সর্বশেষ আট আসরে সাত চ্যাম্পিয়ন!
যে কারণে ভবিষ্যদ্বাণী করা বোকামি
মাইকেল কক্স
১২ জুন ২০২১
ফ্রান্স, পর্তুগাল, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ড... ছয়টা নাম তো বলে দেওয়া যায় এক নিশ্বাসেই। সঙ্গে যোগ করুন এই তথ্য, শেষ আট আসরে ভিন্ন সাত দল জিতেছে ইউরোর শিরোপা। দলগুলোর খেলার ধরনেও নেই আগেকার দিনের মতো পার্থক্য নেই। তাই, `কে জিতবে ইউরো` প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চুপ থাকাটাই কি শ্রেয় না?
একটা নির্দিষ্ট টুর্নামেন্টের ধরন বা পরিবেশ কী রকম হবে, সেটা মূলত নির্ভর করে সেটা কোন দেশে আয়োজিত হচ্ছে তার ওপর। আর্জেন্টিনায় ১৯৭৮ বিশ্বকাপের কথা মনে করে দেখুন, আপনার স্মৃতিতে ভেসে উঠবে টিকার টেপের কথা; মেক্সিকো ১৯৮৬ বিশ্বকাপ মানেই মেক্সিকান ওয়েভ আর দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০ বিশ্বকাপ মাতিয়েছিল ভুভুজেলা।
যদিও নির্দিষ্ট কোনো দেশ নয়, বরং স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো থেকে আজারবাইজানের বাকু পর্যন্ত সমগ্র ইউরোপ জুড়ে মোট ১১টি দেশের ১১টি শহরে বসতে যাচ্ছে ব্যতিক্রমী এক আসর, তবুও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একেবারে খাঁটি ইউরোপিয়ান একটি টুর্নামেন্টকে আলাদা করে মনে করাবে, এমন স্বতন্ত্র কোন বৈশিষ্ট্য এবারও খুঁজে নেয়া কঠিন। তারপরও স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এই মহামারীর মধ্যে মাঠে সীমিত দর্শক নিয়ে একটা মহাদেশীয় ফুটবলের আসর বসতে যাচ্ছে--এটাই সম্ভবত এবারের আসরকে অন্য সব ইউরো থেকে আলাদা করে রাখবে।
একটা সময় ছিল, যখন নির্দিষ্ট কিছু ইউরোপীয় দলের খেলার ধরনটা আগে থেকেই মোটামুটি বলে দেয়া যেত: জার্মানদের খেলার ধরন ছিল এক রকম, ডাচদের ছিল আরেক রকম, ইংলিশরা একভাবে খেলত, আবার স্প্যানিশদের ছিল নিজস্ব ছন্দ। আপনি যদি টানা দুই বছর ইতালির খেলা না দেখেও থাকতেন, তারপরও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন, পরের ম্যাচটি তারা কীভাবে খেলতে যাচ্ছে।
মাত্র এক দশক আগের বিশ্বকাপ ২০১০ বা ইউরো ২০১২ দিকেই ফিরে দেখুন না: এক দিকে ছিল স্পেন, যাদের কৌশল ছিল, বল যত বেশি সম্ভব নিজেদের দখলে রেখে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করা। অন্যদিকে ছিল জার্মান ঘরানার ফুটবল, যেখানে গুরুত্ব দেয়া হতো শারীরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সুরটা কেটে দিয়ে দ্রুত প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়া।
তবে আজকের যুগে কিন্তু এত সহজে দলগুলোর গায়ে এই ট্যাগগুলো লাগিয়ে দেয়া যায় না। কারণ এখন দলগুলো খেলার নির্দিষ্ট একটা ধরন আঁকড়ে থাকে না; কৌশলগত বৈচিত্র্যই আধুনিক ফুটবলের মূল সুর। জাভি হার্নান্দেজ বা জাবি আলোনসোর বিদায়ের পর স্প্যানিশরা যেমন ধীরে ধীরে টিকিটাকা থেকে সরে এসেছে, তেমনি জার্মানরাও অনুধাবন করেছে প্রতি-আক্রমণ নির্ভর ফুটবল খেলে শীর্ষ পর্যায়ে সাফল্য পাওয়া কঠিন।
শুধু খেলার ধরন কেন, খেলোয়াড়রাও কি বিশ্বায়নের এই যুগে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকছে? ২০১০ বিশ্বকাপে স্প্যানিশ স্কোয়াডের ২৩ জনের মধ্যে ২০ জনই লা লিগায় খেলত, আর জার্মান স্কোয়াডের সবাই বুন্দেসলিগায়। কিন্তু বছর কয়েক পরেই অবস্থাটা দেখুন: জাবি আলোনসো, জাভি মার্টিনেজ এবং থিয়াগো আলকানতারারা যেমন বুন্দেসলিগায় এসে ঘাঁটি গাড়লেন, তেমনি স্যামি খেদিরা, মেসুত ওজিল কিংবা টনি ক্রুজরা থিতু হলেন স্পেনে।
আগে যেমন স্প্যানিশ বা জার্মান ঘরানা নাম দিয়ে দুইটা সম্পূর্ণ পৃথক স্কুল অব ফুটবলকে আপনি আলাদা করে ফেলতে পারতেন, এখন সেটা একেবারেই নেই। যুগটা এমনই যে আপনি লা লিগায় প্রতিষ্ঠিত একজন জার্মান ফুটবলারকে কোন দ্বিধা ছাড়াই জার্মান জাতীয় দলে খেলাতে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য বুন্দেসলিগায় প্রতিষ্ঠিত একজন স্প্যানিশ ফুটবলারের ক্ষেত্রেও। উভয় ক্ষেত্রেই সেই খেলোয়াড়ের জন্য নিজেকে মানিয়ে নেয়া কঠিন কোনো কাজ হয় না। কারণ বেসিক ফুটবলটা প্রায় একই রকম।
কাগজে-কলমে দুর্দান্ত হলেও জার্মান দলটার সমস্যা বলতে হবে, গোলমুখে ভালো সুযোগ যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি করতে না পারা। জার্মান দলটার মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে বল পায়ে রেখে খেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হয়ে যাচ্ছে গোলের সুযোগ তৈরি করাটা। হয়তো এই জায়গাতেই তারা মেসুত ওজিলের অভাবটা টের পাচ্ছে।
ডেভিড ভিয়া কিংবা ফার্নান্দো তোরেসের বিদায়ের পর স্পেন যেমন কার্যকরী একজন স্ট্রাইকারের অভাব ভালোভাবেই অনুভব করছে। জাভি যুগের টিকিটাকা থেকে সরে এসে স্পেন নতুন কোনো স্বতন্ত্র ধারা এখনো দেখাতে পারেনি।
অন্যদিকে প্রথাগত রক্ষণশীল কিংবা টোটাল ফুটবল ঘরানা দর্শকদের জন্যও খুশির খবর হলো, ইতালি এবং হল্যান্ড দুই দলই এবার মাঠে থাকছে। কুলীন দুই দল বেশ কিছুদিন ধরেই বাছাই পর্বগুলোতে লেজে-গোবরে হয়ে যাচ্ছিল!
ইতালির কোচ রবার্তো মানচিনিকে কোনভাবেই ফুটবল রোমান্টিক বলা যায় না, বরং প্রথাগত ইতালীয় রক্ষণশীল ফুটবলই তাঁর কাছ থেকে বারবার দেখা গিয়েছে। নিকট অতীতে ইতালিতে টট্টি, দেল পিয়েরো বা পিপো ইনজাগির মতো সৃজনশীল স্ট্রাইকার দেখা গেলেও আচমকা প্রতি-আক্রমণে উঠে খেলার গতি বদলে দেবার মতো স্ট্রাইকার দেখা যায়নি। প্রথাগত ইতালিয়ান ধরনের কারণেই হয়তো এটি সম্ভব ছিল না। কিন্তু স্পেন, জার্মানির মতো ইতালিয়ান ফুটবলেও পরিবর্তনের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ইতালির স্কোয়াডে এখন বেরার্দি, ইন্সিনিয়ে, কিয়েসা বা বার্নাদেস্কির মতো প্রতিভা দেখা যাচ্ছে যারা সত্যিকার অর্থেই আনন্দদায়ী ফুটবল উপহার দিচ্ছেন।
আনন্দদায়ী ফুটবলার উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে হল্যান্ডও কখনো পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু ইউরো ২০১৬ আর বিশ্বকাপ ২০১৮ বাছাইপর্বে বাদ পরা ডাচ সমর্থকরা এবার নিশ্চিতভাবেই তাকিয়ে থাকবে ফ্র্যাঙ্কি ডি ইয়ং আর মেম্ফিস ডিপাইয়ের দিকে। হল্যান্ডের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে, আরিয়েন রোবেনের মানের একজন চতুর স্ট্রাইকারের অভাব। তাছাড়া একজন ওভারল্যাপিং ফুলব্যাক না থাকাও দলটার সীমাবদ্ধতা।
পর্তুগালকে বেশ ব্যালান্সড এবং গোছানো একটা দল বলতে হবে। আন্দ্রে সিলভা, বার্নার্ডো সিলভা, জোয়াও ফেলিক্সরা নিজেদের মধ্যে জায়গা বা ভূমিকা পরিবর্তন করে সাফল্য পাচ্ছে। জোটা বা গেদেসরা প্রয়োজনের মুহুর্তে অবদান রাখতে পারছে। আর কেকের ওপর চেরি হয়ে থাকছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ফিনিশিং। কাগজে-কলমে পর্তুগালের এই দলটাকে ইউরো ২০১৬ জয়ী দলের চেয়েও এগিয়ে রাখতে হবে।
ফিল ফোডেন, জ্যাক গ্রিলিশ এবং ম্যাসন মাউন্টদের নিয়ে ইংলিশরাও এবার বেশ আশাবাদী। যদিও গ্যারেথ সাউথগেট ইংলিশদের টিপিক্যাল ৪-৪-২ ফরমেশনে এবার দলকে খেলাবেন না বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। দলের কৌশলের অন্যতম অংশ হতে পারে হ্যারি কেনকে নাম্বার নাইন এবং নাম্বার টেন উভয় পজিশনে অদল বদল করে খেলানো।
ফরাসি ফুটবলটা সবসময় বৈচিত্র্যময় ছিল। তারা কখনো ব্যক্তিগত ঝলক আবার কখনো দলীয় শৃঙ্খলার অতিরিক্ত কড়াকড়ির কারণে শিরোনাম হতো। কোচ দিদিয়ের দেশম নিজে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে সফল ছিলেন বলে তাঁর দলে হোল্ডিং মিডফিল্ডারের ভূমিকাটায় খুব গুরুত্ব দেন। তবে পজিশন অনুযায়ী দেখতে গেলে এত এত সেরা বিকল্প হয়তো ইউরোর আর কোনো দলের কোচের হাতে নেই। ফ্রান্স যদি এবারের ইউরো জিততে না পারে, তাহলে মূল কারণটা হবে অমিত প্রতিভাধারী এক দল খেলোয়াড়কে এক সুতোয় গাঁথতে না পারা।
এত সব এলিটদের বাইরে ডার্ক হর্সরাও চুপে চুপে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। ২০১৮ বিশ্বকাপের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়ার গ্রুপটা মোটামুটি ঝামেলাহীন মনে হচ্ছে। তারা জানে, তুলনামূলক কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সরাসরি আক্রমণাত্নক খেলে সুবিধা করতে পারবে না। তাই এমন ম্যাচগুলোতে তারা ধৈর্য ধরে প্রতিপক্ষের ভুলের অপেক্ষায় বসে থাকে। ২০১৮ বিশ্বকাপের নক আউট পর্বের ম্যাচগুলোতে তারা এই কৌশলেই সফল ছিল। মজার ব্যাপার হলো, যে কৌশলের কারণে স্পেনকে গোল-বন্ধ্যা বলে অপবাদ দেয়া হচ্ছিল. সেই একই কৌশলে খেলে ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌছে গিয়েছিল।
উয়েফা ইউরোর আরেকটা আকর্ষণীয় দিক হলো. এই টুর্নামেন্টের রোল অব অনার। বিশ্বকাপ ফুটবল দেখুন: ২১টা বিশ্বকাপের ১৩টাই জিতেছে মাত্র তিন দেশ মিলে (ব্রাজিল, জার্মানি, ইতালি)। সব মিলে দুই শতাধিক দেশ থেকে বিশ্বকাপ জয়ী দেশের সংখ্যা মাত্র ৮।
অন্যদিকে ইউরোর মোট ১৫ আসরেই বিজয়ী দেশ ১০টি। সেই বিজয়ীদের তালিকাটাও দেখুন না! প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর সাথে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ডেনমার্ক বা গ্রিসের মতো দেশ! ডেনমার্ক ও রাশিয়া একদিকে যেমন ইউরো বিজয়ীর তালিকায় আছে, তেমনি ইউরোর মূলপর্বে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ হারার রেকর্ডও এই দুই দেশের (১৪টি করে)। কী অদ্ভুত বৈপরীত্ব!
পর্তুগালের কথাও বাদ দেবেন কীভাবে? পরিবর্তিত নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপ পর্বের তৃতীয় সেরা দলের নক আউটে ওঠার সু্যোগ থাকার কারণেই না গতবার পর্তুগালের কপাল খুলল! সেই পর্তুগাল, যারা গ্রুপ পর্বে জয়হীন থাকার পর দ্বিতীয় রাউন্ড এবং কোয়ার্টার ফাইনালও জিতেছিল টাইব্রেকারে গিয়ে, সেই দল কিনা ফাইনালে হারিয়ে দিল টুর্নামেন্টে তখনো পর্যন্ত অপরাজিত ফ্রান্সকে, তা-ও আবার ফরাসি দূর্গে!
এর সাথে যোগ করে নিন এই তথ্যটা: শেষ ৮টি আসরে ভিন্ন ৭টি দল জিতেছে মহাদেশীয় এই শিরোপা।
সব মিলে কী দাঁড়াল? আসলেই কি ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে এবারের বিজয়ীর নাম?
* 'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে। ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ আজহারুল ইসলাম।