শেরিফের চমক তো শুধু রিয়ালকে হারানোতেই শেষ নয়
উৎপলশুভ্রডটকম
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১
চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বে এই প্রতিযোগিতার সফলতম দল রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে চমকে দিয়েছে শেরিফ তিরাসপোল। শেরিফের চমক অবশ্য রিয়ালকে হারানোতেই শেষ নয়। চমক তো এই ক্লাবটির পরতে পরতে। শুরুটা করুন এটা দিয়ে...মলদোভান ক্লাব বলা হচ্ছে শেরিফকে, কিন্তু আসলে তো তারা মলদোভান নয়! তাহলে কী?
অর্ধেকটা শুনলে গল্পটা রোমাঞ্চকর ঠেকে বেশ। চার পর্বের প্রাক-বাছাইপর্ব পেরিয়ে, দিনামো জাগরেবকে কোয়ালিফায়ারে হারিয়ে প্রথম মলদোভান ক্লাব হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছিল শেরিফ তিরাসপোল। ইন্টার মিলান, রিয়াল মাদ্রিদের মতো জায়ান্টদের সঙ্গে এক গ্রুপে পড়ার পর পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে থেকেই শেষ করাটা ছিল যাদের নিয়তি, তারাই দ্বিতীয় ম্যাচে হারিয়ে দিল চ্যাম্পিয়নস লিগের সফলতম দল রিয়ালকে। এখন পর্যন্ত অবস্থানটাও সবার ওপরে। রূপকথার গল্পগুলো তো এমনই হয়, না?
কিন্তু এতটুকুতেই গল্পটা শেষ করলে যে মস্ত বড় একটা ফাঁক থেকে যায়। যে ফাঁকিটা ধরতে হলে আমাদের আগে শেরিফ তিরাসপোলের ইতিহাসটাও জানা চাই!
ভূগোলের পাঠ ভালো থাকলে জানা আছে নিশ্চয়ই, তিরাসপোল শহরটা ত্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থিত। সেই ত্রান্সনিস্ত্রিয়া, মলদোভায় থেকেও যারা আদতে মলদোভা নয়। রোমানিয়া আর ইউক্রেনের মাঝে অবস্থিত অঞ্চলটা বাকি মলদোভা থেকে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছে সেই ১৯৯১ সালে। কিন্তু পরের বছরই কিছুটা সংঘাত শেষেই পুনরায় জুড়ে গিয়েছিল বাকি দেশের সঙ্গে।
এক হয়ে গেলেও নিজেদের স্বকীয়তার প্রশ্নে পুরোদস্তুর সোচ্চার তিরাসপোল। নিজেদের মলদোভান পরিচয়ের চেয়ে সোভিয়েত উত্তরাধিকার হিসেবেই পরিচিত করতে বেশি আগ্রহ তাদের৷ নিজেদের মানচিত্র, মুদ্রা যেমন আছে; তেমনি আছে দারিদ্র্য, বিদেশিদের সন্দেহের চোখে দেখার অভ্যাস। আছে ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বললেই ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতাও।
***
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পরে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ওই অঞ্চলে, তার সুযোগ পুরো মাত্রায় নিয়েছিলেন ভিক্টর গুসান। শোনা যায়, ওই সময় চোরাচালান করে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছিলেন যারা, ইনি তাদেরই একজন। পেশায় পুলিশ হলেও ওই চাকরি ছেড়ে ১৯৯৩ সালে সহকর্মী ইলিয়া কামালিকে নিয়ে শেরিফ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এই গুসান। তিরাসপোল শহরটা এখন বলতে গেলে গুসানের কোম্পানিই নিয়ন্ত্রণ করে, শহরের সর্বস্তরে তাদের প্রভাব লক্ষণীয়। গুসানের কোম্পানিই পরে হাত বাড়ায় ফুটবলে। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা পায় এফসি শেরিফ তিরাসপোল। সে অর্থে প্রতিষ্ঠা ঠিক নয়, এফসি তিরাস তিরাসপোল নামে একটা ক্লাব দ্বিতীয় বিভাগে আগে থেকেই খেলত, ওই দলটাকেই '৯৬ সালে কিনে নিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে শেরিফ। দলটার পেছনে গুচ্ছের অর্থ খরচেও আপত্তি নেই গুসানের।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে মলদোভান ফুটবলের শীর্ষ লিগ 'ডিভিজিয়া ন্যাশিওনালা'য় রীতিমতো রাজত্ব করে চলেছে দলটা। জিতেছে শেষ ২১টা লিগের ১৯টাই। গত মৌসুমে তো ৩৬টি ম্যাচের ৩২টিতেই জয়। প্রতিপক্ষকে রীতিমতো গোলবন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে তারা; ছয়বার ৬-০, দুবার ৭-০, একবার ১০-০; লেখা হয়েছে এমন সব স্কোরকার্ড। খুব একটা অবাক হবেন না। টাকায় তো বাঘের দুধও মেলে, তাই না?
শেরিফের সাফল্যের মূলে মলদোভান ঘরোয়া লিগে বিদ্যমান এই অর্থের বৈষম্যই। শেরিফের একটা অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম আছে, ১৮টা অনুশীলন মাঠ আছে, শীতকালে বাইরে না গিয়ে ইনডোরে অনুশীলনের সুযোগ আছে, দুটি করে ক্লাব হোটেল, সুইমিংপুল আছে। আর অন্যদের কী সুযোগ-সুবিধা? অনুশীলনের জন্য তাদের মাঠ ভাড়া করতে হয় স্থানীয় পৌরসভা থেকে! ও'কনর যে গল্পটা বলেছেন, সেটা তো ভিরমি খাওয়ায় রীতিমতো! একবার তিনি দেখলেন, স্থানীয় একটা শীর্ষ বিভাগের দল গ্যালারির একটা স্ট্যান্ডের পেছনে খেলোয়াড়দের বহন করে আনা বাসটা পার্ক করছে। ওই দলের এক খেলোয়াড়কে জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারলেন, তাদের সম্বল বলতে এই বাসটাই আছে এবং মাঠের আর কোথাও পার্কিং করার অনুমতি ছিল না তাদের। এমন দশা যেই লিগের, সেখানে শেরিফের মতো বিত্তশালীদের রাজত্ব করাই তো স্বাভাবিক!
তবে সেটা ঘরোয়া লিগে। এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্য পাওয়ার কথা ছিল না শেরিফের। মলদোভার মতো নিচু সারির ক্লাব হওয়া একটা কারণ তো বটেই; তার চেয়েও বড় কারণ, বড় সাফল্য পেতে যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল দলটা, তার মেয়াদ ফুরিয়েছে কয়েক বছর আগেই।
২০০৯-১৭ সালের মধ্যে চারবার ইউরোপা লিগে খেলেছে দলটা, তবে এরপর থেকেই তাদের পারফরম্যান্সে ভাটার টান। ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের বাছাইপর্বে মেসিডোনিয়ান ক্লাব কেএফ স্খেনদিয়ার কাছে হেরে বাদ পড়েছিল তারা, ইউরোপা লিগের প্লে-অফে বাদ পড়েছিল আইসল্যান্ডের ক্লাব ভালুরের কাছে হেরে। পরের বছরও একই পরিণতি, এবার হার সাবুর্তালো তিবলিসি আর সুইডিশ ক্লাব এআইকে স্টকহোমের কাছে। আর সর্বশেষ বছরে আজারবাইজানীয় ক্লাব কারাবাগ তাদের টপকে উঠে গিয়েছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল পর্বে। পরে গিয়ে ইউরোপা লিগে তাদের দেখা হয়েছিল আর্সেনালের সঙ্গে।
***
এবার তাহলে হঠাৎ করে তাদের পুনরুত্থানের রহস্য কী? চ্যাম্পিয়নস লিগ বাছাইপর্বের 'ন্যাচারাল ভ্যারিয়েশন' অবশ্যই একটা কারণ। ভূমিকা রেখেছে ২০১৯ সালের শেষদিকে মলদোভান ফুটবল লিগের একটা নিয়মের পরিবর্তনও।
এর আগে ডিভিজিয়া ন্যাশিওনালার দলগুলোকে শুরুর একাদশে চারজন মলদোভান খেলোয়াড়কে একাদশে রাখতে হতো। কিন্তু ওই নিয়ম এখন বাতিল করা হয়েছে। সুযোগটা শেরিফ লুফে নিয়েছে পুরোপুরি। চ্যাম্পিয়নস লিগের স্কোয়াডে তাকিয়েই দেখুন, ১৫টা দেশের প্রতিনিধি আছে তাদের দলে; মলদোভান খেলোয়াড়ের সংখ্যা মাত্র পাঁচজন, যার মধ্যে দুজন আবার রিজার্ভ গোলরক্ষক।
২০১৮ সাল থেকে পুরো দলের খোলনলচেই পাল্টে ফেলেছে তারা। ব্রাজিলিয়ান ফুল-ব্যাক ক্রিস্টিয়ানো, যিনি কি না ২০১৮ সালে শেরিফে যোগ দিয়েছেন, তিনিই বর্তমান শেরিফ দলে সবচেয়ে বেশি সময় টিকে থাকা ফুটবলার। দিনামো জাগরেবকে যে দলটা হারিয়েছে, শুরুর একাদশে থাকা নয় ফুটবলারকেই শেরিফ সই করিয়েছে ২০২১ সালে।
শেরিফের পরিকল্পনাটাও ধরা যাচ্ছে পরিষ্কার। দক্ষিণ আমেরিকা কিন্তু ফুটবলের পশ্চাৎপদ অঞ্চল থেকে তরুণ প্রতিভা তুলে এনে তাদের ইউরোপের বড় মঞ্চে পারফর্ম করার সুযোগ দিতে চাইছে তারা, যেন তাদের ইউরোপের বড় দলগুলোর নজরে এনে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে বিক্রি করা যেতে পারে। যে তরিকা মেনে এর আগেই সাফল্য পেয়েছে শাখতার দোনেৎস্ক।
ছোট পরিসরে কাজও শুরু করে দিয়েছে তারা। '০০-এর দশকের শেষদিকে মস্কোভিত্তিক ক্লাবগুলোতে নিয়মিতই খেলোয়াড় সরবরাহ করতে শুরু করে তারা, কয়েক মৌসুম আগে উইঙ্গার সিরিয়ে বায়ালাকে ফরাসি ক্লাব লেঁসে এবং ফরোয়ার্ড ভিতালি দামাস্কানকে ইতালিয়ান ক্লাব তোরিনোতেও পাঠিয়েছে। কিন্তু এখনো উইলিয়ান/ফার্নান্দিনহো/ফ্রেডের মতো বড় দাও মারার অপেক্ষায় আছে দলটা।
রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে পাওয়া জয়টা অবশ্য ধারণা বদলে দিতে পারে তাদের। শুধু খেলোয়াড় বিক্রি করেই নয়, খেলোয়াড় কিনেও ইউরোপের বড় মঞ্চে সাফল্য চাইতে পারে শেরিফ তিরাসপোলের। চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল পর্বে জায়গা পাওয়াতেই যেভাবে 'রূপকথা লিখে ফেলেছে' শিরোনাম হচ্ছে তাদের নিয়ে, আরও বড় রূপকথা লেখার ইচ্ছে তো তাদের হতেই পারে।
*'দ্য অ্যাথলেটিক' অবলম্বনে রিজওয়ান রেহমান সাদিদ