ইতালি এবং ফুটবল ইতিহাসের যত `অজেয়` দল
উৎপলশুভ্রডটকম
৭ অক্টোবর ২০২১
৩৭ ম্যাচ পর স্পেনের কাছে ২-১ গোলে হেরে থামল ইতালির অপরাজেয়-যাত্রা। টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ অপরাজিত থাকার এই বিশ্ব রেকর্ড গড়তে কোন কোন দলকে পেছনে ফেলেছিল মানচিনির দল? ইতালির রেকর্ড ভাঙার জন্য ফেবারিট বেছে নিতে বললেই বা আসবে কোন দলের নাম?
তাদের হারানো প্রায় অসম্ভব। কথাটা একরকম প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল ইতালি। কিন্তু বিশ্ব রেকর্ড গড়তে গিয়ে ইতালিও তো ভেঙেছিল কোনো না কোনো দলের রেকর্ড। যাদেরটা ভেঙেছিল, তাদের অপরাজেয় যাত্রাও শেষ হয়েছিল এক সময়। কেউ তো আর চিরকাল অজেয় থাকে না। উয়েফা নেশসন লিগের সেমিফাইনালে স্পেনের কাছে ইতালির হারের সবচেয়ে শিক্ষা তো আসলে ওটাই।
ইতালি: ৩৭ ম্যাচ
ছাই থেকে ফিনিক্স পাখি হয়ে উড়াল (২০১৮-২০২১)
জাতীয় শোক দিবস হয়তো ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে জায়গা না পাওয়া ইতালিয়ানদের জন্য জাতীয় শোকের মতোই ছিল। বড় কিছু পরিবর্তনও ছিল তাই অবশ্যম্ভাবীই। সেই পরিবর্তনের মশাল হাতেই আবির্ভাব কোচ রবার্তো মানচিনির। দায়িত্ব নিয়েই ভোজবাজির মতো সব বদলে দিতে পারেননি। প্রথম পাঁচ ম্যাচের মাত্র একটিতে জয়। হারের পাল্লায় ২, ড্র ২।
কিন্তু তারপর যে গল্পটা লেখা হলো, তা ফিনিক্স পাখির ছাই থেকে আকাশে ডানা মেলে প্রাণের আনন্দে উড়াল দেওয়ার। ইতালির খেলার খোলনলচেই পাল্টে গেল। টানা ৩৭ ম্যাচে অপরাজিত থাকার নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ার পথে ইতালিয়ান ফুটবলকেও নতুন করে চিনিয়েছে মানচিনির দল। ২০১৮ থেকে শুরু, টানা জয়ের বিশ্ব রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল গত মাসেই। যেটি আর দীর্ঘ হতে দিল না স্পেন।
মিলানের এই রাতের আগে ২০১৮ উয়েফা নেশনস কাপে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের পর্তুগালের কাছে সর্বশেষ হার। তারপর যে ছুটের শুরু, তাতে ৩৭ ম্যাচের ২৮টিতে জয়, বাকি ৯টি ড্র। এর মধ্যে ইউরোর মুকুটও উঠেছে মাথায়। শেষ পর্যন্ত ইতালি হারল বটে, কিন্তু তাদের খেলায় যে ধার ও ভার, তাতে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট হয়ে বসে আছে বাছাই পর্ব পেরুনোর আগেই।
ব্রাজিল: ৩৬ ম্যাচ
দ্বিতীয় সোনালী প্রজন্মের বিশ্বজয় (১৯৯৩-১৯৯৬)
বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে সফলতম দল ব্রাজিলের তখন কী আক্ষেপ! দুই দশকের বেশি সময় বিশ্বকাপ জেতা হয়নি। এমনকি ফাইনালেও ওঠা হয়নি একবারও। এমন সময় গড়ে ওঠে তাদের ‘দ্বিতীয় সোনালী প্রজন্ম’। সোনালী প্রজন্ম যে বিশ্বকাপ জিতবেই, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটি ছিল একেবারে অন্যরকম। সোনালি সাফল্যে মোড়া সেই সময়।
স্পেনের রেকর্ড ভেঙে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত টানা ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত ছিল ব্রাজিল। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে জার্মানির বিপক্ষে হারার পর থেকেই শুরু ব্রাজিলের অপ্রতিরোধ্য ওই যাত্রা। ২৪ বছর পর বিশ্বকাপও আসে এই সময়েই।
ব্রাজিলের স্বপ্নযাত্রার ওই সময়টায় দলে ছিলেন দুঙ্গা, বেবেতো, রোমারিওরা। ১৯৭০ সালে পেলের ব্রাজিলের পর আবারও বিশ্বকাপ দুলে ওঠে সাম্বার ছন্দে। যে ইতালি পরে তাদের টানা জয়ের রেকর্ড ভাঙবে, সেই ইতালিকেই ফাইনালে টাইব্রেকারে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ্বকাপ নিয়ে দেশে ফেরে দুঙ্গার ব্রাজিল।
অজেয় থাকার এই সময়েই ব্রাজিলের জন্য বড় একটা হতাশা হয়ে আছে ১৯৯৫ সালের কোপা আমেরিকায় উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হার। এটা তো সবার জানাই যে, পেনাল্টি শ্যুট আউটে খেলার নিষ্পত্তি হলে সেটাকে ড্র ধরা হয়। 'হারলেও' তাই অপরাজিতই ছিল ব্রাজিল। যে অজেয় যাত্রা থামে ১৯৯৬ সালে। সে বছরের জানুয়ারিতে গোল্ডকাপে মেক্সিকোর বিপক্ষে ২-০ গোলে মারিও জাগালোর দলের হারের মাধ্যমে।
স্পেন: ৩৫ ম্যাচ
তিকি-তাকার জাদু (২০০৭-২০০৯)
স্পেনের জন্য ২০০০-এর শেষটা ছিল সোনায় মোড়ানো। যেমন তাদের দল, তেমন তাদের খেলার স্টাইল। টানা তিন বড় শিরোপা (ইউরো, বিশ্বকাপ, ইউরো) জয়ের পথে দর্শকের মন রাঙানোর কাজটাও করেছে তিকি-তাকার জয়গান গাওয়া দলটি।
সর্বজয়ী ওই স্পেনের ৩৫ ম্যাচে অজেয় থাকার রেকর্ডের শুরু ২০০৭ সালে। আন্দ্রে ইনিয়েস্তার প্রথম আন্তর্জাতিক গোলে ওল্ড ট্রাফোর্ডে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারানোর মাধ্যমে। পরের বছর ফার্নান্দো তোরেসের একমাত্র গোলে জার্মানিকে হারিয়ে লুই আরাগোনেসের দল হয়ে যায় ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন। ২০১০ এর বিশ্বকাপ বাছাইয়েও অব্যাহত থাকে তাদের অজেয় যাত্রা। যেটির শেষটা হয় অপ্রত্যাশিতভাবে, ২০০৯ কনফেডারেশনস কাপে আমেরিকার কাছে হেরে। সেটিকে 'দুর্ঘটনা' প্রমাণ করে ২০১০ বিশ্বকাপ ও ২০১২ ইউরো জিতে নেয় স্পেন। তুলে দেয় সর্বকালের সেরা দল নিয়ে আলোচনাও।
আর্জেন্টিনা: ৩১ ম্যাচ
বাতিগোল এবং আর্জেন্টাইন স্বপ্নযাত্রা (১৯৯১-১৯৯৩)
১৯৮৬ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৯০ বিশ্বকাপে রানার্স আপ। এরপর? ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত অজেয় থাকা। যাতে ভেঙে যায় প্রায় ৫৪ বছর টিকে থাকা বিশ্ব রেকর্ড।
১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে হারের পর আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে আর্জেন্টিনা। হাঙ্গেরির বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ দিয়ে অপরাজেয় যাত্রার শুরু। পথে ১৯৯১ ও ১৯৯৩ এর কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতে নেওয়া। গোল করার অনায়াস দক্ষতায় ‘বাতিগোল’ নামে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা ছিলেন এই দলের মূল অস্ত্র। এই অজেয় সময়ে ১৬ গোল আসে তাঁর কাছ থেকে। এর মধ্যে আছে ১৯৯৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে জোড়া গোল। লিওনেল মেসি ভেঙে দেওয়ার আগ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার পক্ষে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডটাও ছিল বাতিস্তুতারই।
ইতালি: ৩০ ম্যাচ
আজ্জুরিদের প্রথম রাজত্ব (১৯৩৫-১৯৩৯)
চার-চারটি বছর অজেয় থাকা বিরাট ব্যাপার। এই বিস্ময় উপহার দিয়েছিল ভিত্তরিও পোজ্জোর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি। রবার্তো মানচিনির দল ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে যা ছিল ইতালিয়ান ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে স্বর্ণালি সময়।
১৯৩৫ সালের অক্টোবরে তখনকার চেকোস্লোভাকিয়াকে হারিয়ে স্বপ্নের অভিযাত্রা শুরু আজ্জুরিদের। টানা ৩০ ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ডটা অবশ্য না-ও হতে পারত। ১৯৩৭ সালে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা দর্শকের গণ্ডগোলের কারণে বাতিল না হয়ে গেলে হয়তো হেরেই যেত ইতালি। ম্যাচের ১৬ মিনিট বাকি থাকতে অস্ট্রিয়া এগিয়ে ছিল ২-০ গোলে। ইতালির ওই সময়েই এসেছিল ১৯৩৬ অলিম্পিকের সোনা। ফাইনালে হাঙ্গেরিকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে জিতেছিল ১৯৩৮ বিশ্বকাপও। বিশ্বকাপ শিরোপা ধরে রাখার প্রথম উদাহরণ গড়া দলটি অজেয় ছিল পরের বছর নভেম্বর পর্যন্ত। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে প্রায় ভুল যাওয়া পরাজয়ের স্বাদ পায় ইতালি।
ফ্রান্স: ৩০ ম্যাচ
মাতিয়ে তোলা ফরাসি সৌরভ (১৯৯৪-১৯৯৬)
ফ্রান্সের বর্তমান দলটা দারুণ। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু জাতীয় রেকর্ড ভাঙতেও তাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। বর্তমান কোচ দিদিয়ের দেশমও তাঁর দেশের ফুটবল-সৌরভ ছড়ানোর সময়ের সৈনিক। ১৯৯০ ও ১৯৯৪ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার পর ঘুরে দাঁড়ানোর দারুণ এক গল্পও এটি। যেখানে মিল আছে ইতালির এই দলের। কাকতালীয়ভাবে ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেপলসে ইতালির বিপক্ষে ১-০ গোলের জয় দিয়েই শুরু হয়েছিল ফ্রান্সের এই অজেয় যাত্রা। ওই সময়ে জিনেদিন জিদান, লিলিয়ান থুরামের মতো খেলোয়াড়দেরও শুরু হয়েছে। পরে যাঁরা কিংবদন্তি হয়েছেন। ১৯৯৬ ইউরোর সেমিফাইনালে চেক প্রজাতন্ত্রের কাছে টাইব্রেকারে হারকে বাদ দিলে ফ্রান্সের অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভাঙে সে বছরই ডেনমার্কের বিপক্ষে একটা প্রীতি ম্যাচে।
আলজেরিয়া: ২৯ ম্যাচ
সামনে রেকর্ডের হাতছানি (২০১৮-বর্তমান)
ওপরে যে দলগুলোর কথা বলা হলো, তাদের সবার রেকর্ডই ভেঙে ফেলতে পারে আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া। ২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত ২৯ ম্যাচে অপরাজিত তারা। যেটির শুরু ২০১৮ সালের নভেম্বরে টোগোর বিপক্ষে ৪-১ গোলের জয় দিয়ে। ২০১৯ আফ্রিকান নেশনস কাপের চ্যাম্পিয়নরা এখনো দারুণ ফর্মে। ইতালির টানা ৩৭ ম্যাচে অপরাজিত থাকার ভাঙার জন্য আলজেরিয়াই এখন সেরা বাজি।