নীল না হয়ে লাল!
ইউরো ২০১২ কড়চা--৬
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
ফাইনালটা মন খারাপ করে দিল কেন? অসাধারণ এক উচ্চতায় উঠে যেতে যেতে ম্যাচটার যে হঠাৎই অপঘাতে মৃত্যু! ৬১ মিনিটে থিয়াগো মোত্তার স্ট্রেচারে মাঠ ছাড়ার পর লাল কার্ড না দেখেও ইতালি ১০ জনের দল! ম্যাচের বাকি এক-তৃতীয়াংশ তো অসহায় ইতালিকে নিয়ে স্পেনের ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রথম প্রকাশ: ৩ জুলাই, ২০১২। প্রথম আলো।
অর্ণবের গানের একটা লাইন আছে না, ‘ফুলগুলো সব লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান?’ একটু কি ঘুরিয়ে বলব—ইউরোর রং নীল না হয়ে লাল হলো ক্যান? বলা যাচ্ছে না, কারণ ফাইনালের ওই অসহ্য সুন্দর স্প্যানিশ ফুটবল মনে এমনই মুগ্ধ আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছে যে অমন ‘কইতে কথা বাধে।’
ঘোর সমর্থক বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দলেরই তা নই। সাংবাদিক হিসেবে বড় একটা সুবিধাই হয় এতে। পক্ষপাতহীন মুক্ত মন নিয়ে খেলাটা উপভোগ করতে পারি। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হোক, এটা কে না চায়! আশপাশের সবাইকে বলে দিয়েছি সেই কবেই, পরে প্রথম আলোতেও লিখে দিয়েছি, ‘ইউরোর রং নীল’। পরশুর ফাইনালে মনের একটা অংশ যে ইতালির জয় কামনা করছিল না, এই দাবি করব না।
আবার একটু ভয়-ভয়ও করছিল! গত দুটি বিশ্বকাপে ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়ায় একটা সমস্যাও হয়েছে। ঝড়ে বকের মৃত্যু ও ফকিরের কেরামতি বিষয়ক প্রবাদটা ভুলে গিয়ে এই সাংবাদিককে ‘জ্যোতিষী’ হিসেবে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছেন অনেকে। এবারও মিলে গেলে হয়তো দেখা গেল, লোকজন লাইন ধরে হাত দেখাতে আসছে!
এই ‘ভয়ের’ চেয়েও মনে বেশি খচখচ করছিল একটা অস্বস্তি। ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপ নিয়ে ওই ভবিষ্যদ্বাণী মোটেই ফুটবলীয় বিচার বিশ্লেষণ থেকে নয়। কেন যেন অমন মনে হয়েছিল, লিখে দিয়েছি। ২০০৬ বিশ্বকাপের বিশেষ সংখ্যায় লেখার শিরোনামটা তো প্লেনে বসে দেওয়া। বিশ্বকাপ কাভার করতে জার্মানি যাচ্ছি। সহকর্মী অফিস থেকে ফোন করেছেন, ‘লেখার হেডিং তো দেন নাই, হেডিং কী হবে?’ হঠাত্ কী মনে হলো, বলে দিলাম—‘ব্রাজিল না জিতলে কে? ইতালি?’ ২০১০ বিশ্বকাপের বিশেষ সংখ্যায় লেখার শেষ লাইনটা—‘আহা, ফাইনালটা যদি স্পেন-হল্যান্ড হতো’—রাত চারটার দিকে উত্পন্ন। অফিসে বিশেষ সংখ্যার কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখছি। লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে, শেষ করা দরকার। ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বলতে পারেন ‘চাওয়া’—সেটি দিয়েই লেখাটা শেষ করে দিলাম।
অসাধারণ এক উচ্চতায় উঠে যেতে যেতে ম্যাচটার হঠাৎই অপঘাতে মৃত্যু! ৬১ মিনিটে থিয়াগো মোত্তার স্ট্রেচারে মাঠ ছাড়ার পর লাল কার্ড না দেখেও ইতালি ১০ জনের দল! ম্যাচের বাকি এক-তৃতীয়াংশ তো অসহায় ইতালিকে নিয়ে স্পেনের ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এবার সহকর্মীদের যখন বলেছি, ইতালিই চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে, এই ইউরোতে ইতালির কোনো খেলাই দেখিনি তখনো। দেখতে দেখতে ইতালি যখন ফাইনালে, একটু অস্বস্তিই লাগতে শুরু করল! সত্যিই যদি ইতালি চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়! শুধু কাকতালীয় দিয়ে তো এর ব্যাখ্যা করা যাবে না, এটি যে ‘কোকিলতালীয়’ হয়ে যাচ্ছে!
বলতে পারেন, এবার ভবিষ্যদ্বাণী মিলল না বলে তাই একটু হাঁফ ছেড়েই বাঁচলাম। হ্যাঁ, ফাইনালটা দেখে মন খারাপ হয়েছে। তবে সেটি ইতালি হেরেছে বলে নয়। মন খারাপ হয়েছে অমন অসাধারণ একটা ফাইনালের ‘অপমৃত্যু’ দেখে। প্রথম এক ঘণ্টা এই ফাইনালে যে খেলাটা হলো, তার তুলনা ফুটবল ইতিহাসে খুব বেশি নেই। ‘একেবারেই নেই’ লিখে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ সব ফাইনাল তো আর দেখিনি। বিশ্বকাপ ও ইউরো সরাসরি দেখার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে দেখুন তো, এমন আনন্দধারায় ভিজিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ফাইনাল পান কি না!
ফাইনাল মানেই প্রচণ্ড স্নায়ুচাপ। ফাইনাল মানেই ‘গোল না করতে পারলেও গোল খাব না’ নীতিকে প্রাতঃস্মরণীয় মেনে নিজেদের গুটিয়ে রাখা। সেখানে পরশুর ফাইনালে স্পেন-ইতালি দুই দলই যেন খেলে গেল মনের আনন্দে। মুক্ত আক্রমণাত্মক ফুটবলের এক অনুপম প্রদর্শনীতে রাঙিয়ে দিল কোটি দর্শকের মন।
স্পেনের কাছ থেকে এমনই প্রত্যাশিত। কিন্তু এই টুর্নামেন্টের আগের ম্যাচগুলোর কথা মনে রাখলে ফাইনালের স্পেনও তো প্রত্যাশা-ছাড়ানো। টিকি-টাকাই খেলল তারা, তবে আগের ম্যাচগুলোর মতো অর্থহীন-অকারণ পাসের বদলে তাদের পাসিং ফুটবলে মিশে থাকল ঝাঁজ। মাঠে অবিরাম ফুল ফুটল স্প্যানিশদের পায়ে পায়ে।
আর ইতালি! এই ইউরোর সবচেয়ে বড় বিস্ময় বললে ইতালি, এই ইউরোর সবচেয়ে বড় পাওয়াও ইতালি। ‘বিস্ময়’—অপ্রত্যাশিতভাবে ফাইনালে উঠেছে বলে নয়, বিস্ময় আজ্জুরিদের খেলায়। মাঝেমধ্যে হঠাত্ ব্যতিক্রম বাদ দিলে হেলেনিও হেরেরার ভূত সেই ষাটের দশক থেকেই ইতালিয়ানদের কাঁধে সওয়ার হয়ে আছে। এই ইতালি কাতানেচ্চিওর সেই শৃঙ্খল ছিঁড়ে এবার প্রাণোচ্ছল ফুটবলে মন ভরিয়ে দিয়েছে সবার। ইতালিয়ান ফুটবলের সঙ্গে এই ‘মন ভরিয়ে দেওয়া’ কথাটা খুব কমই ব্যবহূত হয়েছে আগে।
তার পরও ফাইনালটা মন খারাপ করে দিল কেন? অসাধারণ এক উচ্চতায় উঠে যেতে যেতে ম্যাচটার যে হঠাৎই অপঘাতে মৃত্যু! ৬১ মিনিটে থিয়াগো মোত্তার স্ট্রেচারে মাঠ ছাড়ার পর লাল কার্ড না দেখেও ইতালি ১০ জনের দল! ম্যাচের বাকি এক-তৃতীয়াংশ তো অসহায় ইতালিকে নিয়ে স্পেনের ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আক্ষেপটা এখানেই। পুরো ম্যাচটা এগারো বনাম এগারো খেলা হলে কে জানে, সর্বকালের সেরা ফাইনালও হয়ে যেতে পারত এটি!