কেমন ছিল কোপা; চলছে মহাদেশীয় দুই টুর্নামেন্টের তুলনাও। যেকোনো টুর্নামেন্ট শেষে সেরা একাদশ নির্বাচনের একটা রীতিও তো আছে। উৎপলশুভডটকম-এর হয়ে এর সবই করলেন কলকাতার নামী ফুটবল লেখক কাশীনাথ ভট্টাচার্য। সঙ্গে দিলেন অভিনব একটা প্রস্তাবও, ইউরো আর কোপার সেরা দল নিয়ে পাঁচ ম্যাচের একটা সিরিজ হলে কেমন হয়!

স্কট স্টাইরিস আর জিমি নিশাম, নিউজিল্যান্ডের দুই ক্রিকেটারের দুটি টুইটে এখন নেটসাগরে হাসির ঢেউ!

প্রাক্তন ক্রিকেটার স্টাইরিস লিখেছিলেন, ‘টাইব্রেকারের কী দরকার? ইংল্যান্ড তো বেশি কর্নার পেয়েছে, ওরাই চ্যাম্পিয়ন!’

আর নিশামের লেখায়, ‘পেনাল্টি শ্যুট আউট কেন? কেন নয় যে, যে দল বেশি পাস খেলেছে তারাই জয়ী?’

স্টাইরিস তথ্যে ঠিক। ইংল্যান্ড পাঁচটি কর্নার পেয়েছিল, ইতালি তিনটি। নিশামের কথা মানলে আবার গণ্ডগোল। ইতালি ৮২০ পাস খেলেছিল, ফুটবলে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ এনে-দেওয়া গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ডের ফাইনালে খেলা পাসের সংখ্যা ৪২৬! তাই, দু'বছর আগে বিশ্বকাপে যেমন আইসিসি বাউন্ডারির সংখ্যাবিচারে চ্যাম্পিয়ন করেছিল ইংল্যান্ডকে, উয়েফা-কে একই কাজ করতে হলে স্টাইরিসের পরামর্শই মানতে হত, নিশামের নয়।

ঘরের মাঠে সুইস রেফারি গটফ্রায়েড ডিয়েনস্ট-এর সিদ্ধান্তে ফুটবল বিশ্বকাপ (১৯৬৬) আর আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনার কারণে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় যে দেশের, নিজেদের ঘরে আরও একটি ফাইনাল খেলে রেফারি বা উয়েফার কর্নার-সংক্রান্ত নিয়মের সেই সমর্থন না পাওয়ায় সুসভ্য ইংরেজ জাতি এখন ইতালীয় সমর্থকদের যেমন খুশি মেরেধরে বিদায় করছে দেশ থেকে। বলা যায় না, চব্বিশ ঘণ্টা পরই হয়তো প্রথম বিশ্বের দেশে ঘোষণা হবে, ইতালীয়দের জন্যই করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ল টেমস খালের জলে!

আরও যা বিপজ্জনক, যে তিন ফুটবলার টাইব্রেকারে শেষ তিনটি পেনাল্টি থেকে গোলের সুযোগ হারিয়েছিলেন, তিনজনই অশ্বেতাঙ্গ-- মার্কাস রাশফোর্ড, জ্যাডন সাঞ্চো এবং বুকায়ো সাকা। শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা এই হার ভালোভাবে নেননি, ইতালীয়দের বিরুদ্ধে আচরণেই পরিষ্কার। সেমিফাইনালে টাইব্রেকারেও সেই দর্শককুল তো বিপক্ষের গোলরক্ষকের চোখে লেজার রশ্মি ফেলেছিলেন! তাই আগামী মরসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এই তিন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারের প্রতি কেমন আচরণ হবে এবং আদৌ ইংরেজ ফুটবলে হাঁটু গেড়ে মাঠে বসে থাকার দৃশ্য আর দেখা যাবে কি না, ঘোরতর সন্দেহ।

দুই মহাদেশ মিলিয়ে ৩২ দিনের মহাযুদ্ধ শেষ একইভাবে। ফাইনালে ঘরের মাঠ মারাকানায় হারল ব্রাজিল, ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ড। জয়ী দুই দলের একটি, আর্জেন্টিনা যদি ২৮ বছর পর কোপা জিতে থাকে, ইতালি ইউরো জিতল ৫৩ বছর পর! তবে, আর্জেন্টিনা যেমন এই ২৮ বছরে কোনো ট্রফিই জেতেনি, ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল ইতালি। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক স্তরে বড় ট্রফি ইতালি জিতল ১৫ বছর পর।

৫৩ বছর পর ইউরোপ-সেরার ট্রফি ইতালিতে

দুটি প্রতিযোগিতায় ২৮ ও ৫১ মিলিয়ে মোট ৭৯ ম্যাচের পর ফুটবলালোচনাই মুখ্য হওয়া উচিত। কী দেখলাম, কী পেলাম ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করতে গিয়ে অবশ্য আবারও বেন স্টোকসের ব্যাটের ধাক্কায় বলের বাউন্ডারি পেরনোর পর হাত-কাঁধ-ব্যাট ঝাঁকিয়ে ‘আমি-তো-কিছুই-করিনি’ অবস্থা!

যা করার করেছে কোপা আমেরিকা। ইংরেজি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবুর থেকে মোসাহেব দল যেমন বলে, বাংলা সংবাদমাধ্যমও জোরগলায় ঘোষণা করেছে-- এত জঘন্য ফুটবল, দেখাই যায় না। একটা পাস নেই, কোনক মুভমেন্ট নেই, নামগন্ধ নেই সৃজনশীলতার, আর ফাউলে ছয়লাপ। ইউরো সেখানে প্রাচীনকালের ক্রিকেটের পোশাকের রঙের মতোই শ্বেতশুভ্র, কলঙ্কের দাগ ‘নাহি তায়’ টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে দামী ডিটারজেন্টের দাবির মতোই, একেবারে!

অর্থাৎ, যা দাঁড়াল-- ইউরোয় সব পাসই দুরন্ত, ডিফেন্স চেরা; ইউরোয় সব মুভমেন্ট দুর্ধর্ষ; ইউরোয় গতির ঠ্যালায় উসাইন বোল্টও পেছনে; আর অতি অবশ্যই যা সবার ওপরে, ইউরোয় সৃজনশীলতার জয়গান।

মুশকিল হল, সৃষ্টিশীলতা প্রতিফলিত হয় ফলে! ফুটবলে সৃষ্টিশীল মানুষ কী করবেন? বিপক্ষের গোলমুখ খুলে দেবেন হাট করে, স্ট্রাইকাররা চরম অবহেলায় গোল করে আসবেন। কখনো বা তিন-চারজনকে কাটিয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করবেন, যখন গোলে বল ঠেলছেন, পেছনে ডিফেন্ডার এবং গোলকিপার মাঠের ঘাসে সাঁতার কাটছেন! ৫১ ম্যাচে এমন সৃষ্টিশীল ফুটবল কতবার দেখা গিয়েছে, গোনা হয়নি। যা লেখা থাকছে ইতিহাসে– নকআউটে ১৫-র মধ্যে ৮ ম্যাচের ফয়সালা হয়েছে অতিরিক্ত সময় এবং টাইব্রেকারে। ১৫-র মধ্যে আট মানে অর্ধেকের বেশি, পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ম্যাচে এমন সৃজনশীলতার দেখা নাই রে!

মুভমেন্ট যদি এতই সুদৃশ্য হয়, বিপক্ষ রক্ষণ কেটে যাবে না, গোলমুখ খুলে যাবে না? ১২০ মিনিট পরও তেমন না হওয়ার কারণেই তো টাইব্রেকার! রক্ষণ যদি পড়েই নিতে পারে পাসের ভবিষ্যৎ, সে মুভমেন্ট দেখতে সুন্দর হতেই পারে কোনো ব্যাখ্যাবিহীন কারণে, কিন্তু, সৃজনশীল বলা যাবে কি?

ফুটবল মাঠের দৈঘ্য মোটামুটি ১০০-১১০ গজ। তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। ৩০-৪০/৫০-৩০ গজ, প্রতিটি ভাগে। টেকনিক্যাল নাম দেওয়া আছে– ডিফেন্সিভ থার্ড, মিডল থার্ড আর অ্যাটাকিং থার্ড। এবার দেখা গেল, কোনও একটি দল তাদের ডিফেন্সিভ থার্ড থেকে শুরু করে বিপক্ষের ডিফেন্সিভ থার্ড বা নিজেদের অ্যাটাকিং থার্ড পর্যন্ত প্রায় ৫০-৫৫ গজ দুরন্ত দৌড়য়। গতি প্রচুর, লম্বা লম্বা স্ট্রাইড, টেলিভিশনে সম্প্রচারকারী সংস্থার ক্যামেরা-স্পিড– সব মিলিয়ে ঝকঝকে উপস্থাপনায় এক চলমানতা তৈরি হয়। পুরনো দিনের বাংলা ছবি একঘণ্টা আর আজকের চীনা-হলিউডি বা দক্ষিণ ভারতীয় ছবির এক ঘণ্টা পরপর দেখুন, ক্যামেরা-স্পিড কী জিনিস বুঝতে আর কোনো কিছুর দরকার নেই।

অবিকল দেখুন একই পার্থক্য কোপা আর ইউরোর সম্প্রচারেও। কোপা যদি প্রাচীনকালের মুভি, ইউরো সেখানে চীনা-হলিউডি। মুশকিলটা হল, এই চলমানতা তৈরি করা, সুকৌশলে। একই ক্যামেরা প্রযুক্তির খেলা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ আর সিরি আ বা লা লিগার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। দেখার আকর্ষণ কমিয়ে দেওয়ার স্বার্থে, যাতে একটিই ‘প্রোডাক্ট’ অর্থাৎ ইপিএল-ই মানুষ ব্যস্ত হয়ে দেখে। বিশ্বকাপে যখন ইউরোপের কোনো দেশের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশের খেলা দেখেন, এই চলমানতার অভাব চোখে পড়ে না কারণ, সব ম্যাচই একই প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার চোখে ধরা দেয়। কিন্তু, বিশ্বকাপ তো চার বছরে এক মাস। মাঝের এই তিন বছর এগার মাসে আপনাকে বিকর্ষিত করে তুলতে যথেষ্টর চেয়েও বেশি।

যা বলছিলাম, ওই ৫০-৫৫ গজ তীব্রগতিতে ছোটার কথা। গোল সাধারণত হয় পরের ওই তিরিশ গজেই। সেখানেই আসল পরীক্ষা সৃষ্টিশীলতার। চিন্তায় কতটা এগিয়ে রয়েছেন, স্কিলের সঙ্গেই ফুটবলবোধেরও পরীক্ষা। দৌড়বীরদের দেখা যায় ওখানে পৌঁছেই হয় তুলে দিলেন নয় শট নিলেন। ২৫-৩০ গজ দূর থেকে জোরালো শটে গোল দেখতে খুবই ভালো। কিন্তু তা আরও বেশি করে তুলে ধরে চিন্তার দৈন্য। পাস খেলে বিপক্ষ রক্ষণে ফাটল ধরাতে না পারার অক্ষমতা।

ট্রফি জিতে আনন্দ করতে কেমন লাগে, সেটি প্রায় ভুলেই গিয়েছি আর্জেন্টিনা

তার মানে কি কোপায় অত্যন্ত সৃষ্টিশীল ফুটবল হয়েছে? একেবারেই নয়, হওয়া সম্ভবও নয়। এখানে অনেকটা দোষ আমাদের বাংলা সংবাদমাধ্যমের। সেই ছোট থেকে পড়তে পড়তে বড় হয়েছি, লাতিন আমেরিকা মানেই ফুটবল শিল্পের ফুলঝুরি। এই ‘শিল্প’টা ঠিক কী, কখনো সংজ্ঞা-উদাহরণসহ তুলে ধরা হয়নি। ঘটনা হল, অনেকটা ব্রাজিল আর কিছুটা আর্জেন্টিনা ছাড়া বাকি দক্ষিণ আমেরিকা কখনো ফুটবল-শিল্পের পতাকা বহন করেনি। মাঝেমাঝে এক-আধজন এনজো ফ্রান্সেসকোলি বা কার্লোস ভালদেরামা এসেছেন, আমরা উদ্বাহু হয়েছি। কিন্তু উরুগুয়ে-কলম্বিয়াও চিলি-পেরু-প্যারাগুয়ের মতোই, ধ্বংসাত্মক ফুটবল খেলে এসেছে। আর্তুরো ভিদালরা সেখানে হামেস রদ্রিগেজের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ থেকেছেন।

খুব সুন্দর ইংরেজি শব্দবন্ধ আছে– ‘আনস্কিলড লেবার’। আজকের দুনিয়াজুড়ে ফুটবলে এই আনস্কিলড লেবারদের প্রাধান্য এবং এরও প্রধান ও একমাত্র কারণ ইউরোপ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা থেকে প্রতিভাবানদের দশ-এগার-বারো বছর বয়সেই তুলে আনা হচ্ছে, ফেলে দেওয়া হচ্ছে ইউরোপীয় একাডেমির ছাঁচে। ফুটবলে শিল্প বলতে প্রাথমিক যা বোঝায়, ড্রিবলিং। বিপক্ষকে কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। ইউরোপ শেখায় পাসিং। পাশের লোকটাকে যত তাড়াতাড়ি পাস করবে সে আবার তত তাড়াতাড়ি তোমাকে পাস ফেরত দেবে, এর ফলে এক অদ্ভুত তাড়া-র সৃষ্টি হবে এবং সেই তাড়াতাড়িতেই বিপক্ষ রক্ষণ ভুল করবে বলে ধরে নেওয়া। তাড়ায় ভুল করবে আর ভুল করতে বাধ্য করানো – দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। আসল পার্থক্যটা এখানেই। নিখুঁত পাস ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ড্রয়িংয়ের মতো, নির্ভুল ছবি, কম্পিউটারে ফেলা। হাতে-আঁকা ছবিতে কল্পনার মিশেল। কখনো তা অসাধারণ, কখনো আবার নিতান্ত সাধারণ। যেহেতু অসাধারণ ছবি বেশি আঁকা সম্ভব নয়, সাধারণত্বের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যেতে হয়।

ফুটবল-দর্শক নিজেদের মতো করে মেসি-নেইমার খোঁজে বা ক্রুস-মডরিচ। ইউরোপের লাতিন অংশ অর্থাৎ ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল গুরুত্ব দেয় অন দ্য বল খেলাকে, উত্তরাংশ অফ দ্য বল মুভমেন্টকে। তাই দক্ষিণাংশ থেকে ইনিয়েস্তা-রোনালদো পাওয়া যায়, ইনসিনিয়েও, বল ধরে খেলাটা পছন্দ যাদের, পেয়েই পাস দেওয়ার চেয়ে। তাঁদের ফুটবলও দৃষ্টিনন্দন বেশি। অন্য অংশটা কার্যকরী, তুলনায় সহজবোধ্য, মানুষ সহজে আকৃষ্ট হয় নির্ভুল খেলায়। কোনোটাই অনস্বীকার্য নয়, অবশ্যম্ভাবীও নয়। পার্থক্য ধরনে-মননে।

এখন, কমবয়সে সাধারণ প্রতিভাবানদের ঝাঁক ইউরোপে নিয়ে এসে ফুটবল বিশ্বজুড়ে একটা একই রকম ছাঁচ তৈরির খেলাটা যেহেতু অনেক বছর ধরেই চলে আসছে, সব দেশের খেলাতেই তেমন একটা আগমার্কা ইউরোপীয় ছাপ। তার প্রতিফলন যদি দেখতে চান, নীচের তালিকায় চোখ রাখুন ---

কোপা বনাম ইউরো। ছবি: উৎপলশুভ্রডটকম

* পেনাল্টি থেকে যতগুলি গোল হয়েছে। কোপায় এই পেনাল্টি-কনভার্সান ৮৫ শতাংশ, ইউরোয় ৫২ শতাংশ।

ম্যাচ-প্রতি ফাউলের সংখ্যা বেশি কোপায় আর গোলের সংখ্যায় এগিয়ে ইউরো। ফাউল বেশ কোপায়, কিন্তু কত বেশি? ম্যাচ প্রতি চারটি করে, মানে, প্রতিটি দল গড়ে দুটি করে ফাউল বেশি করেছে। সংখ্যাটা কি এতই বেশি যে, কোপা মানেই ফাউল আর ইউরো মানেই পরিষ্কার খেলা? কোপা ফাইনালে ৩৯ ফাউল হয়েছিল, ইউরো ফাইনালে ৩৫। ব্যবধান সেই চার অর্থাৎ দুটি করে দুই দলের। বিরাট পার্থক্য? কে জানে!

এবার, দক্ষিণ আমেরিকার রেফারিদের ফাউল দেওয়ার প্রবণতাও ইউরোপের তুলনায় বেশি। ইউরো-ফাইনালে ফেদেরিকো কিয়েসা মার খেয়ে মাঠের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হলেন, খেলতেই পারলেন না। সেটা ফাউল হিসাবে বিবেচিত হয়নি ডাচ রেফারির কাছে! কেন, ব্যাখ্যা দেবেন রেফারি, আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ম্যাচ জুড়ে এমন ঘটনা, মানে নিশ্চিত ফাউল মনে হচ্ছে কিন্তু রেফারি দিচ্ছেন না, অন্তত বারদশেক দেখা গিয়েছে বললেও কম! প্রতিযোগিতায় মোট ৫১ ম্যাচে এই সংখ্যাটা তা হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? ইউরোর অন্যতম স্লোগান ছিল, পরিষ্কার ইউরো তুলে ধরা। রেফারিদের সেই কারণে মাঝমাঠে সাধারণ পেশাদার ফাউলের ক্ষেত্রে ‘গো স্লো’ নির্দেশ দেওয়া হয়নি, মেনে নেওয়া সম্ভব? ‘ক্লিনার ইউরো’ দেখাতে গেলে কম ফাউলও দেখাতেই হবে যে!

কিন্তু তর্ক-বিতর্কে এই সমস্যা মেটার নয়। যতই তথ্য তুলে ধরা হোক না কেন, যাঁর যা বিশ্বাস জন্মেছে ক্রমাগত একমাত্রিক লেখার প্রচারে, সেখান থেকে সরে আসা কঠিন শুধু নয়, অসম্ভব। তার ওপর ইউরোপ সম্পর্কে আমাদের ঔপনিবেশিক মনে এমনিতেই একটা গদগদ ভাব আছে। যা শোনানো হয়, সহজে বিশ্বাসযোগ্য। তুলনায় দক্ষিণ আমেরিকা অনেক দূরের দেশ তো বটেই, আমাদের মতোই প্রায় তৃতীয় বিশ্ব। সেখানকার সমস্যা-টমস্যা, যেগুলো তুলে ধরা হয়, আমরা সহজেই মিলিযে নিতে পারি নিজেদের সঙ্গে। তাই ওই মহাদেশ সম্পর্কে জনমানসে ভক্তিভাব নেই-ই প্রায়, যে মাথ নুইয়ে মেনে নেওয়াটা আছে ইউরোপ সম্পর্কে।

বরঞ্চ, সেই কারণেই অন্য একটা খেলা হওয়া উচিত। পাঁচ ম্যাচের সিরিজ হোক। পাঁচটা ম্যাচের দুটি হবে দক্ষিণ আমেরিকায়, ধরা যাক ব্রাজিলের রিও দে জেনিরোর মারাকানা এবং আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের এস্তাদিও মনুমেন্টালে। অন্য দুটি ম্যাচ ইউরোপে, হয়তো মিউনিখের অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনা এবং বার্সেলোনার ক্যাম্প ন্যুতে। আর শেষ ম্যাচটি এশিয়ার কোনও একটি নিরপেক্ষ দেশে, জাপান হতেই পারে। সরাসরি এই দুই প্রতিযোগিতার সেরা দলের লড়াই হোক, পাঁচ ম্যাচে। ফলাফল চোখের সামনেই থাকবে তখন!

দুটি সেরা দলও বেছেই নেওয়া যাক। এই প্রতিবেদকই নির্বাচক যেহেতু, মন মতো সেরা একাদশ হতেই পারে এমন -

ইউরো একাদশ – জিয়ানলুইজি ডোনারুমা (ইতালি); জোয়াকিম মাহলে (ডেনমার্ক), লিওনার্দো বোনুচ্চি (ইতালি), ডেভিড আলাবা (অস্ট্রিয়া), লিওনার্দো স্পিনাজ্জোলা (ইতালি);  কেভিন ডি ব্রুইন (বেলজিয়াম), এনগোলো কান্তে (ফ্রান্স), পেদ্রি (স্পেন); ফেদেরিকো কিয়েসা (ইতালি), প্যাট্রিক শিক (চেক প্রজাতন্ত্র), ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল)

দক্ষিণ আমেরিকা একাদশ– এমিলিয়ানো মার্তিনেজ (আর্জেন্টিনা); ইয়েরি মিনা (কলম্বিয়া), মারকুইনোস (ব্রাজিল), হোসে মারিয়া গিমেনেজ (উরুগুয়ে), নিকোলাস তালিয়াফিকো (আর্জেন্টিনা); লুকাস পাকেতা (ব্রাজিল), কাসেমিরো (ব্রাজিল), লুইজ দিয়াজ (কলম্বিয়া); লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা), জিয়ানলুকা লাপাদুলা (পেরু), নেইমার জুনিয়র (ব্রাজিল)।

একদিকে মেসি অধিনায়ক, অন্যদিকে ক্রিস্টিয়ানো অবশ্যই। মেসির দলে কোচ লিওনেল স্কালোনি, কোপা-চ্যাম্পিয়ন। রোনালদোর দলে রবার্তো মানচিনি, ইউরো-চ্যাম্পিয়ন। ক্লাবগুলোকে বলে দেওয়া হোক, মাসখানেকের বাড়তি ছুটি দেওয়া হোক, করোনার বাজারে।

রোজগার নিয়ে ভাবনার জায়গাই নেই। এত টাকা দিতে রাজি হবেন স্পনসররা যে, সংগঠকদের লাভের অঙ্ক আকাশ ছুঁতে চাইবে। প্রতি ইউরো-কোপার বছরে, দুটি প্রতিযোগিতা শেষে এমন একটা ‘উইন্ডো’ খুলে দিক ফিফা, বাড়তি উদ্যম নিয়ে। তারাই আয়োজন করুন। বিশ্ব ক্লাব কাপের চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজক এবং আকর্ষণীয় হবে এই প্রতিযোগিতা, নিঃসন্দেহ!

খেলা হোক!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×