বিবর্ণ এক বছরে নেইমারকে নিয়ে প্রশ্ন
উৎপলশুভ্রডটকম
২৮ ডিসেম্বর ২০২১
নেইমারের উঁচু হয়ে ওঠা পেট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ইনজুরির কারণে কয়েক সপ্তাহ অবশ্য বিশ্রাম তার এখন। কিন্তু এটা কি জানেন, এক সময় যাঁকে ব্যালন ডি’অরের দাবিদার মনে করা হতো, তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে বছর এই ২০২১!
যায় দিন যায় ভালো, আসে খারাপ। প্রবাদটা নিয়ে নেইমারের কোনো মাথাব্যথা আছে কি নেই, তা কেবল তিনি নিজেই জানেন। ২০১৬ সালের কথাটা প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। স্প্যানিশ মিডিয়া তখন তর্কে-বিতর্কে ছিল এই নিয়ে যে, ওটাই নেইমারের সবচেয়ে বাজে বছর কি না। বার্সেলোনার এই ফরোয়ার্ড সেবার ৫৯ ম্যাচে ২৯ গোল করেছিলেন। ম্যাচ প্রতি গোল হিসাব করতে গিয়ে দেখা গেল, সেটা মাত্র ০.৪৯।
এই হিসাবে এর চেয়েও খারাপ সময় নেইমারের ক্যারিয়ারে এর আগেই এসেছিল। তবে সেটা ২০০৯ সাল, পেশাদার ফুটবলে নেইমারের অভিষেকের বছর। যে কারণে একটু ছাড় হয়তো পেতেই পারেন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার। কিন্তু এত বছর পর এসে এই ২০২১ সালে তাঁর যে পারফরম্যান্স, এর কী ব্যাখ্যা? পিএসজিতে বিবর্ণ এক মৌসুম কাটানোর পর নেইমারকে নিয়ে তাই বড় প্রশ্নই উঠে গেছে।
বাঁ পায়ের লিগামেন্ট ইনজুরির কারণে এই মৌসুমে আর খেলায় ফেরার সুযোগ নেই। যার মানে এই ২০২১ সালে নেইমারের পারফরম্যান্স ৪৬ ম্যাচে মাত্র ১৭ গোলেই বাঁধা পড়ে থাকবে। ম্যাচপ্রতি গোলের হিসাবটা যদি করেন, তাহলে দেখবেন, সেটি মাত্র ০.৩৭।
আরেকটা দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। সেটা খেলার দ্বিতীয়ার্ধ। এই বছর যে ১৭ বার নেইমার জালে বল জড়িয়েছেন, তার মাত্র ৫টি দ্বিতীয়ার্ধে। এটা কি তাহলে নেইমারের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্নটাই আরও জোরালো করে তোলে না? ছুটি কাটিয়ে আবার খেলায় ফেরার পর নেইমারের ফিটনেস নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সেটা নেইমারের ভালো লাগেনি। সমালোচকদের জবাব দিতে নেইমার মাঠে জার্সি তুলে নিজের পেটও দেখিয়ে দিয়েছেন। ব্রাজিলের একটা ম্যাচের পর তো দুঃখ করে এমনও বলেছেন, সম্মান পেতে হলে জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁকে আর কী করতে হবে, সেটা তাঁর জানা নেই। তিনি হয়তো উপলব্ধি করতে পারেননি যে, প্রশ্নটা আসলে তার উঁচু হয়ে ওঠা পেটের সাইজ নিয়ে নয়, মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে।
ব্রাজিলের সবচেয়ে নামী সংবাদ মাধ্যম ও'গ্লোবোর কলামিস্ট কার্লোস মানসুর যে কারণে বলছেন, 'নেইমার এই বছরের মাঝপথ থেকে শুধু দুশ্চিন্তাই বাড়িয়েছেন। কোপা আমেরিকার শেষে ছুটি কাটিয়ে আসার পর আমরা দেখেছি, তিনি আদর্শ শারীরিক অবস্থা থেকে কতটা দূরে চলে গেছেন। তাঁর টেকনিক আর স্কিল যতই অসাধারণ হোক, এটা খেলায় প্রভাব ফেলেছে। নেইমার প্রতিপক্ষকে আতঙ্কের চেয়ে নির্ভার রেখেছেন বেশি। এটা গুরুতর ব্যাপার আর দুর্ভাবনাটা ওখান থেকেই শুরু।'
যদি এই বছরের অ্যাসিস্টের (১৭) হিসেব নিয়ে বসা হয়, তাহলে দেখা যাবে, পিএসজি ও জাতীয় দলের ৩৪ গোলে নেইমারের প্রত্যক্ষ অবদান আছে। এটা ২০২০ সালের (২২ গোল ও ১০ অ্যাসিস্ট) চেয়ে বেশি। ২০১৯ সালে যেটা ছিল ২৮ (১৭ গোল ও ১১ অ্যাসিস্ট। কিন্তু এই বছরগুলোতে ভূমিকা রেখেছেন কম। ম্যাচ ছিল যথাক্রমে ২৯ ও ২৬টি। এই যে হারিয়ে ফেলা নেইমারের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, তা বিরাট বড় প্রশ্ন হয়ে উঠে এসেছে ফরাসি সংবাদমাধ্যমে। এই বছরের কথাই ধরুন। পিএসজির ম্যাচের পর ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী ফ্রান্স ফুটবল ও লেকিপ সবচেয়ে বাজে নম্বর দিয়েছে নেইমারকে। লেকিপে গত অক্টোবরে প্রকাশিত একটা প্রতিবেদনে প্যারিসের ক্লাবটিতে নেইমারের প্রথম বছরের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের তুলনা করা হয়েছে। যাতে তোলা হয়েছে একটা প্রশ্নও: ‘নেইমারের সেরাটা অতীত হয়ে গিয়ে থাকলে কী হতে পারে?’
খেলায় পারফরম্যান্সই মূল্যায়নের একমাত্র বিষয় নয়। চুক্তির সময়সীমা আর বয়সও এখানে বিবেচনায় আসে। এখানে প্রথম যে পয়েন্ট, সেটা নেইমারের জন্য সমস্যা না। গত মে মাসে পিএসজির সঙ্গে নেইমারের চুক্তি ২০২৫ পর্যন্ত নবায়ন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হলো দ্বিতীয় ব্যাপারটা। ফেব্রুয়ারিতে নেইমারের বয়স হবে ৩০। আর ৩০ হচ্ছে সেই সীমান্তরেখা, যেটি পেরোনোর পর ফুটবলারদের বাজার-মূল্য বড় একটা ধাক্কা খায়।
যে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিততে এত টাকা ছড়িয়ে তারকার মেলা সাজিয়েছে পিএসজি, সেই চ্যাম্পিয়নস লিগের বড় পরীক্ষা সামনে। শেষ ষোলোতে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে পিএসজি রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হবে। নেইমারের জন্য এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি যেমন নিজেকে ফিরে পাওয়ার বড় এক পরীক্ষা, এর চেয়েও বড় পরীক্ষাও তো আসছে সামনে। ২০২২ বিশ্বকাপ...ফুটবলার হিসেবে পূর্ণতা পেতে এই দুটি ট্রফি নিশ্চয়ই হাতে নিতে চান নেইমার।
ও'গ্লোবোর যে কলামিস্টের কথা লেখা হয়েছে আগে, তার একটা কথা দিয়েই শেষ করা যাক। 'এসব কিছু যদি নেইমারের মাথায় থাকে, তাহলে এখনো নিজেকে তৈরি করে কাপ জেতার মতো বয়স তাঁর আছে।’
এরপরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেছেন মানসুর। মন, মনই সবকিছুর নির্ধারক। অর্থটা পরিষ্কার। নেইমার কী জিততে চান আর তা জিততে কী করতে হবে, নিজের মনকে আগে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হবে তাঁকে। মাঠের লড়াই তো পরে, আসল লড়াই এটাই।