অস্ট্রিয়াকে কি কৃতজ্ঞতাই জানাচ্ছেন মানচিনি?

ভিত্তরিও পোজ্জোকে ছাড়িয়ে টানা ৩১ ম্যাচে জয়

উৎপল শুভ্র

২৭ জুন ২০২১

অস্ট্রিয়াকে কি কৃতজ্ঞতাই জানাচ্ছেন মানচিনি?

রবার্তো মানচিনির এই উদযাপনে আনন্দের সঙ্গে মনে হয় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ায় অনুভূতিও মিশে আছে

ভিত্তরিও পোজ্জোর ইতালির ৮২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার ম্যাচটা এমনিতেই মনে থাকত রবার্তো মানচিনির। এখন আরও বেশি থাকবে অস্ট্রিয়ার অভাবিত প্রতিরোধের কারণে। শুধু প্রতিরোধই বা বলছি কেন, সবাইকে অবাক করে অস্ট্রিয়া তো কাঁপিয়েই দিয়েছিল ইতালিকে।

ফুটবল ইতিহাসে দুটি বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র কোচ ভিত্তরিও পোজ্জো। অমরত্ব নিশ্চিত করতে আর কি লাগে! সেই অমরত্ব বিশ্ব ফুটবলের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেই। ইতালিয়ান ফুটবলের কিংবদন্তি, এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন পোজ্জোর ইতালির আরেকটা রেকর্ড এই এত বছর ধরে অস্পর্শনীয়ই মেনে আসা হয়েছে ইতালিয়ান ফুটবলে। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে টানা ৩০ ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড।

সেই ভিত্তরিও পোজ্জো এখন অতীত। পোজ্জো অতীত মানে তাঁর ইতালি দলের অপরাজিত থাকার সেই রেকর্ড আর কি! ৮২ বছর টিকে থাকা সেই রেকর্ড ভেঙে ইতালিয়ান ফুটবলের নতুন নায়ক এখন রবার্তো মানচিনি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নেশনস কাপে পর্তুগালের কাছে ১-০ গোলে পরাজয়ের পর টানা ৩১টি ম্যাচে 'পরাজয় কাহাকে বলে', তা জানে না মানচিনির দল।

ইতালিয়ান রেকর্ড হয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক রেকর্ডটাও বেশি দূরে নয়। টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার যে রেকর্ডে এখন ব্রাজিল ও স্পেনের যুগ্ম অধিকার। সেই রেকর্ড ভাঙতে হলে মানচিনির ইতালিকে এই ইউরো তো জিততে হবেই, এরপরও জিততে হবে আরও দুটি ম্যাচ। ইউরো জেতাটা একদমই বিস্ময় হবে না । গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই জিতে নিজেদের অন্যতম ফেবারিট হিসেবে তো প্রতিষ্ঠিত করেই ফেলেছে ইতালি, এটা একটা কারণ। আরেকটা কারণ, মানচিনির ইতালির জন্য কোনো কিছুই অসাধ্য বলে মনে হচ্ছে না।

আসলেই কি তাই? দ্বিতীয় রাউন্ডের যে ম্যাচটাকে নিছকই আনুষ্ঠানিকতা ভেবে ইতালিয়ান সমর্থকেরা কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল হলে ভালো হয়, নাকি বেলজিয়াম ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন; সেই ম্যাচেই অস্ট্রিয়া কি কাঁপিয়ে দেয়নি ইতালিকে? নির্ধারিত সময়েই ইতালির জালে বল পাঠানোর অসাধ্যও তো সাধন করে ফেলেছিল প্রথমবারের মতো ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা অস্ট্রিয়া। সেই গোল ভিএআরে বাতিল হয়ে যাওয়ার পরও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে অতিরিক্ত সময়ের ৫ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে ইতালিকে।

যে অতিরিক্ত সময় শুরু হয়েছিল নিদারুণ অস্বস্তি নিয়েই। নকআউট পর্বের ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যাওয়া ইতালির জন্য নতুন কিছু নয়। নতুন বলতে অতিরিক্ত সময়ে গোল করা। ইউরোতে এর আগে সাতবার অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে ইতালির গোল করার কথা কেউ মনে করতে পারেন না। গোল করতে না পারলে আর মনে করবেন কীভাবে! বরং ইউরোর অতিরিক্ত সময় মানেই ইতালিয়ান সমর্থকদের মনে ফিরে আসা ২০০০ ইউরো ফাইনালের সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি। ডেভিড ত্রেজেগের 'গোল্ডেন গোলে' স্বপ্নভঙ্গ।

এবার সেই ইতালিই যে কোণঠাসা ৪৫ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ে দুই গোল করে ফেলল, এতেও আপনি মানচিনির এই ইতালির একটা ভিন্ন চরিত্র খুঁজে পেতে পারেন। যা বেশ কিছু দিন ধরেই ফুটবল বিশ্বে সবচেয়ে চর্চিত বিষয়গুলোর একটি। ২০১৮ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে না পারার অভাবনীয় বিপর্যয়ে ইতালিয়ান ফুটবলে যখন ঘোর অমানিশা, তখন দায়িত্ব নিয়ে মানচিনি যেভাবে ইতালির পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন, তা সাম্প্রতিক ফুটবলের রোমাঞ্চকর গল্পগুলোর একটি। ইউরোতে ইতালি প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার আগে এ নিয়ে এই ওয়েবসাইটেই প্রকাশিত ইতালির শেষকৃত্য, ইতালির পুনর্জন্ম শিরোনামে দারুণ একটা লেখাতে যার কিছুটা বিবরণ আছে। যেটি পড়লে মানচিনি কীভাবে কী করেছেন, এ সম্পর্কে একটা ধারণাও পেয়ে যাবেন। 

এভাবে জয় পাওয়ার পর উল্লাসটা এমনই হওয়ার কথা। অস্ট্রিয়াকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যাওয়ার পর ইতালি দল। ছবি: ডেইলি মেইল

অপরাজিত ৩১ ম্যাচের যে স্বপ্নযাত্রা, তার শেষ ১২টিই জিতে নিজেদের গড়া ইতালিয়ান রেকর্ডটাকে আরেকটু উপরে তুলে নিয়েছে মানচিনির ইতালি। ১২তম জয়ের ম্যাচেই হয়েছে আরেকটা নতুন রেকর্ড। এই ম্যাচের আগে ১০৫৫ মিনিট ইতালির জালে কোনো গোল হয়নি। নিজেদের রেকর্ড নিজেরাই ভাঙলে বাড়তি একটা তৃপ্তি হয় কিনা, কে জানে! তবে সবচেয়ে বেশি সময় গোল না খাওয়ার বিশ্ব রেকর্ডটা ছিল ইতালিরই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৮২ বিশ্বকাপজয়ী ইতালি দলের অধিনায়ক দিনো জফের। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে ১৯ ঘণ্টারও বেশি সময় ইতালির জালে বল ঢুকতে দেননি দিনো জফ। মিনিটের হিসাবে যা ১১৪৩। 

এই রেকর্ড ছুঁতে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ৮৮ মিনিট গোল না খেলেই চলত। ইতালি গোল খেয়েছে ১১৪ মিনিটে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোল না খাওয়ার রেকর্ডটা এখন তাই ১১৬৯ মিনিট। জফের রেকর্ড টিকে ছিল ৪৭ বছর, এটা ভাঙতে কত বছর লাগে, কে জানে! আগের রেকর্ডটাকে গোলকিপারের নামে চালিয়ে দিচ্ছি, নতুনটা কেন দলের নামে, এটা বোধ হয় আপনার জানাই আছে। ১১৬৯ মিনিট অক্ষত মানচিনির ইতালির গোলপোস্টে যে দিনো জফের মতো শুধু নির্দিষ্ট একজন গোলকিপারই দাঁড়াননি।

ওই গোলটা খাওয়াতেই অবশ্য আরেকটা রেকর্ড ছোঁয়া হলো না। টানা ১২ ম্যাচে গোল না খাওয়ার ইতালিয়ান রেকর্ড। এটাও দিনো জফের সেই অভেদ্য হয়ে থাকার সময়টাতেই। মাত্রই তৃতীয়বারের মতো ইউরোতে এসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাউন্ড, সেই অস্ট্রিয়া যে ইতালির শিরদাঁড়া বেয়ে এমন ভয়ের স্রোত বইয়ে দেবে, এটা কারও কল্পনাতেও ছিল না। আর এমন চমকে দেওয়া একটা ম্যাচ নিয়ে লেখায় কিনা শুধুই সংখ্যার কচকচানি আর রেকর্ড ভাঙা-গড়ার ঝনঝনানি শব্দ! আপনার একটু বিরক্ত হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তবে রেকর্ডগুলো এমনই যে, তা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। খেলা তো আপনি দেখেছেন বলেই অনুমান করি।

এই দেখেন না, রেকর্ড নিয়ে এত কথা বলার পরও একটা তো এখনো বাদই আছে। কারণ হয়তো এটাই যে, রেকর্ডটা পুরোনো, মানে এই ম্যাচের উৎপাদন নয়। তবে রবার্তো মানচিনি কী করেছেন, তা বোঝাতে সেটির পুনরুল্লেখ করাটা কর্তব্য বলে মনে হচ্ছে। মানচিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ৩৬ ম্যাচে এটি ইতালির ২৭তম জয়। বাকি নয় ম্যাচের ৭টিতে ড্র, পরাজয় মাত্র দুটিতে। জয়ের সংখ্যাটাকে যদি পার্সেন্টেজে হিসাব করেন, তা অবিশ্বাস্য এক আকার নেয়। ৭৫ পার্সেন্ট! কমপক্ষে ১০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে সীমানাটা আটকে দিয়ে হিসাব করলে সাফল্যের এই হার ইতালিয়ান ফুটবলে সেরা। এই রেকর্ডকে সঙ্গী করেই অবশ্য ইউরোতে এসেছিলেন মানচিনি।

ফুটবল কোচরা এসব হিসাব-নিকাশ রাখেন বলেই অনুমান করি। নিজেরা না রাখলেই বা কি, মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য মিডিয়া আছে না! তবে মানচিনির মাথায় এখন এসব আছে বলে মনে হয় না। তিনি নিশ্চয়ই অস্ট্রিয়া ম্যাচ নিয়ে কাটাছেড়ায় ব্যস্ত। মানে মানে পার হয়ে যেতে পেরেছেন বলে অস্ট্রিয়ার প্রতি হয়তো একটু কৃতজ্ঞতাই জানাচ্ছেন মনে মনে। পর্তুগাল বা বেলজিয়ামের মুখোমুখি হওয়ার আগে তাঁর দলের এমন পরীক্ষা নিয়ে উপকারই তো করেছে অস্ট্রিয়ানরা। 

ভিত্তরিও পোজ্জোর রেকর্ড ভাঙার ম্যাচটা এমনিতেও রবার্তো মানচিনির মনে থাকত। এখন তো আর ভোলার প্রশ্নই ওঠে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×