এবার কোন গল্প লিখছেন, রোনালদো?
উৎপল শুভ্র
১৬ জুন ২০২১
আগের চারটি ইউরো আবেগের নানা রঙের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। শিরোপার সঙ্গে উপহার দিয়েছে ডালা ভর্তি রেকর্ডও। জীবনের শেষ ইউরোতে সেই ডালায় যোগ করার মতো আরও অনেক রেকর্ডের হাতছানি। এবার কোন গল্প লিখবেন বলে ঠিক করেছেন রোনালদো, কে জানে!
রেকর্ড তাঁর পায়ে পায়ে ঘোরে, ঘুরছে, ঘুরবে।
লাইনটা লিখে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম, বাহ্, বেশ লিখলাম তো!
একের পর এক রেকর্ড গড়া কোনো ফুটবলার যদি রেকর্ড করে যেতেই থাকেন এবং সামনে হাতছানি দিতে থাকে আরও অনেক রেকর্ড, তার মানে তো রেকর্ড তাঁর পায়ে পায়েই ঘোরে। ফুটবল তো পা দিয়েই খেলা হয়, তাই না!
ব্যাখ্যাটা লিখতে লিখতেই অবশ্য মনটা একটু খচখচ করতে শুরু করল। লেখার হেডিং থেকেই তো জেনে গেছেন, বিষয় এখানে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। অন্য সব বাদ দিয়ে রোনালদোর রেকর্ড প্রসঙ্গটা যদি ইউরোতেই সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে পায়ের সঙ্গে যে ‘মাথা’-ও যোগ করতে হয়। ইউরোতে তাঁর নয় গোলের পাঁচটিই হেড করে। তাহলে তো মানতেই হচ্ছে, অন্তত গোলের রেকর্ডের ক্ষেত্রে ‘পায়ে পায়ে ঘোরে’-এর সঙ্গে ‘মাথায় মাথায় ঘোরে’ কথাটাও যোগ করে দিতে হয়! ও হ্যাঁ, হেডে পাঁচ গোলও আর কারও নেই। তার মানে এটাও একটা রেকর্ড!
৩৬ বছরের ‘তরুণ’ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পঞ্চম ইউরো শুরুর দিনেও যথারীতি কিছু রেকর্ড তাঁর পায়ে (নাকি মাথায়) লুটিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। যে প্রসঙ্গেই লেখায় এসে পড়ছেন মিশেল প্লাতিনি। ফুটবল থেকে বিতাড়িত হয়ে আমার কৈশোরের প্রেম এখন কোথায় কী করছেন, ঠিক জানি না। তবে এটা জানি, আজ যদি হাঙ্গেরির বিপক্ষে পর্তুগালের ম্যাচ দেখতে বসেন, তা বসবেন ৩৭ বছর ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা রেকর্ডটা বিসর্জন দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই। ইউরোতে সবচেয়ে বেশি গোলের সেই রেকর্ডে পাঁচ বছর আগের সর্বশেষ ইউরোতেই ভাগ বসিয়েছেন রোনালদো। এবার সেটিতে একক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার পালা।
সবচেয়ে বেশি ম্যাচের রেকর্ড আগেই হয়ে গেছে, সবচেয়ে বেশি গোলেরও, এবার পর্তুগাল একটা জয় পেলেই হয়ে যাবে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে জয়ের রেকর্ডও। শেষটাতে পেছনে ফেলবেন ফ্যাব্রিগাস ও ইনিয়েস্তাকে। ফিকশ্চারটা দেখে প্রথমেই যা মনে হয়েছিল, সেটাও এবার বলি। রোনালদো যেন টুর্নামেন্টটা যুগল রেকর্ড দিয়ে শুরু করতে পারেন, সেভাবেই যেন এটি ডিজাইন করা। পর্তুগাল যে গ্রুপে পড়েছে, সেটির নাম ‘এফ’ না হয়ে ‘ডি’ হলেই বেশি মানাত। ‘ডি’-তে ডেথ, ডেথ মানে মৃত্যু, আক্ষরিক অর্থেই এটি ডেথ গ্রুপ, মৃত্যুকূপ। কারণ গ্রুপের বাকি দুই দলের নাম ফ্রান্স ও জার্মানি।
ফ্রান্স সর্বশেষ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। জার্মানি ঠিক আগের বিশ্বকাপের। এদের সঙ্গে ইউরোর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন রোনালদোর পর্তুগাল, পাঁচ বছর আগে ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়েই যাদের প্রথম ইউরোপ জয় । ফ্রান্স-পর্তুগাল, জার্মানি-পর্তুগাল, ফ্রান্স-জার্মানি…প্রথম রাউন্ডেই এমন তিনটি ম্যাচের কথা ভাবতেই তো জিবে জল এসে যাচ্ছে। এর যেকোনোটিই যে ফাইনাল হতে পারত। দর্শক হিসেবে আমাদের জিবে জল আসাই স্বাভাবিক, তবে এই তিন দলের জন্য নিশ্চয়ই ব্যাপারটা প্রীতিকর নয়। দর্শকের জন্যও আফসোসের কারণ হয়ে না গেলেই হয়! ছয় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপের সঙ্গে নকআউট পর্বে উঠবে গ্রুপে তৃতীয় হওয়া সেরা চার দলও। ‘এফ’ গ্রুপটা এমন কঠিন বলে এই তিন দলের কোনোটিকে টপকে অন্য পাঁচ গ্রুপে তিন নম্বরে শেষ করা পাঁচ দলের সম্ভাবনা কি একটু বেশি?
এই জটিল হিসেব-নিকেশে এখন না যাওয়াই ভালো। রোনালদোকে নিয়ে লিখছি, রোনালদোতেই থাকি। প্রথম ম্যাচটা হাঙ্গেরির সঙ্গে পড়ায়্ আজই দুটি রেকর্ড রোনালদোর শুধুই নিজের করে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলছিলাম। সেই সম্ভাবনা বাস্তব না হওয়াটাকে অবাস্তবোচিতই মনে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি গোল, সবচেয়ে বেশি জয়ের মতো বড় বড় রেকর্ডের কথা বলতে বলতে রোনালদোর আরেকটি রেকর্ডের কথা বলতে ভুলেই গেছি। বাছাই পর্বে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডটিও তাঁর। সব মিলিয়ে কী দাঁড়াচ্ছে? উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদো-রাজের কথা বলতে গেলে লিওনেল মেসিও উঁকি দেন, কিন্তু ইউরোতে তিনি একেবারেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট। এমনই যে, মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণী ট্রফিটাতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম খোদাই করে দেওয়ার দাবিও তুলে ফেলতে পারেন কেউ।
তবে ইউরোতে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডটা শুধুই রোনালদোর হয়ে গেলেও ভবিষ্যতে এ নিয়ে যখন কথা হবে, একটু বিরতি দিয়ে হলেও মিশেল প্লাতিনি নামটা অবশ্যই বলতে হবে। কারণ একটা ক্ষেত্রে চিরদিন তিনি এক এবং অনন্য হয়েই থাকবেন বলে মনে হয়। এখন পর্যন্ত রোনালদোর নয় গোল যেখানে চার আসরে ২২ ম্যাচ খেলে, প্লাতিনির নয় গোল এক আসরেই। সেটিও মাত্র পাঁচ ম্যাচে। ১৯৮৪ ইউরোর মোহনীয় সেই ফ্রান্স দলের হয়ে প্লাতিনির যে কীর্তির সঙ্গে তুলনা হতে পারে শুধু ১৯৫৮ বিশ্বকাপে আরেক ফরাসির কীর্তির সঙ্গেই। এক বিশ্বকাপে জাস্ট ফন্টেইনের ১৩ গোলের রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনা আর আগামী সপ্তাহেই পৃথিবীর করোনামুক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা মোটামুটি সমান বলেই ধরে নেওয়া যায়। পার্থক্য একটাই, প্লাতিনির ব্যক্তিগত কীর্তি দলকেও চ্যাম্পিয়ন করেছিল। ফন্টেইনের ক্ষেত্রে যা হয়নি।
ইউরোর ইতিহাস নিয়ে যেকোনো আলোচনায় ফ্রান্স ১৯৮৪ যে আসবেই আসবে, তার কারণ শুধু মিশেল প্লাতিনি নন। তিনি ছিলেন তারকাকূলে বৃহস্পতি, তবে সেই ফ্রান্সের পুরো দলটাই ইউরোর সবচেয়ে রোমান্টিক গল্প হয়ে আছে। ফ্রান্স শিরোপা জেতার পর ওয়ার্ল্ড সকারের কাভারে লেখা হয়েছিল: ট্রফি টু ফ্রান্স, গ্লোরি টু ফুটবল। ইউরোর ইতিহাসে আর কোনো দলের ভাগ্য এমন স্তুতি জোটেনি।
এটা যদি অনন্য হয়, রোনালদোর পর্তুগালের একমাত্র ইউরো জয়ও কিন্তু তা-ই। বলছি রোনালদোর পর্তুগাল, অথচ রোনালদো মাঠে ছিলেন মাত্র ২৪ মিনিট, যার শেষ ১৬ মিনিট আবার অবধারিত পরিণতির কাছে আত্মসমর্পণ করার নিস্ফল লড়াই। ৮ মিনিটে পাওয়া চোট শেষ পর্যন্ত তাঁকে দর্শক বানিয়েই ছেড়েছিল, কিন্তু রোনালদো মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই পর্তুগাল যেন আরও বেশি করে 'রোনালদোর পর্তুগাল' হয়ে উঠেছিল। ডাগ আউটে কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের পাশে উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকা সেই রোনালদোকে দেখা অমর এক অভিজ্ঞতা হয়ে আছে আমার জন্য। এবং নিশ্চিতভাবেই জানি, আমি এখানে নিঃসঙ্গ নই। সাইড লাইনের সেই রোনালদোকে কখনো কখনো ম্যাচের চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর বলে মনে হচ্ছিল। সেই ফাইনালের রোনালদো ‘শ্যাডো কোচ’ কথাটাও ফুটবল অভিধানে ঢুকিয়েই দিয়েছেন একরকম। তবে আর কখনো তা ব্যবহৃত হবে বলে মনে হয় না। এমন কিছু কি কেউ আর দেখবে কোনোদিন!
রোনালদো বলেই অমন হয়েছে। একবার একই পরিস্থিতিতে রোনালদোর বদলে মেসিকে কল্পনা করার চেষ্টা করুন তো! মেসি কী অমন করতেন? থাক্, কল্পনা করার দরকার নেই। কারণ কল্পনাতেও অমন উজ্জীবনী একটা ভূমিকায় মেসির ছবি আঁকা যাবে না।
২০১৬-টা হয়তো একটু বেশিই নাটকীয় হয়ে গেছে, তবে রোনালদোর প্রতিটা ইউরোই কিন্তু মনে দাগ কেটে থাকার মতো কোনো না কোনো ছবির জন্ম দিয়েছে। নিজেদের দেশে ২০০৪ ইউরো। রোনালদো তখন মাত্রই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে এক মৌসুম কাটানো তরুণ তুর্কি। ইউরোর ইতিহাসে সেই প্রথমবারের মতো উদ্বোধনী ম্যাচের দুই দল আবারও মুখোমুখি ফাইনালে। যাতে গ্রিসের বিপক্ষে পরিষ্কার ফেবারিট স্বাগতিক পর্তুগাল। রেজাল্ট সেটিকে থোড়াই কেয়ার করার পর তরুণ রোনালদোর সেই কান্নার ছবি কাঁদিয়েছিল পর্তুগিজ গ্যালারিকেও।
চার বছর পর জার্মানির কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর আর কাঁদেননি। কারণ স্কোরলাইন ৩-২ বললেও সেই ম্যাচে জার্মানি আধিপত্য বলতে গেলে মোটামুটি নিরঙ্কুশই ছিল। ২০১২ ইউরো বরং রোনালদোর জন্য অনেক বেশি ট্র্যাজিক। একদিক থেকে ২০০৪ ফাইনালে হারার চাইতেও। স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে গড়ানো সেমিফাইনালে পর্তুগালের শেষ শটটা তাঁরই নেওয়ার কথা। অথচ তা নেওয়ারই সুযোগ পেলেন না। সতীর্থদের ব্যর্থতায় এর আগেই যে ‘ব্রেক’ হয়ে গেছে ‘টাই’। ফ্যাব্রিগাসের শটে পর্তুগালের বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর মাঝমাঠে দাঁড়ানো হতাশায় দুই হাতে মুখ ঢাকা রোনালদোকে দেখে মনে হয়েছিল, ফুটবল এখানে বোধ হয় বেশিই নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে ফেলল। পরদিনের পত্রিকার জন্য ডায়েরিতে তাই লিখেছিলাম, 'রোনালদো যেন সেই সম্রাট, যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই যিনি শুনলেন, একটু আগে যুদ্ধই শেষ হয়ে গেছে!'
রোনালদোর আগের চারটি ইউরোর স্মৃতিচারণা করতে করতে ভাবছি, জীবনের শেষ ইউরোতে কোন ছবিটা আঁকতে যাচ্ছেন সি আর সেভেন? স্পেনের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে পর্তুগালকে পরপর দুটি ইউরো জিতিয়ে মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরেছেন ট্রফি, নিজে পাঁচ গোল করে ছুঁয়ে ফেলেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে ইরানের আলী দাইয়ির সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড (১০৯)...না, একটু রূপকথা-রূপকথা হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা!
আবার এটাও মনে হচ্ছে, ৩৬ বছরের জীবনে পায়ে-পায়ে রূপকথা তো আর কম লেখেননি 'মাদেইরা বিস্ময়'! ও হ্যাঁ, পায়ের সঙ্গে 'মাথা'টাও যোগ করে দেওয়া ভালো।