হায় রোনালদো!
ইউরো ২০১২ কড়চা--৪
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোনালদো দেখলেন, তাঁর স্বপ্ন কেমন দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেল! টাইব্রেকার কাউকে হিরো বানায়, কাউকে বা ভিলেন। এমন নির্বাক দর্শকও কি বানায় কাউকে?
রোনালদো যেন সেই সম্রাট, যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই যিনি শুনলেন, একটু আগে যুদ্ধই শেষ হয়ে গেছে!
প্রথম প্রকাশ: ২৯ জুন, ২০১২। প্রথম আলো।
জীবনের বিচিত্র সব অনুভূতি ঠেসেঠুসে ওই কয়েকটা মিনিটে ঢোকানো। আনন্দ-বেদনা, উদ্বেগ-স্বস্তি, উচ্ছ্বাস-হতাশা...বিপরীতমুখী কত সব আবেগের উথালপাথাল ওইটুকু সময়ে। শেষ পর্যন্ত প্রতীকী অর্থে জীবন-মরণও বোধ হয় আছে। ওটুকুর মধ্যেই কেউ মরতে মরতে বেঁচে ওঠে, কেউ বা উল্টো। শেষ পর্যন্ত কেউ চূড়ান্তভাবেই মরে, কেউ বাঁচে। পেনাল্টি শ্যুট-আউট যেন জীবনের মিনিয়েচার!
পরশু রাতে পর্তুগাল মরল, সৌভাগ্যের ভেলার আশ্রয় পেয়ে বাঁচল স্পেন। সৌভাগ্যের ভেলাই তো! লটারি-ভাগ্য...এই শব্দগুলো অনেক দিনই পেনাল্টি শ্যুট-আউটের প্রতিশব্দ। জীবনের মতো খেলাতেও ভাগ্যের ছোঁয়া একটু লাগে। কিন্তু ফুটবলের টাইব্রেকারের মতো আর কিছুতেই এতটা নয়। ভাগ্য এখানে এমনই নিয়ন্তা যে, টানা কয়েকটি পেনাল্টি শ্যুট-আউটে অংশ নিতে হলে ফুটবলাররা সব নির্ঘাত চরম নিয়তিবাদী হয়ে পড়বে। হ্যাঁ, স্কিলের একটা ব্যাপার এখানেও আছে। স্কিলের চেয়ে বেশি বোধ হয় মানসিক শক্তির পরীক্ষা। কিন্তু সবকিছুর পর ওই ভাগ্য।
পরশুর ম্যাচটাই দেখুন। যে দুটি পেনাল্টিতে ইউরো ফাইনালিস্টের মতো এত বড় একটা প্রশ্নের মীমাংসা হলো, দুটিই তো গোলপোস্টে লেগেছিল। পার্থক্য হলো, ব্রুনো আলভেজের শটটা বারের ভেতরের দিকে লেগে ফিরে এল। আর ফ্যাব্রিগাসেরটা পোস্টের ভেতরে লেগে ঢুকে গেল গোলে। ১-২ সেন্টিমিটারের এদিক-ওদিকই তো! ভাবতেই কেমন লাগে—দুটি দল, দুটি দেশ এবং হয়তো এর বাইরে হাজারো সমর্থককেও পুরো বিপরীত দুই অনুভূতিতে ডুবিয়ে দেওয়ার মূলে হয়তো ১ সেন্টিমিটার!
শেষ পর্যন্ত আলভেস-ফ্যাব্রিগাসেই এসে শেষ হবে এই ম্যাচের সব কথা। ম্যাচের দুই ঘণ্টা, টাইব্রেকারের আগের সবকিছুই যে মূল্যহীন। শুরুতে আলোনসো-মুটিনহো মিস করেও সেভাবে ভিলেন নন। প্রথম দুটি শট ঠেকিয়ে দিয়েও হিরো নন প্যাত্রিসিও-ক্যাসিয়াস। ওসব তো সব কাটাকাটিই হয়ে গেছে। হিরো বললে ফ্যাব্রিগাস, কারণ তাঁর ওপর ছিল ‘আমি পারলেই ফাইনাল’-এর বাড়তি চাপ। ভিলেন বললে ব্রুনো আলভেস, যাঁর মিসটাই হয়ে গেল নির্ধারক।
ফুটবলের নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপও এই টাইব্রেকার। কী অবলীলায় একজন এখানে ‘ভিলেন’ হয়ে যায়! বাকি জীবনে সমর্থকদের কাছে এটাই হয়ে যায় তাঁর পরিচয়। ব্রুনো আলভেসই যেমন বাকি ক্যারিয়ারে যা-ই করুন না কেন, নামটা শুনলেই সবার প্রথমে মনে হবে এই রাত। পর্তুগিজরা হয়তো বাকি জীবনই বলে যাবে, ওর জন্যই আমরা ফাইনালে উঠতে পারিনি! টাইব্রেকার এমনই। ফ্যাব্রিগাসের মতো নির্ধারক পেনাল্টি হলে ভিন্ন কথা। নইলে এখানে গোল করার পর যে প্রতিক্রিয়া, সেটিকে ভুলেও আনন্দ ভাববেন না। এটা আসলে স্বস্তি—‘যাক বাবা, বাঁচা গেল!’
ব্যতিক্রমী একটা দৃশ্যও দেখা গেল এ দিন। পেনাল্টি নিতে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর ব্রুনো আলভেসকে ফিরিয়ে এনে পাঠানো হলো নানিকে। পরের শটটাই নিলেন আলভেস এবং মিস করলেন। সংস্কারে বিশ্বাসীরা নির্ঘাত আগেরবার ওই ‘বাধা’ পড়ার ব্যাপারটির ভূমিকা দেখবেন এতে।
পরশুর টাইব্রেকারের সবচেয়ে বড় নাটকীয়তার মঞ্চ গোলপোস্ট থেকে অনেক দূরে। যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, তাঁর স্বপ্ন কেমন দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেল! টাইব্রেকার কাউকে হিরো বানায়, কাউকে বা ভিলেন। এমন নির্বাক দর্শকও কি বানায় কাউকে? পরশু ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তো নির্বাক দর্শকই। মাঠের সবচেয়ে বড় তারকা তিনি। পেনাল্টি নেওয়ারও ওস্তাদ। অথচ তিনি কিনা পেনাল্টি নেওয়ারই সুযোগ পেলেন না! পর্তুগালের শেষ শটটা নেওয়ার কথা ছিল তাঁর। বেশির ভাগ সময় সেটিই তো হয় টাইব্রেকারের নির্ধারক। এ দিন তার আগেই সব শেষ।
ফ্যাব্রিগাস গোলটা করেই যখন পাগুলে দৌড় দিলেন, টিভি ক্যামেরা ক্লোজআপে ধরল রোনালদোকে। ওই মুখটা বোঝাতে কী উপমা দিই, কী উপমা দিই...রোনালদো যেন সেই সম্রাট, যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই যিনি শুনলেন, একটু আগে যুদ্ধই শেষ হয়ে গেছে!