মেসির স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখল এমিলিয়ানোর বিশ্বস্ত হাত
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
৭ জুলাই ২০২১
এবারের কোপায় ফাইনালের আগ পর্যন্ত নির্ধারিত ৯০ মিনিটে মীমাংসা না হলেই টাইব্রেকার। সেই টাইব্রেকারই বাঁচিয়ে রাখল আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মেসির ট্রফি জয়ের স্বপ্ন। তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখলেন আসলে আর্জেন্টেনিয়ান গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। এখন অপেক্ষা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনালের।
আর্জেন্টিনা – ১ (লাউতারো ৭') কলম্বিয়া – ১ (দিয়াজ ৬১')
(টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা জয়ী ৩-২)
ম্যারাডোনার নাপোলির হাতেই কি থমকে যাবে মেসির স্বপ্নের দৌড়? টাইব্রেকার শুরু হতেই চিন্তার কালো মেঘ। কলম্বিয়ার গোলরক্ষক-অধিনায়ক দাভিদ ওসপিনার ক্লাবও যে নাপোলি!
শেষে অবশ্য পাল্টে গেল চিত্রনাট্য। উঠে এলেন অ্যাস্টন ভিলার ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। নিজের বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে টাইব্রেকারে তিন-তিনটি পেনাল্টি বাঁচিয়ে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে গেলেন কোপার ফাইনালে। তাঁর অধিনায়ক লিওনেল মেসির দেশকে ট্রফি দেওয়ার স্বপ্ন বেঁচে থাকল তাঁর বিশ্বস্ত হাতে।
গ্রুপ লিগেও চিলির বিরুদ্ধে আর্তুরো ভিদালের পেনাল্টি আটকেছিলেন এমিলিয়ানো। কিন্তু ফিরতি বল থেকে গোল করে গিয়েছিলেন ভারগাস। পেনাল্টি বাঁচানোর ক্ষেত্রে এমিলিয়ানোর দক্ষতা অবশ্য দেখেছে ক্লাব ফুটবলও। আর্সেনাল গত বছরেই কমিউনিটি শিল্ড জিতেছিল লিভারপুলের বিপক্ষে, টাইব্রেকারে। তিনকাঠির নিচে ছিলেন এমিলিয়ানোই। যদিও সেই টাইব্রেকারে তাঁকে একটিও শট বাঁচাতে হয়নি।
আন্তর্জাতিক স্তরে প্রথম পেনাল্টি-নাটকে অবশ্য তিনিই নায়ক। সানচেজ, মিনা আর কারদোনার শট বাঁচিয়ে আর্জেন্টিনাকে তুলে নিয়ে গেলেন ফাইনালে, ঠিক যেমন সার্জিও গয়কোচিয়ার হাত ধরে ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছেছিল ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। মেসির আর্জেন্টিনাকে আরেকটি বিশ্বকাপের ফাইনালে তোলাতেও তো এক গোলকিপারের টাইব্রেকার-বীরত্ব। ২০১৪ বিশ্বকাপে হল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও নায়ক আরেক 'সার্জিও'। সার্জিও রোমেরো।
আগামী ১১ জুলাই অনেকে ইতিহাসের সাক্ষী রিওর মারাকানা স্টেডিয়ামে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা, নেইমারের বিরুদ্ধে মেসি – এর চেয়ে বড় মহাদেশীয় ফাইনাল ফুটবলে আর কী হতে পারে!
মেসির অ্যাসিস্ট, লাউতারোর গোল
ব্রাসিলিয়ার এস্তাদিও দে নাসিওনাল-এ সেমিফাইনালে শুরুতেই গোল পেতে পারত আর্জেন্তিনা। অধিনায়ক সাজিয়ে দিয়েছিলেন লাউতারো মার্তিনেজকে, ম্যাচের চতুর্থ মিনিটেই। কিন্তু ইন্টার মিলানের স্ট্রাইকারের হেড অল্পের জন্য বাইরে। তিন মিনিট পরই অবশ্য ভুল শুধরে নেন লাউতারো। এবার সেলসো-র থেকে বল পেয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে আবারও লাউতারোকে পাস দিয়েছিলেন সেই মেসিই। ডান পায়ের শট ওসপিনার ডানদিকের জালে রেখে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন লাউতারো।
এবারের কোপায় পঞ্চম অ্যাসিস্ট মেসির। দেশের হয়ে গোলসংখ্যার (৭৬) মতোই অ্যাসিস্ট সংখ্যাতেও সবার ওপরে। শুধু কোপা আমেরিকা প্রতিযোগিতাতেই ১৭টি গোলের পাস বেরল তাঁর পা থেকে। আর দেশের হয়ে ১৫০তম ম্যাচে আপাতত তাঁর অ্যাসিস্ট সংখ্যা ৪৭! প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা জরুরি, পেলে এবং দিয়েগো ম্যারাদোনার ক্ষেত্রে দেশের হয়ে এই অ্যাসিস্ট-সংখ্যা যথাক্রমে ৩৩ এবং ২৮।
দিয়াজের দারুণ গোলে সমতা
এমিলিয়ানোর হাত এবং বার ও পোস্ট আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে রেখেছিল প্রথমার্ধে। গোল খাওয়ার পরের মিনিটেই জুভেন্টাসের হুয়ান কুয়াদ্রাদোর জোরালো শট আটকে দিয়েছেন এমিলিয়ানো। আর ৩৭ মিনিটে পরপর দুবার তেকাঠিতে আটকে যেতে হয় কলম্বিয়াকে। প্রথমে একটি শট আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে দিক পাল্টে পোস্ট ছুঁয়ে বাইরে। আর সেই কর্নার থেকেই ইয়েরি মিনার হেড ধাক্কা খায় বারে।
বিরতিতে তিনটি পরিবর্তন করেছিলেন কলম্বিয়ার কোচ রেইনালদো রুয়েদা। দুই পরিবর্ত ফাবরা এবং কারদোনা শুরু থেকেই বিপজ্জনক। ফাবরা এসেই মেসিকে বাড়তি নজরে রাখছিলেন, প্রয়োজনে শরীর ব্যবহার করেই। আর প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময় থেকে কলম্বিয়া যে চাপ বাড়িয়ে রেখেছিল, ফল পেল ৬১ মিনিটে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দেশের ক্লাব এফসি পোর্তোয় খেলা লুইস দিয়াজের দুরন্ত গোলে। বাঁদিকে বলটা পেয়ে দিয়াজ দ্রুত চলে এসেছিলেন আর্জেন্টিনার গোলের সামনে। এমিলিয়ানো এগিয়ে এসে কোণ ছোট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওখান থেকেও পড়ে যেতে যেতে বাঁ পায়ে দুর্দান্ত রেখে গেলেন দিয়াজ, আর্জেন্টেনিয়ান গোলরক্ষকের বাড়ানো হাতের ওপর দিয়ে, দূরের পোস্টে। বাঁ দিকের মাঝমাঠ থেকে তাঁর দৌড় তারপরও বারবারই সমস্যায় ফেলল আর্জেন্টিনার রক্ষণকে, শেষ পর্যন্ত।
মাঝমাঠের লড়াই
কোপা আমেরিকায় কলম্বিয়ার এবার শুরুটা ছিল নিষ্প্রভ। ব্রাজিলের গ্রুপে তৃতীয় হয়ে উঠে এসেছিল নকআউটে। উরুগুয়ের বিপক্ষে জিততে হয়েছিল টাইব্রেকারে যেখানে চারটি শটেই গোল করেছিলেন কলম্বিয়ার ফুটবলাররা আর অধিনায়ক ওসপিনা বাঁচিয়েছিলেন দুটি শট। ওই ম্যাচেই ইঙ্গিত ছিল, শারীরিক ফুটবলে বিপক্ষের খেলার ছন্দ নষ্ট করে দিয়ে কাজ হাসিল করতে পারেন ইয়েরি মিনারা। সেমিফাইনালে হলোও ঠিক তাই।
গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ার পর ম্যাচে ফাউলের সংখ্যা ক্রমশ বাড়াল কলম্বিয়া। পেশাদার ফাউল। ম্যাচে মোট ফাউল ৪৭টি – কলম্বিয়ার ২৭, আর্জেন্তিনার ২০। হলুদ কার্ড রেফারির পকেট থেকে বেরোল দশবার। ছ’জনকে দেখালেন হলুদ জার্সির কলম্বিয়ার, চারজন আর্জেন্টেনিয়াকেও। বিপক্ষ যখন ধরেই মাঠে নামে যে, তুলনায় একটু হলেও এগিয়ে-থাকা দলকে আটকাতে হবে খেলার স্বাভাবিকতা নষ্ট করে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এই ফাউলের সংখ্যাধিক্য। তাই দে পল-খুইদো-লো সেলসোর তিনজনের মাঝমাঠ অন্য দিনের কার্যকারিতা হারাল উল্টোদিকের চার জন দিয়াজ-গুস্তাভো-বারিওস-বোরের পায়ে। একমাত্র দিয়াজের স্বাধীনতা ছিল আক্রমণে যাওয়ার। বাকি তিনজনই লোস কাফেতেরোস রক্ষণকে সহায়তা করতে তৈরি। বিরতির পর ইম্মি শারা ও কারদোনাকে এনে যে-কাজে বাড়তি নিরাপত্তা জুড়েছিলেন কলম্বিয়ার কোচ।
আর্জেন্টিনার সুযোগ নষ্ট
নিকোলাস গঞ্জালেসের কাছে সুযোগ এসেছিল বিরতির ঠিক আগেই ২-০ করে ফেলার। মেসির কর্নার ঠিক মাথায় পড়েছিল ২২ বছর বয়সী বোলোগনার ফরোয়ার্ডের। হেডও ঠিকই নিয়েছিলেন, তবে সোজা ওসপিনার হাতেই। কিন্তু যে-সুযোগ নষ্ট করেছিলেন লাউতারো, টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা হেরে গেলে গঞ্জালো হিগুয়েইনের মতো তাঁকেও গঞ্জনা শুনতে হতো আজীবন।
৭২ মিনিটে কলম্বিয়ার রক্ষণে মুনোজের বড় ভুলে পরিবর্ত ডি মারিয়া বল পেয়ে গিয়েছিলেন ফাঁকায়। আগুয়ান গোলরক্ষক ওসপিনাকেও কাটিয়ে নিয়েছিলেন দি মারিয়া। বল দিয়েছিলেন ফাঁকায় দাঁড়ানো লাউতারোকে। গোললাইনে কলম্বিয়ার ডিফেন্ডার অসহায় দাঁড়িয়ে। লাউতারো যেন তাক করেই মারলেন তাঁর পায়ে! এদিক-ওদিক একটুও যেতে হয়নি, বলও ওঠেনি মাটি ছেড়ে যে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি তুলতে হবে পা। গোল বাঁচানোর এমন সুযোগ কেউ পায়ে করে তাঁর পায়ে এনে দিতে পারেন, ভাবতেও পারেননি হয়ত মিনা। তিনি গোল বাঁচানোর পর ডি মারিয়াও সুযোগ পেয়েছিলেন গোলের। কিন্তু, ব্যর্থ।
আর্জেন্টিনার কোচ পরিবর্ত হিসাবে মাঠে এনেছিলেন ডি মারিয়াকে। পিএসজি-র ফুটবলার গোলের সুযোগ এনে দিয়েছিলেন মেসির সামনেও। অধিনায়কের দিনটা যদিও খুব ভালো গেল না। অনিচ্ছাকৃত হলেও ফাউলে আঘাত পেলেন, মাঠের বাইরে গিয়ে শুশ্রুষা করিয়ে ফিরতে হলো রক্তপাত বন্ধ করতে। দু’বার এমন জায়গায় ফ্রি কিক পেয়েছিলেন, অধুনা যেখানে তিনি বল বসালেই গোল ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাচ্ছিল না। কিন্তু দুবারই দেয়ালে মারলেন। ঠিক যেমন ডি মারিয়ার পাঠানো বল ধরেও পোস্টে।
মেসির সামনে
সবচেয়ে বড় সুযোগ ১৯৯৩-এর পর আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের ট্রফি-খরা কাটানোর। এই মারাকানাতেই তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বড় আঘাত এসেছিল। মারিও গোটজের গোলে জার্মানি যখন জিতেছিল অতিরিক্ত সময়ে। সাত বছর পর ওই মারাকানা থেকেই নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের স্বপ্ন এখন সত্যি করে ফেলার সুযোগ।
আর মেসি যখন, কিছু রেকর্ডের হাতছানিও থাকবেই। কোপা আমেরিকায় নিজের ৩৩তম ম্যাচ খেলে ফেললেন, সর্বোচ্চ ম্যাচের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে-থাকা ব্রাজিলের জিজিনিও-কে ছুঁয়ে ফেললেন বুধবার। চিলের গোলরক্ষক ‘এল সাপো’ সার্জিও লিভিংস্তোন ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত ছয়টি কোপায় মোট ৩৪ ম্যাচ খেলেছিলেন, যা সর্বোচ্চ। ফাইনালে মাঠে নামলেই তাঁকেও ছুঁয়ে ফেলবেন লা আলবিসেলেস্তে অধিনায়ক।
কোপায় সর্বোচ্চ ১৭ গোলের রেকর্ড থেকে অবশ্য অনেকটাই দূরে তিনি। এখন গোল ১৩। তবে, এবারের প্রতিযোগিতায় চার গোল ও পাঁচ অ্যাসিস্ট নিশ্চিতভাবেই তাঁকে এগিয়ে রাখছে সেরা ফুটবলারের পুরস্কারের দিকে। ব্যক্তিগত এই পুরস্কার অবশ্য মেসির একেবারেই অপছন্দ, দল যদি ট্রফি না পায়। ২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপের সোনার বলও নিতে চাননি তাই, ফাইনালে হেরে।
এক সময়ের বার্সেলোনা-সতীর্থ নেইমারের সঙ্গে যতই বন্ধুত্ব থাক কিংবা চুক্তিহীন তাঁকে নিজের ক্লাব পিএসজি-তে নিয়ে যেতে যত আগ্রহীই থাকুন না কেন নেইমার, ফাইনালের আগে সবই পেছনে এখন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিজের পঞ্চম ফাইনালে মেসির স্বপ্ন এখন একটাই।
সেটি কী, আপনিও তা জানেন।