আজ অ্যানফিল্ড লিভারপুল-সিটি

বাগযুদ্ধ ভুলে গার্দিওলা-ক্লপ: `আয় ভাই, বুকে আয়`

উৎপল শুভ্র

৩ অক্টোবর ২০২১

বাগযুদ্ধ ভুলে গার্দিওলা-ক্লপ: `আয় ভাই, বুকে আয়`

দলবদলকে কেন্দ্র করে কিছুদিন আগেই তির-পাল্টা তির ছোড়াছুড়ি হয়েছে দুজনের মধ্যে। আজ অ্যানফিল্ডে লিভারপুল-সিটি মুখোমুখি হওয়ার আগে বাতাসে তাই আগুনের ফুলকি ছুটে বেড়ানোটাই স্বাভাবিক হতো। উল্টো পেপ গার্দিওলা ও ইয়ুর্গেন ক্লপ একে অন্যকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে গত কয়েক মৌসুমে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই কোচের কণ্ঠে এমন ভ্রাতৃত্বের সুর, যা শুনে মনে হতেই পারে, একজন আরেকজনকে বলছেন, `আয় ভাই, বুকে আয়`।

এই তো সেদিনও ইয়ুর্গেন ক্লপের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন পেপ গার্দিওলা। দলবদলে যথেচ্ছ অর্থ খরচ করা নিয়ে ক্লপের কটাক্ষমিশ্রিত সমালোচনার তির আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে ছুটেছিল ম্যানচেস্টার সিটির দিকেও। সিটির ম্যানেজার গার্দিওলার তা ভালো লাগবে কেন? মিডিয়াকে মাধ্যম করে তিনিও ক্লপের দিকে ছুঁড়েছিলেন পাল্টা তির। আজ অ্যানফিল্ডে যুযুধান দুই কোচের দল যখন মুখোমুখি, বাতাসে আরও উত্তেজনার ফুলকি ছুটে বেড়ানোরই কথা। যেটিতে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব যথারীতি দুই কোচের। অথচ ঘটনা ঘটছে উল্টো। গার্দিওলা প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন লিভারপুল ও ক্লপকে। ক্লপও খুব করে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন ম্যান সিটি ও গার্দিওলাকে।

লিভারপুলের প্রশংসা করেই থেমে থাকেননি গার্দিওলা, ক্লপকে দিয়েছেন এর চেয়েও বড় এক স্বীকৃতি। ক্লপের সঙ্গে দ্বৈরথ নাকি তাঁকে ‘আরও ভালো ম্যানেজার’ বানিয়ে তুলেছে। আর ক্লপ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর চোখে ‘এই মুহূর্তে ইউরোপের সেরা ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি’ এবং গার্দিওলাকে তিনি খুব ‘পছন্দ’ করেন। শুধু তাই নয়, মিডিয়ায় নানা সময়ে নানা কথা প্রতিপক্ষ কোচকে বিরক্ত করেছে বলে ‘স্যরি’ও বলছেন।

পেপ গার্দিওলা: সবচেয়ে বেশি ম্যাচ হেরেছেন ক্লপের দলের কাছেই

ফুটবল যতটা না খেলোয়াড়দের খেলা, ঠিক ততটাই কোচদের। ডাগআউটের লড়াই তাই ফুটবলের অনিবার্য এক অনুষঙ্গ। গত কয়েক মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এই লড়াইটা সবচেয়ে বেশি মূর্ত হয়েছে ‘গার্দিওলা বনাম ক্লপ’ রূপ ধরেই। শিরোপা লড়াইটা যে অনেকটাই এই দুজনের ব্যক্তিগত লড়াইয়ের রূপ নিয়েছে। গত চার মৌসুমে একবারই লিগ জিততে পারেনি সিটি। ২০১৯-২০ মৌসুমে কোন দল তাদের শিরোপাবঞ্চিত করেছিল, তা আপনার মনে থাকার কথা। না থাকলেও ‘গার্দিওলা বনাম ক্লপ’ নিয়ে এত কথা থেকেই আপনি অনায়াসে অনুমান করে নিতে পারতেন, সেই দলটা ক্লপের লিভারপুল।

গার্দিওলা-ক্লপ লড়াইয়ের গল্প অবশ্যই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে শুরু নয়। ২০১৬ সালের গ্রীষ্মে ম্যান সিটির দায়িত্ব নিয়েছেন গার্দিওলা। এর আগের বছর লিভারপুলে এসেছেন ক্লপ। এর আগে জার্মানির বুন্দেসলিগাতেই তো এই দ্বৈরথের বীজ বোনা হয়ে গেছে। গার্দিওলা যখন বুন্দেসলিগার ‘দৈত্য’ বায়ার্ন মিউনিখের কোচ, তাঁর সবচেয়ে বড় লড়াইটা ছিল ক্লপের বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের সঙ্গেই। আরেকটা তথ্যও যোগ করে নিতে পারেন এর সঙ্গে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ক্লপের কাছে ৮টি ম্যাচে হেরেছেন গার্দিওলা। ম্যানেজার বলুন, বা কোচ...এই মুখোমুখি লড়াইয়ের হিসাব করলে এটাই গার্দিওলার সর্বোচ্চ পরাজয়ের রেকর্ড। 

এসব মনে রেখেই ‘শত্রুতা’ নবায়নের নতুন লড়াইয়ের আগে গার্দিওলা বলছেন, ‘আমি এখানে আসার পর প্রথম বছরটা বাদ দিলে লিভারপুল আসলে সব সময়ই লড়াইয়ে ছিল।’ 

আর ক্লপ তো দিয়ে দিচ্ছেন সর্বোচ্চ স্বীকৃতিই, ‘ওরা (সিটি) সম্ভবত এই মুহূর্তে ইউরোপের সেরা দল।’

৬টি করে ম্যাচ খেলার পর দুই দলের পয়েন্টের ব্যবধান এখন ১। লিভারপুলের ১৪, সিটির ১৩। ৭ ম্যাচে ১৬ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে আছে চেলসি। এমনিতেই বড় ম্যাচ, তাতে বাড়তি তাৎপর্য যোগ করেছে এটি। আজকের ম্যাচে জয় পেলে চেলসিকে টপকে এক নম্বরে উঠে যাবে লিভারপুল। সিটি জিতলে ছুঁয়ে ফেলবে চেলসিকে।

ইয়ুর্গেন ক্লপ: পেপকে আমি খুব পছন্দ করি

অ্যানফিল্ডে জয়-পরাজয়ের হিসাবে লিভারপুলই এগিয়ে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারির কথা মনে আছে তো? সেবার অ্যানফিল্ডে গিয়েই লিভারপুলকে ৪-১ গোলের পরাজয়ের গ্লানিতে ডুবিয়ে দিয়ে এসেছিল সিটি। ক্লপের তো আর এটাও অজানা নয়, মাঝের দলবদলে সিটি নিজেদের আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। 

আগস্টে ওই দলবদলের প্রসঙ্গ নিয়েই ক্লপ খুব করে খুঁচিয়েছিলেন গার্দিওলাকে। একজন খেলোয়াড়ের (জ্যাক গ্রিলিশ) পেছনেই গার্দিওলাকে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে দেখে বলেছিলেন, ‘চেলসি, সিটি বা ইউনাইটেডের আর্থিক ক্ষমতা আমাকে কখনো অবাক করে না। এসবের সমাধান কীভাবে তারা বের করে, তা বোঝার মতো সময় আমার কেটেছে এখানে (ইংল্যান্ডে)।’

কথাটা গার্দিওলার খুব গায়ে লেগেছিল। ক্লপ ফুটবল ক্লাবের আদর্শ বাণিজ্যিক উদাহরণ দিতে এ-ও বলেছিলেন, লিভারপুল খেলোয়াড়দের পেছনে শুধু ক্লাবের আয়ের টাকাটাই খরচ করে। গার্দিওলার জবাবটাও ছিল একই রকম তীব্র, ‘অন্য ক্লাবের যা বিশ্বাস, তারা তা-ই করুক। কিছু মালিক লাভ চায়। আবার কেউ আছে লাভ চায় না। তারা ক্লাবে আরও বিনিয়োগ করতে চায়। আমাদের যা বিনিয়োগ করার, তাই করি। ৬০ মিলিয়ন পাউন্ডে কাউকে বেচতে পারি বলেই আমরা জ্যাক গ্রিলিশের জন্য ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে পারি। আমাদের খরচ আসলে ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড।’

আবার মুখোমুখি হওয়ার আগে কিছুদিন আগের সেই বাগযুদ্ধ যেন একেবারেই ভুলে গেছেন গার্দিওলা ও ক্লপ। নইলে গার্দিওলা কেন বলবেন, ‘ইয়ুর্গেন ক্লপের দলগুলো আমাকে আরও ভালো ম্যানেজার হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। তিনি আমাকে ভিন্ন উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন। আরও ভাবতে, নিজের আরও উন্নতি করতে, আরও ভালো ম্যানেজার হতে সহায়তা করেছেন।’ 

সৌজন্যের জবাবে সৌজন্য উপহার দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামবেন ক্লপও, ‘পেপকে কখনো বলেছি কি না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, তবে ঘটনা হলো, আমি তাকে পছন্দ করি।’

পুরোনো এই ছবিতে নতুন অধ্যায় যোগ হবে আজ

অতীতের সব তিক্ততাকে কবর দেওয়ার প্রতিজ্ঞা থেকেই কি না এখানেই থামেননি, ‘সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলে নিশ্চিতভাবেই তাকে আমি বিরক্ত করেছি। তবে তার ব্যাপারে খারাপ কিছু বলার উদ্দেশ্য আমার কখনোই ছিল না। সিটির কেউ হয়তো তাকে বলল যে, “ক্লপ এটা বলেছে”। তা শুনে সে সত্যি খুব চটেছে। আমি এসবের জন্য দুঃখিত। সত্যিটা হলো, আমি তাকে খুব শ্রদ্ধা করি।’

বড় ম্যাচের আগে উত্তেজনাময় বাতাবরণ চাইলে নিশ্চিতভাবেই আপনি হতাশ হচ্ছেন। দুই কোচ এমন ‘আয় ভাই, বুকে আয়’ জাতীয় কথাবার্তা বললে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ থাকে না কি!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×