ইউরোর রং নীল!
ইউরো ২০১২ ডায়েরি-১
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
শুরুতেই একটা রেকর্ড করে ফেলেছিল ২০১২ ইউরো। সেবারই প্রথম ইউরোপ-শ্রেষ্ঠত্বের নির্ধারক টুর্নামেন্টের যৌথ আয়োজক। সেই টুর্নামেন্টে ইতালি-ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনাল শেষে এই ভবিষ্যদ্বাণী। ইউরোর রং নীল। ফাইনালে ব্যতিক্রমী এক কারণে দশ জনের দল হয়ে গিয়ে স্পেনের কাছে ইতালি হেরে যাওয়ায় যা অল্পের জন্যই মেলেনি।
প্রথম প্রকাশ: ২৬ জুন, ২০১২। প্রথম আলো।
যাক, ফুটবল থেকে ন্যায়বিচার তা হলে উঠে যায়নি। গত পরশু শেষ রাতে ঘুম জড়ানো চোখে টেলিভিশনে পেনাল্টি শ্যুট-আউটের প্রস্তুতি দেখতে দেখতে শঙ্কাটা ভালোই জেগেছিল মনে। টাইব্রেকার দক্ষতা-মানসিক দৃঢ়তারও একটা পরীক্ষা বটে, তবে তার চেয়েও বেশি ভাগ্য। সেই লটারিতে ইতালি হেরে যেতেই পারত। গেলে বড় অবিচার হতো!
সেই ভয় ছিল। ১২০ মিনিটের খেলায় যা হয়েছে, তাতে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল, এই রাতটার রং নীল নয়। নীল যদি হয়ও, সেটি হবে ইতালির বেদনার রঙে নীল। একের পর এক গোলের সুযোগ আক্ষরিক অর্থেই ইতালিয়ানদের পায়ে এসে লুটাল। দুবার বল লাগল পোস্টে। ইংল্যান্ড নামেই ছিল প্রতিপক্ষ, ইতালির আসল প্রতিপক্ষ মনে হচ্ছিল ভাগ্যকে। ভাগ্যপরীক্ষার অন্য নাম টাইব্রেকারে তা হলে আর কীভাবে জেতে ইতালি?
শেষ পর্যন্ত জিতল। জাস্টিস ‘ডিলেইড’ হলেও ‘ডিনাইড’ হলো না। অন্ধ ইংল্যান্ড সমর্থক ছাড়া বাকি সবাই সমস্বরে বলবেন, এতে জয় হলো ফুটবলেরই। ইংল্যান্ড সমর্থকদেরই বা এত অবিবেচক ভাবছি কেন? জেরার্ড-রুনিরা যে খেলা খেলেছেন, তাতে এই দল তালেগোলে সেমিফাইনালে উঠে গেলে যে প্রায় কেলেঙ্কারি হতো, তাদেরই বা এটি না বোঝার কী আছে!
নিরপেক্ষ দর্শকেরা এই ম্যাচ থেকে আরেকটি বড় প্রাপ্তিও খুঁজে পাবেন। যাক বাবা, ইংল্যান্ডের খেলা দেখার অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া গেল! রক্ষা পাওয়া গেল আরেক দিক থেকেও। টাইব্রেকারে জিতে গেলে ইংলিশ মিডিয়ায় নিশ্চিত ইংল্যান্ডের ‘ট্যাকটিক্যাল ফুটবল’-এর জয়গান গাওয়া হতো। ডিফেন্সের প্রশংসায় মুখে ফেনা ছুটিয়ে বলা হতো, হুঁ, হুঁ, বাছাধন, ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখোনি...এটাই তো ছিল আমাদের স্ট্র্যাটেজি। ইতালি আক্রমণের পর আক্রমণ করবে। কিন্তু বল যাবে বাইরে, বড়জোর দু-একটি পোস্টে লাগবে।
কী ভাবছেন অনুমান করতে পারছি। এই ব্যাটা তো ভয়ানক ইংল্যান্ড-বিদ্বেষী! নয়তো নির্ঘাত কঠিন ইতালি সমর্থক। ভুল ভাবছেন। যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া সমর্থক-জীবন পেছনে ফেলে এসেছি অনেক বছর আগেই। যেকোনো টুর্নামেন্টের আগে ইংল্যান্ডের ‘হেন করেঙ্গা’ ‘তেন করেঙ্গা’র পর অশ্বডিম্ব প্রসব অনেক দিন ধরে দেখে আসছি বলেই ফুটে বেরোচ্ছে এমন শ্লেষ। এবারই দেখুন না, ইউক্রেনের বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচে রুনির নিতান্তই ভাগ্যপ্রসূত গোলে জিতে সেমিফাইনালে ওঠার পর ইংল্যান্ড দল ও মিডিয়ায় কী হুংকারই না শোনা গেল! ওই ম্যাচে জেতা উচিত ছিল ইউক্রেনের। অথচ বলা হতে লাগল, ইংল্যান্ড নাকি কী সব দলীয় সংহতি না চেতনার দারুণ প্রমাণ রেখেছে! এই দলটা চ্যাম্পিয়ন হলো বলে!
অথচ সেই কবে, ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ড কিছুই জেতেনি। না জেতারই কথা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বিশ্বের সবচেয়ে অর্থকরী লিগ, মানে সেরা বলেও দাবি অনেকের। কিন্তু প্রশ্ন যদি হয়, ইংল্যান্ড গত ১৫-২০ বছরে বিশ্বমানের একটা খেলোয়াড়ও কি তৈরি করতে পেরেছে? ডেভিড বেকহামের কথা বলবেন? বেকহাম সব মিলিয়ে দারুণ এক প্যাকেজ, কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবে ‘ভেরি গুড’ থেকে ‘গ্রেট’-এর পর্যায়ে উঠতে পারলেন কবে! এই দলের জেরার্ড বা রুনির নাম বলবেন? পরশুর ম্যাচটা দেখার পরও এই কথা বললে আর কিছু বলার নেই।
ব্যতিক্রম তো কখনো হতেই পারে। তবে ঘটনা হলো, যা দেখতে দর্শকেরা উন্মুখ হয়ে থাকে, সেই সৃষ্টিশীলতা-কল্পনাশক্তি কথাগুলোই ইংলিশ ফুটবলের সঙ্গে ঠিক যায় না। একটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ হচ্ছে। টাইব্রেকারে পিরলো সাহস-আত্মবিশ্বাস-উদ্ভাবনী চিন্তার মিশেলে যে পেনাল্টিটি নিলেন, ভাবতে পারেন, কোনো ইংলিশ ফুটবলার তা নিচ্ছেন!
তবে এটা মানতেই হবে, পরশু রাতের ইংল্যান্ড একটু চমকেই দিয়েছে। বাজে খেলতেই পারে, তাই বলে এত বাজে! চমকে দিয়েছে ইতালিও। আজ্জুরির মতো কাতানেচ্চিও কথাটাও বলতে গেলে যাদের নামের প্রতিশব্দ, সেই ইতালির পায়ে পায়ে এমন আক্রমণাত্মক ফুটবলের পসরা! হঠাৎ হঠাৎ এমন হয়। যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা নেতিবাচকতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে উঠে দাঁড়ায় ইতালিয়ানরা, খেলতে শুরু করে মুক্তপ্রাণের আনন্দে।
ইতালি এক প্রহেলিকাই বটে। টেকনিক্যালি দারুণ সব খেলোয়াড়, আক্রমণের সুরে গান গাওয়ার ক্ষমতাও ভালোই আছে। কিন্তু ট্যাকটিকসের চাপে ন্যুব্জ হয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে বেশির ভাগ সময়। গত পরশুর মতো কখনো কখনো আনন্দদায়ী ব্যতিক্রম হয়। যেমন হয়েছিল ১৯৮২ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্ব থেকে। ২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে।
তার পরও গত পরশু রাতের ইতালি যেন ইতালি নয়। ইংল্যান্ডের গোলে ৩৫টি শট, যার ২০টিই পোস্টে—এটা যেমন ইতালি নয়, গোলে এতগুলো শট নিয়েও গোল করতে না-পারাটা তো আরও মহা অ-ইতালীয়। কাউন্টার অ্যাটাকনির্ভর ফুটবলটা রক্তে মিশে আছে বলে ইতালিয়ান স্ট্রাইকাররা সাধারণত দুর্দান্ত লক্ষ্যভেদী হয়। পুরো ম্যাচে দুটি সুযোগ, অন্তত একটি গোল তো অবশ্যই!
লক্ষ্যভেদের এই দুর্বলতা যদি প্রানদেল্লির দুশ্চিন্তা হয়, এই রাতের ইতালি নির্ঘাত দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে দিয়েছে টুর্নামেন্টের বাকি তিন দলের মনে। ইউরোতে ইতালির সর্বশেষ শিরোপা সেই ১৯৬৮ সালে। ৪৪ বছরের ইউরো-খরা ঘোচাতে এবার বোধহয় নামছে নীল বৃষ্টি!