তবু, জিদান নাকি কোচ হিসেবে অদক্ষ!
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
৩ জুন ২০২১
রিয়াল মাদ্রিদে দু`দফায় ১১টি ট্রফি, যার তিনটি আবার চ্যাম্পিয়নস লিগ। তা-ও আবার টানা তিন মৌসুমে। তবুও কোচ জিনেদিন জিদানকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একগাদা তথ্য-উপাত্ত সামনে টেনে এনে কলকাতার নামী ফুটবল লেখক কাশীনাথ ভট্টাচার্য প্রমাণ করে দিলেন, অভিযোগগুলো ব্রিটিশ-মিডিয়ার অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়।
ফরাসি কাগজ প্রশ্ন তুলেছিল ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের দু'দিন পর, ‘আপনার সন্তানের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবেন তো জিনেদিন জিদান?’
সে দিনও বুঝিনি, আজও বুঝি না, কেন নিজের সন্তানের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবেন না জিদান, কী অপরাধে!
জিদান কি কোনও অপরাধ করেছিলেন সেই বিশ্বকাপ ফাইনালে? কোনও এক মার্কামারা মার্কো মাতেরাজ্জি প্রথমে অপমান করেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে। পরে তাঁর বোনের জার্সি খুলে নেওয়ার চরম অশ্লীল ইঙ্গিত এবং শেষে, সেই ফাইনালের সকালে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মায়ের সম্পর্কে মাতেরাজ্জীয় বর্ণবৈষম্যমূলক ‘টেরোরিস্ট হোর’, লক্ষ্য জিনেদিন ‘ইয়াজিদ’ জিদানের মুসলমান-সত্ত্বা, আলজেরীয় নাগরিকত্ব। তাঁর বুকে ঢুঁস না মারলে আর কী করতেন জিদান? আপনার মা-বউ-বোন সম্পর্কে কেউ যখন এমন অশ্লীল ইঙ্গিত ক্রমাগত করবে, ঘুষি মারবেন না, ঢুঁস মারবেন না?
বরঞ্চ, পাল্টা প্রশ্নটাও থাক। নিজের সন্তান বড় হওয়ার পর তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে মাতেরাজ্জি কি বলতে পারবেন, কীভাবে এসেছিল তাঁর বিশ্ব জয়ের ট্রফি? মাতেরাজ্জির সন্তানকে যদি কেউ তাঁর মায়ের সম্পর্কে ‘সন্ত্রাসবাদী বেশ্যা’ বলে, সেই সন্তান কি টুঁটি চেপে ধরবে না বক্তার? না ধরলে আর সন্তান কেন?
ফুটবল খেলছেন বলেই বিপক্ষের কারও অধিকার থাকবে আপনার প্রিয়তমা সম্পর্কে যা খুশি বলার এবং যখন-তখন জার্সি খুলে নেওয়ার–এই অধিকার কেউ কাউকে দেয়নি সভ্য সমাজে, দেয় না। মনে পড়ে যেতে পারে, সুনীল গাভাস্কার একবারই মেজাজ হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাঠ থেকে ওপেনিং-সঙ্গী চেতন চৌহানকে নিয়ে খেলা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তাঁকে ভুল আউট দেওয়া হয়েছিল বলে নয়, অস্ট্রেলিয়ায় সেটা তখন স্বাভাবিক, নাম খারাপ হয় শুধু শাকুর রানার! গাভাস্কার রেগে গিয়েছিলেন বোলার ডেনিস লিলির কটু মন্তব্যে, প্ররোচিত হয়েছিলেন একইভাবে, মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে। শাস্তি কখনও লিলি বা মাতেরাজ্জিরা পান না, খেলার যা সবচেয়ে খারাপ দিক। পদার্থবিদ্যায় আইজ্যাক নিউটনের তৃতীয় সূত্র যতই বলে থাকুক, প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে, খেলার জগৎ ‘প্রতিক্রিয়া’শীলদেরই দোষ দেখে, ধরে এবং শাস্তি দেয়!
ফুটবলার জিদানকে শেষ ম্যাচের পর যেমন সইতে হয়েছিল, কোচ জিদানের সঙ্গী প্রথম দিন থেকেই সেই অপমান, তাচ্ছিল্য, হেলাফেলা। দু'দফায় তাঁর চার বছরের প্রশিক্ষক জীবন বারবার শুনেছে, ‘ও কোনও কোচই নয়! ভাগ্য আর কিছু ভাল ফুটবলারের কারণে সাফল্য।’
ফুটবলার জিদানের জাদুকরি পায়ের ছোঁয়ায় ফ্রান্স বদলে যেত ‘লা মিজারেবল’ থেকে ‘লা ডিলাইটফুল’-এ। তাঁর কোচিং-এও হুবহু এক। ২০১৬-র জানুয়ারিতে মৌসুমের মাঝপথে তাঁকে রিয়াল মাদ্রিদের হেডমাস্টার করে দেওয়া হয়েছিল যখন, ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে সফল ক্লাব ধুঁকছে। রাফা বেনিতেজ নামক পণ্ডিত-কোচের আমলে সর্বোচ্চ লজ্জা উপহার পেয়েছে সবে, নিজেদের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ০-৪ হেরে বার্সেলোনার কাছে। মাঝদরিয়ায় নাবিকহীন জাহাজের মতো মাঝ মৌসুমে রিয়াল তখন। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ হাতের সামনে পেয়ে জিদানকেই দিয়েছিলেন দায়িত্ব, ‘কোনো রকমে সিজনটা পার করে দাও, দেখছি তারপর’ ভেবে। কোনো ক্লাবেরই প্রথম দলের কোচিং করানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তখন জিদানের।
আড়াই বছর পর নিজে সেই দায়িত্ব ছেড়েছিলেন জিদান। পকেটে চ্যাম্পিয়নস লিগের হ্যাটট্রিক, একবার লা লিগা এবং আরও গোটা ছয়েক ট্রফি--যার মধ্যে দুটি করে ইউরোপীয় সুপার কাপ এবং ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ। আড়াই বছরে দশ ট্রফি! আর যা অ্যালেক্স ফার্গুসন, হোসে মরিনিও এবং পেপ গার্দিওলারাও করে দেখাতে পারেননি এত বছরে–তিনবার ইউরোপ-সেরার ট্রফি, তা-ও পরপর তিন বছরে! মনে রাখলে ভালো, ২০১৪ সালে রিয়াল যখন ইউরোপে জিতেছিল, জিদান ছিলেন সহকারী কোচ। এরপরও শুনতে হয়, হয়েছে--কোচ হিসাবে জিদান নাকি কিছুই পারেন না!
গার্দিওলাকে যখন বার্সেলোনা তুলে এনেছিল প্রথম দলের কোচ হিসাবে, বার্সেলোনার দ্বিতীয় দল এবং অ্যাকাডেমিতে তত দিনে কাতালান কোচের পাঠ সম্পূর্ণ। আর, মৌসুমের মাঝপথেও নয়, একেবারে শুরুতেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গারদিওলাকে। নিজের মতো দল সাজাতে পেরেছিলেন, বহু যুদ্ধের ঘোড়ারা বয়স্ক বলে ছেঁটে ফেলেছিলেন। আর ছিলই লা মাসিয়ার আগমার্কা ছাপ। নিজে যেভাবে খেলেছিলেন, খেলিয়েছিলেন জোহান ক্রুইফের আদর্শ মাথায় রেখে, বার্সেলোনার প্রথম দলও অনেকটাই তেমন খেলত, গার্দিওলা সেটিকে আরও সুসংহত রূপ দিয়েছিলেন মাত্র।
জিদানের তেমন সুযোগ হয়নি। রিয়াল মাদ্রিদের কাস্তিয়া খেলতে তৃতীয় বিভাগে। সবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন, চলে আসতে হয়েছিল সেখান থেকেও মাঝপথে। দল বেছে নেওয়া, সাজানোর প্রাক-মৌসুম অনুশীলন ইত্যাদির কোনো জায়গা নেই। ক্রিসমাসের ছুটির পর ক্লাবে কোচ বদল এবং দায়িত্ব নিয়ে এসেই লা লিগার খেলা শুরু। কোনো নতুন পদ্ধতিতে দলকে খেলানো বা অভ্যস্ত করে তোলার ন্যূনতম সময়ও নেই। তবু, হারতে হারতে হয়রান রিয়াল বদলে গিয়েছিল ক্রমাগত জয়ে।
জিদানের টেকনিক্যাল সাফল্যে একবার নজর ফেরানো যাক। প্রথমে সার্জিও রামোস। রিয়ালের অধিনায়ক এবং স্টপার রামোস গোল করতেন মাঝেমাঝে। কোনো মৌসুমেই দু'অঙ্কে পৌঁছত না গোলসংখ্যা। মৌসুমে সর্বোচ্চ ছিল সাত গোল, সেটাও জিদান যখন কার্লো আনচেলত্তির সহকারী হয়ে এসেছিলেন, সেই ২০১৩-১৪ মৌসুমে। জিদান পুরো মৌসুম দায়িত্ব পেলেন ২০১৬-১৭তে। প্রথম মৌসুমেই ১০ গোল রামোসের। পরের মৌসুমে ততটা সফল নন, প্রধানত চোটের কারণে। তারপরের দুটি মৌসুমে যথাক্রমে ১১ এবং ১৩ গোল। আর এই ১৩ গোলের মৌসুমে সরাসরি জিদান আবার যুক্ত দলের সঙ্গে।
মারকুটে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার, জোরালো হেড অন্যতম অস্ত্র এবং রক্ষণের মাঝখানে খেলার কারণে ঠিক জায়গায় থাকার ব্যাপারগুলো রামোসকে আলাদা করে শেখানো দরকার ছিল না। জিদান তাঁকে নিয়মিত তুলে আনলেন বক্সে সেট পিসে ভাসানো বল আসার সম্ভাবনা দেখলেই। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যত দিন ছিলেন রিয়ালে, পেনাল্টি নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। ক্রিস্টিয়ানো চলে যাওয়ার পর রামোস হয়ে উঠলেন ভরসা। গোল তো বাড়বেই!
রোনালদোর সঙ্গে বসে পড়েছিলেন জিদান, প্রথম মৌসুমের শেষেই। আলোচনার মূল বিষয় ছিল, মৌসুমের প্রথমার্ধে রোনালদোর ম্যাচসংখ্যা কমানো, যাতে মৌসুমের শেষ দিকে, যাকে ইংরেজিতে ‘বিজনেস-এন্ড’ বলা হয়, যেন সুস্থ-সবল-তরতাজা থাকেন। বয়স হচ্ছিল, অস্বীকার করার উপায় ছিল না। মৌসুমের শুরু থেকে প্রতি ম্যাচে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে গেলে শেষে এসে জিভ বেরিয়ে যাবেই। প্রথম ছ’মাসে তত বেশি না খেললে গোল সংখ্যা কমবে, কিন্তু ট্রফি বেশি আসার সম্ভাবনা। চ্যাম্পিয়নস লিগ হ্যাটট্রিকের সেই সময়ে রোনালদোর নকআউটে গোলসংখ্যা দেখুন। প্রথম দিকে লা লিগাতে যত গোল, জানুয়ারির পর ক্রমশ বাড়তে বাড়তে শেষে সর্বোচ্চ গোলদাতার লড়াইতে। প্রথম থেকেই গোল বাড়ানোর খেলায় না যাওয়া মানে কাছে তখন ইগোর লড়াইয়ে লিওনেল মেসির কাছে পিছিয়ে পড়া। আগের অন্য কোনো কোচ তাই ঘাঁটাতেই চাননি। যত বেশি খেলবেন তত বেশি গোল, ভাবনায় সওয়ার তখন রোনালদো। আর ব্যক্তিগত সাফল্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত মেসিকে টপকে আরও বেশিবার ব্যালন ডি’অর জয়ের প্রক্রিয়া। জিদান বোঝাতে পেরেছিলেন, গোল বেশি করলে ট্রফি আসবে মৌসুমের দ্বিতীয়ার্ধে, আর ট্রফির সঙ্গেই বেশি সম্পর্ক বিশ্বসেরা ফুটবলারের ব্যক্তিগত ট্রফির। জিদানের আমলে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের হ্যাটট্রিকের নকআউট পর্বে রোনালদোর গোল ছিল যথাক্রমে ৮, ৫ ও ১০! বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে ২০১৭-র কোয়ার্টার ফাইনালে রিয়াল জিতেছিল ৬-৩ (২-১ এবং ৪-২), পাঁচটি গোল ছিল ক্রিস্টিয়ানোরই। তো, এই ভাবনা সেরা অস্ত্রের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁকে বিশ্বাস করাতে পারা কোন অংশে কম টেকনিক্যাল সাফল্য?
রামোসকে আজ ছেড়ে দিচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ, যাঁর ভরসায় সেই রাফায়েল ভারানেকে রিয়ালে আনার কারিগর ছিলেন জিদান। পেরেজের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক সুবিদিত। কিন্তু পেরেজ এবং রিয়াল মাদ্রিদের বরাবরের ভাবনা, ‘গ্যালাকটিকো’ অর্থাৎ তারকার পেছনে ছোটা। ভারানেকে রিয়াল সই করায় যখন, একেবারেই উঠতি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পেছনে পড়েছিল। জিদানের অভয়বাণীতে পেরেজ নিজের তৈরি করা প্রথার বাইরে গিয়ে একটু বেশি পয়সা খরচ করেছিলেন প্রতিভার পেছনে। তাঁকে এই কাজ করতে সাহস জুগিয়েছিলেন সেই জিদান। সেই ভারানে পরে তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী দলের পাশাপাশি বিশ্বজয়ী দলের সদস্যও। টেকনিক্যাল দূরদৃষ্টিহীন জিদান?
ছ’বছর পর ফ্রান্সের জাতীয় দলে ফিরেছেন করিম বেনজেমা। এই ছ’বছরের চারটি বছর রিয়ালে তাঁর কোচ হিসাবে থেকেছেন জিদান। মাঠের বাইরের কেলেঙ্কারি এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণেই দিদিয়ের দেশম জাতীয় দলে ফেরাতে নারাজ ছিলেন বেনজেমাকে। যে কোনো ফুটবলার যখন জেনে ফেলেন, দেশ তাঁকে ডাকবে না, পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়তে বাধ্য। বেনজেমা কিন্তু ক্রমশ ভালো থেকে আরও ভালো হয়েছেন, বিশেষ করে রোনালদো চলে যাওয়ার পর, রোনালদোর ছায়া থেকে বেরিয়ে আরও তীক্ষ্ণ। কৃতিত্ব দেবেন না জিদানকে?
২০১৮ বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলার লুকা মডরিচ। বিশ্ব পেয়েছিল নতুন এক এলএমটেন-কে। রিয়ালের মাঝমাঠে টনি ক্রুস-কাসেমিরোর সঙ্গে মডরিচের ত্রিভুজ–অস্বীকার করতে পারবেন?
সমস্যা হলো, এই সবই চোখের সামনে থাকলেও জিদানকে কৃতিত্ব দেওয়ার প্রশ্নটা একেবারেই বাজে কাগজের ঝুড়িতে চলে গিয়েছিল ইংরেজ-সংবাদমাধ্যমের কাছে। কারণ ‘ব্রিটিশ’ গ্যারেথ বেলের সঙ্গে জিদানের খারাপ সম্পর্ক। ওয়েলসের নাগরিক বেল রিয়ালে গিয়েছিলেন রেকর্ড অর্থে। যদিও রেকর্ডটা বেসরকারি, কারণ, রোনালদোকে সরাসরি চটিয়ে দেওয়ার ভুল করা রিয়াল-কর্তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বেল আসার পর বেনজেমা-বেল-রোনালদো, রিয়ালের ‘বিবিসি’ আক্রমণভাগ নিয়েও প্রচুর চর্চা। বিরাট শরীর, প্রচণ্ড গতি আর কোনো কোনো সময় দুর্দান্ত গোল করে ফেলার ক্ষমতা, তারকাসুলভ চেহারা ও ভাবমূর্তি, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের ছোট সংস্করণ বেল কখনো জিদানের পছন্দের ছিলেন না, প্রধানত বলের ওপর দখলদারির অভাবের কারণে এবং শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত ব্যাপারেও। তবুও 'বিবিসি'-তে ভরসা রেখেছিলেন। রোনালদো চলে যাওয়ার পর জিদান যখন গত বছর ফিরেছিলেন রিয়ালে, বুঝতে পেরেছিলেন, আর সম্ভব নয়। নতুনদের দিকে তাকানো এবং ভিনিসিয়াস জুনিয়রদের তুলে আনার চেষ্টায় ব্রতী।
ইংরেজ আর ফরাসিদের যুদ্ধ চিরকালীন। ঠিক যে কারণে মিশেল প্লাতিনিকেও পছন্দ নয় ইংরেজ বিশেষজ্ঞদের। জিদান এমনিতেই ছিলেন না তাঁদের পছন্দের তালিকায়, বেল নিয়ে ঝামেলা তাঁদের হাত খুলে দিল কোচ জিদানের অসারতা বোঝাতে। আমাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফুটবলের যোগাযোগ পুরোপুরিই ইংরেজিনির্ভর হওয়ার সুবাদে আমরাও সেটিতে প্রভাবিত। ইংরেজি কাগজগুলোতে যা যা বেরোয়, তুলে ধরতে চাই নিজেদের প্রতিবেদনে । ফলে, আমাদের কাছেও জিদান হয়ে দাঁড়ালেন যেমন-তেমন কোচ!
দুটি পর্বে চার বছর কোচ ছিলেন। ১১ ট্রফি! রিয়ালের কোচ হিসাবে মিগেল মুনোজের সারা জীবনে ১৪ ট্রফির পর দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ। চার বছরে গার্দিওলাও বার্সেলোনাকে দিয়েছিলেন ১৪ ট্রফি। কিন্তু তাঁর চার বছর টানা এবং মেসি জীবনের সেরা ছন্দে, সঙ্গে ‘জাভিয়েস্তা’। রিয়াল অবশ্যই দুরন্ত দল এবং প্রথম আড়াই বছরে রোনালদো ছিলেন বলেই টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়। গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে আলফ্রেডো ডি স্টেফানো প্রজন্মের পর যা ইউরোপে আর ভাবা যায়নি। হিসাবমতো ২০১৪ থেকে ধরলে ২০১৮-র মধ্যে পাঁচে চারবার জিতেছিল, ২০১৫ সালে সেমিফাইনালে হার জুভেন্টাসের কাছে, অর্থাৎ, ফাইনালের ঠিক এক ধাপ আগে থেমে যাওয়া। আজকের উন্নততর চ্যাম্পিয়নস লিগে পরপর পাঁচবার সেমিফাইনাল এবং চারবার ইউরোপজয়–কোনো দল করে দেখালে সেই কোচ সম্পর্কে কী কী প্রশস্তি গাইতে পারত প্রচারমাধ্যম, কল্পনা করা কঠিন নয়। জিদান কিন্তু এই চার জয়ের সাড়ে তিনটিতেই কাণ্ডারি!
নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে স্পেনে টানা ৪০ ম্যাচ অপরাজিত থেকে বার্সেলোনার ৩৯ ম্যাচের রেকর্ডও ভেঙেছিল জিদানের রিয়াল। নকআউটে সাত ম্যাচে অপরাজিত থাকা যেমন অন্য ব্যাপার, লিগে টানা ৪০ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রহস্য আবার সম্পূর্ণ আলাদা। রোটেশন ছিল, বিশ্রাম ছিল, তারপরও এই কৃতিত্ব বলে দেয়, কোচ হিসাবে জিদান ঠিক তাই-ই করে এসেছেন, যা চিন্তাভাবনায় দুর্দান্ত কোনো কোচের করা উচিত। চার মৌসুমে ১১ এল ক্লাসিকোয় জিদান হেরেছেন মাত্র দুবার, জয় ছয়! তিনি কোচ হয়ে আসার আগে যে বার্সেলোনা ক্যাম্প ন্যুতে অপরাজেয় প্রায়, জিদানকে একবারও ক্যাম্প ন্যু হারাতে পারেনি! বলি কী, আর একজন কোচের এমন রেকর্ড একটু খুঁজে দেখান না, প্লিজ!
জুনিয়রদের তুলে আনার এই শেষ মৌসুমে রিয়ালে কোনও ট্রফি নেই। ইউরোপে সেমিফাইনালে চেলসির কাছে হার, লা লিগায় শেষ দিন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ পয়েন্ট হারালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ ছিল, হয়নি। অর্থাৎ, আরও দুটি ট্রফির খুব কাছে এসে ফিরে-যাওয়া, সেই বিজনেস-এন্ডে দুর্দান্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্কোয়াডে-থাকা সবাইকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিয়ে তরতাজা রাখার ঘটনা আবারও। স্কোয়াড রোটেশন আর ম্যাচের শেষ দিকে জয় তুলে আনা ছিল ফার্গুসনের গ্রেটত্বের মাপকাঠি। জিদান বহু বছর থাকেননি দায়িত্বে। আবারও নিজেই সরে এলেন বছর দেড়েক পর। কিন্তু তাঁর স্কোয়াড রোটেশন, ম্যাচ এবং সিজনের বিজনেস এন্ড-এ এসে ফুটবলার বদলে বাজিমাতের ঘটনাও তো অহরহ।
তাই কোচ জিদান সম্পর্কে মূল্যায়নে ইংরেজ মিডিয়া যতই নাক-মুখ কুঁচকে থাকুক, আমাদের সে দায় থাকার কথা নয়, নেইও। বরঞ্চ, রিয়ালের এই গত বছর সাতেকের সাফল্য উদযাপন করতে গিয়ে আরও বেশি কৃতিত্বই প্রাপ্য জিদানের, তাতে কার্পণ্যও অনুচিত।
কার্লো আনচেলোত্তি এসেছেন, জিদানের ছেড়ে-যাওয়া দলের দায়িত্বে। আসলে, আনচেলোত্তির সঙ্গেই রিয়ালে প্রথম দলে সহকারী কোচ হিসাবে কাজ শুরু জিদানের। ফুটবলার এবং কোচ হিসাবে ইউরোপ-জয়ের কৃতিত্ব আছে আনচেলত্তিরও। এসি মিলানে তাঁদের সেই অসামান্য ফুটবল খেলা এবং পরে এসি মিলানকেই ইউরোপ-সেরা করেছিলেন আনচেলত্তি। কোচ হিসাবে তাঁর হাতে পড়েই আন্দ্রে পিরলো নামের এক ফুটবলারের ‘রেজিস্তা’ ভূমিকায় বিশ্বসেরা হয়ে-ওঠা, কাকার দুরন্ত উত্থানও তাঁর এসি মিলানেই।
তাই রিয়াল দক্ষ-হাতেই থাকল। হয়ত দক্ষতর হাতেই। কিন্তু, ইংরেজ-প্রভাবে অদক্ষ বলার ভুলটা আর করবেন না কোচ জিদান প্রসঙ্গে!