নেইমারের কাছে ফুটবল মানে...
উৎপলশুভ্রডটকম
৫ জুলাই ২০২১
মাঠে খেললে চোট, আর মাঠের বাইরে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ--নেইমারের সময়টা ভালো যাচ্ছে না মোটেই। তবে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে চাপালেই সেই বাজে সময়ের আভাস মিলছে না মোটেই। প্রাণোচ্ছল ফুটবলে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখছেন সবাইকে। নেইমারও জানালেন, ফুটবল খেলে অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারাতেই তাঁর আনন্দ।
মাঠে তাঁর পায়ে ফুটবল মানে এক ঝলক তাজা হাওয়া। বল নিয়ে কারিকুরি আর ড্রিবলিংয়ের জাদুতে আবিষ্ট দর্শক-মন। এই আবিষ্ট করে রাখার কাজটা করে আসছেন সেই কৈশোর থেকেই। বয়স যতই বাড়ুক, বল পায়ে এখনো যেন তিনি সেই কিশোর, যার কাছে ফুটবল মানে একটাই। খেলার আনন্দে খেলে যাওয়া। পেশাদার ফুটবলের কঠিন পৃথিবীও যে আনন্দ কেড়ে নিতে পারেনি তাঁর কাছ থেকে। মাঠে নেইমারের সেই আনন্দ সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দর্শক-মনে। তাঁর পায়ে বল যাওয়া মানেই বাড়তি কিছু দেখার প্রত্যাশা, যা খেলা শেষেও চোখে লেগে থাকবে। প্রশ্নটা যদি হয় দেখার সৌন্দর্য, তবে নেইমারের নামটা মনে হয় শুরুর দিকেই থাকবে।
তবে এই সৌন্দর্যটা কতক্ষণ ধরে উপভোগ করা যাবে, গত বছর দুই-আড়াই যোগ হয়েছে এই প্রশ্নটাও। নেইমারকে মাঠে দেখা যাবে কি না, প্রতি ম্যাচের আগে এই জিজ্ঞাসাটাই তো সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় এখন। ইনজুরির সঙ্গে লুকোচুরি খেলা অনেক আগে থেকেই। কিন্তু ২০১৮ সালের শুরু থেকে যদি হিসাব করেন, তাহলে নেইমারের আসল লড়াইটা বুঝতে সুবিধা হবে। চোট-অসুস্থতা মিলিয়ে এই সময়ে তাঁকে মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে ৪৪৪ দিন! প্রীতি ম্যাচের কথা বাদই দিন, মিস করতে হয়েছে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সেলোনা-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচও।
শুধু তো ইনজুরি নয়, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অনেক কিছুই। নাইকির এক কর্মী তাঁর বিরুদ্ধে যৌন-হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন ২০১৮ সালে, যা নিয়ে তদন্ত এখনো চলমান। এরই মধ্যে তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে নেইমারের সঙ্গে দীর্ঘ ১৫ বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে দিয়েছে নাইকি।
সব মিলিয়ে নেইমারের জন্য মনের আনন্দে ফুটবল খেলাটা তাই কঠিনই ছিল। এবারের কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের দ্বিতীয় ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে ৪-০ গোলে জয়ের পর ম্যান অব দ্য ম্যাচের প্রতিক্রিয়া জানাতে আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করার কারণ হয়তো এটাই। উদ্গত অশ্রু সামলাতে সামলাতে নেইমার বলেছেন, 'গত দুই বছরে আমাকে অনেক জটিল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে ব্রাজিলের হয়ে খেলে আমি যে আনন্দটা পাই, কোনো সংখ্যার সাধ্য নেই তা প্রকাশ করে।'
অনাবিল আনন্দ নিয়ে খেললে নেইমার কী করতে পারেন, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে পরিসংখ্যানেই। পেরুর বিপক্ষে ওই ম্যাচেই করেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৬৮তম গোল। ১০৯ ম্যাচ খেলে ৬৮ গোলই বুঝিয়ে দিচ্ছে ব্রাজিলের জার্সির সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। সঙ্গে যদি ৪৮টা অ্যাসিস্ট যোগ করেন, তাহলে তা আরও ভালো করে বুঝিয়ে দেবে। অ্যাসিস্টের সংখ্যায় পেলেকে ছাড়িয়ে গেছেন, গোল-সংখ্যাতে ছাড়িয়ে যাওয়াও মাত্রই দশ গোলের ব্যাপার। যদিও এসব সংখ্যা তাঁর মধ্যে বাড়তি কোনো আলোড়ন তোলে না বলেই দাবি নেইমারের। হ্যাঁ, এসবের তাৎপর্য আছে তাঁর কাছে। তবে সেটি নিজেকে ছাড়িয়ে আরও বৃহত্তর তৃপ্তিতে পরিব্যাপ্ত। যে কারণে তিনি বলেন, 'আমি যে ইতিহাস গড়ে যাচ্ছি, আমার পরিবার-বন্ধুবান্ধবরা তা নিয়ে গর্বিত হলেই হলো। এত গোল করেছি, এত অ্যাসিস্ট…ব্রাজিল জাতীয় দলের জার্সি পরার কাছে এসব সংখ্যা কিচ্ছু না।'
পেরুর ওই ম্যাচে কোপায় টানা দ্বিতীয় জয় পেয়ে সবার আগে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেছিল ব্রাজিল। দুই সপ্তাহেরও আগের সেই ম্যাচ আর নেইমারের ম্যাচ পরবর্তী আবেগময় প্রতিক্রিয়ার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার কারণ অবশ্য এটা নয়। আসল কারণ, সেমিফাইনালে সেই পেরুই এখন ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ। দেশের মাটিতে টানা দ্বিতীয় কোপা জয়ের স্বপ্ন পূরণের ফাইনালে ওঠার পথে ব্রাজিলের সর্বশেষ বাধা। যে বাধা পেরোতে যথারীতি নেইমারের দিকেই বেশি প্রত্যাশাভরে তাকিয়ে আছে পুরো ব্রাজিল।
দুই বছর আগে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কোপায় খেলা হয়নি ইনজুরির কারণে। তাঁকে ছাড়াই ব্রাজিল অবশ্য ট্রফি জিতেছে। এবারের কোপা আমেরিকায় খেলতে নেইমারের তাই বাড়তি একটু আগ্রহ থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। অথচ টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই গুঞ্জন উঠল, টুর্নামেন্ট থেকে নাকি নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিতে পারেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা।
সেই সময়টা নিয়েও নেইমার অকপটে জানাচ্ছেন, 'যখন এখানে এসেছিলাম, আসলে কী হচ্ছে, তা জানতাম না। কোপা আমেরিকা হবে কি হবে না, তা-ও না। তবে আমরা কর্তৃপক্ষকে সম্মান করি, আর জাতীয় দলকে তো আমরা কখনোই "না" বলব না। আমি তো ব্রাজিলের হয়ে খেলার ব্যাপারে আপত্তি করার কথা ভাবতেই পারি না। দ্বিমত-ভিন্নমত থাকবেই, তবে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধও আছে। কোনো কিছু মনে এলে আমরা অকপটে বলে ফেলি। আর এখন তো খেলছিই। তবে সত্যি যদি বলি, পরিস্থিতিটা একটু জটিলই ছিল।'
শেষ পর্যন্ত যে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে ব্রাজিলের প্রতি দায়বোধ তো আছেই, সঙ্গে যোগ হয়েছে বাড়তি একটা প্রেরণাও। ফুটবল দিয়ে ক্ষণিকের জন্যও যদি মানুষকে এই ভয়ঙ্কর সময়টা ভুলিয়ে রাখা যায়! করোনা ভাইরাসে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত দেশগুলোর সামনের কাতারে ব্রাজিল। নেইমার তাই বলছেন, 'এখন সময়টা কঠিন। এই সময়ে আরেকজনের মুখে হাসি ফোটাতে পারা প্রবল আনন্দের।'
চার ম্যাচ খেলে গোল আর অ্যাসিস্ট সমান দুটি করে, সঙ্গে ডিফেন্স চেরা পাস, বলতে গেলে সারা মাঠ জুড়ে খেলা, মিডফিল্ড থেকে লম্বা দৌড় আর বল নিয়ে কাড়িকুড়ি তো আছেই। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার ছাড়া আর সবার মুখে নেইমার হাসিই ফোটাচ্ছেন!