ছবিটা মনের দেয়ালে ঝুলে থাকল ছবি হয়েই!
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
২৬৩ মিনিট কেটে গেছে, অথচ গোল পাননি লিওনেল মেসি। প্যারিস সেন্ট-জার্মেইতে এসে মেসি মুখোমুখি হয়েছিলেন এমনই এক অভিজ্ঞতার। সেই গোলখরা কাটালেন মায়াবী এক গোলে। তাঁর সঙ্গে গোল পেলেন ইদ্রিস গায়াও, প্যারিস সেন্ট-জার্মেই ২-০ ব্যবধানে জিতল ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে। তবে সব ছাপিয়ে ম্যাচের ওই ছবিটাই তো মনে গেঁথে রইল, ফ্রি-কিক ঠেকাতে মাটিতে শুয়ে আছেন মেসি।
ফ্রি কিক পেয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। প্যারিস সেন্ট-জার্মেইর ফুটবলাররা দাঁড়ালেন দেয়ালে। হঠাৎ ক্যামেরা ধরল তাঁকে। ও কী! সতীর্থ পিএসজি ফুটবলারদের পায়ের তলায় মাটিতে শুয়ে রয়েছেন লিওনেল মেসি!
এখন এমন দৃশ্য দেখা যায় হামেশা। ফ্রি কিকের সময় দেয়ালে দাঁড়ানো ফুটবলাররা লাফিয়ে ওঠেন, হেড করে বল বিপন্মুক্ত করার আশায়। অনেকেই, তাঁদের মধ্যে মেসি নিজেও আছেন, সময়জ্ঞান নিখুঁত করতে পারলে ওই লাফিয়ে ওঠা ফুটবলারদের পায়ের তলা দিয়ে বল গলিয়ে গোলে পাঠান। সেভাবে যাতে গোল না খেতে হয়, বল যাতে লাফানো ফুটবলারদের পায়ের তলা দিয়ে বেরিয়ে শুয়ে থাকা ফুটবলারের পিঠে ধাক্কা খায়, কোনো কোনো ফুটবলারকে ওভাবে পাহারা দিতে হয় মাটিতে শুয়ে। মেসি তখন সেই ভূমিকায়। শুয়ে রয়েছেন মাটিতে, নিজের গোলের দিকে মুখ করে। তাঁর নতুন ঘরের মাঠ পার্ক দে প্রিন্সেসে।
এমন দৃশ্য কি কখনো দেখেছিল তাঁর কুড়ি বছরের ‘হোম’ ক্যাম্প ন্যু? মনে পড়ে না!
মনে পড়ে অবশ্য বছর ছত্রিশেক আগের ঘটনা। দেখা নয়, বইতে পড়া। দিয়েগো মারাদোনার দ্বিতীয় বছর নাপোলিতে, ১৯৮৫ সালে। কোচ ওত্তাভিও বিয়াঞ্চি। অনুশীলনে ম্যারাডোনাকে স্লাইডিং ট্যাকল শেখাতে চেয়েছিলেন। মাটিতে শুয়ে পড়ে ট্যাকল করা। ম্যারাডোনা শুনেই খাপ্পা! ‘শোনো কোচ, ফুটবল মাঠে দিয়েগো তখনই শুয়ে পড়ে যখন বিপক্ষ ফাউল করে ফেলে দেয়, নিজে থেকে শোয় না।’
সোজা কথা, স্পষ্টভাষায়। কোচ মুখ লুকোতে যান, পারেন কী করে! বুঝে গিয়েছিলেন ভবিতব্য। স্বগতোক্তির মতো বেরোয় প্রশ্ন কোচের, ‘গোটা মৌসুমটাই এভাবে জ্বালাবে, তাই তো?’ ম্যারাদোনা হাসেন, নির্ভরতার হাসি!
ছত্রিশ বছর পরের ইতিহাস অন্য রকম। মেসিও বার্সেলোনা ছেড়ে এসেছেন, বাধ্য হয়ে। কুড়ি বছর পর অন্য দেশ, অন্য ক্লাব, অন্য সাজঘর, যেখানে তিনিই সর্বেসর্বা নন, তাঁর জন্য রাখা নেই সোনার সিংহাসন। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে নতুন করে নতুন পরীক্ষায়। ২৬৩ মিনিট পর প্রথম গোল পেয়েছেন সবে। তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারে মৌসুমের শুরু থেকে ধরলে তৃতীয় সর্বোচ্চ অপেক্ষার পর। আগে ২৯৮ এবং ২৮৮ মিনিটের রেকর্ডগুলো, যথাক্রমে ২০০৫-০৬ এবং ২০১৯-২০ মৌসুমে, বই ঘেঁটে বের করে রেখেছেন পরিসংখ্যানবিদরা। আরও একটা ৯০ মিনিট গোলহীন মানে দীর্ঘতম অপেক্ষায় দ্বিতীয় স্থানে উত্তরণ।
সে দুরাশার মুখে আগুন! মাঝমাঠ থেকে নির্বিষ বল নিয়ে দৌড়লেন স্বভাবসিদ্ধ। ফাঁকা জায়গা কেন দিয়েছিল তাঁর প্রাক্তন-গুরুর মাঝমাঠ, পরের ম্যাচের আগে পেপ গার্দিওলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবেন সাজঘরে। যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, বকবেন। হয়ত, ফার্নান্দিনহোকে প্রথম এগারোয় রাখবেন আগেই। কিন্তু মাঠে ততক্ষণে যা যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। দৌড়োলেন, গোলে শট নেওয়ার আগে একটা ছোট ওয়ান-টু, কিলিয়ান এমবাপ্পের সঙ্গে। ফরাসি বিশ্বজয়ী ফুটবলার পায়ের পেছন দিয়ে টোকায় রেখে গিয়েছিলেন, আস্তেই। কিন্তু গোলসন্ধানী মেসি তবুও নিজেকে বাঁদিকে হেলালেন, বাঁ পায়ে শট নিলেন আর ঝলসে উঠল সেই বাঁ পা। ব্রাজিলীয় গোলরক্ষক এডারসন দেখলেন শুধু, অসহায়। তাঁর বাঁ দিকের জালে, পরিভাষায় যাকে ‘টপ কর্নার’ বলে, বল ততক্ষণে খুঁজে নিয়েছে পরিচিত আশ্রয়, তিনি হাত বাড়ানোর সুযোগও পাননি। ধারাভাষ্যকারের প্রশংসা থামছে না, মেসিভক্তরা মনে মনেই পুষ্পবৃষ্টি করে চলেছেন। আরও একটা গোল চ্যাম্পিয়নস লিগে, ১২০-র পর প্রথম গোল ইউরোপে, ৬৭২-এর পর প্রথম গোল অন্য ক্লাবের জার্সিতে। এবং, একেবারে আগমার্কা মেসি ছাপ, প্রাক্তন গুরুকে পাঁচবারের দেখায় তৃতীয়বার হারানো ও পাঁচ ম্যাচে সপ্তম গোলে!
কথা উঠেছিল প্রচুর। তাঁর গোল না পাওয়া নিয়ে। দুরন্ত একটা ফ্রি কিক সেই বার ও পোস্ট যেখানে সমকোণে মিশে যায় সেখানে ধাক্কা খেয়ে ফিরেছিল। আরও একবার ক্রসবার বাঁচিয়েছিল তাঁর প্রয়াস। বার দুয়েক বিপক্ষ গোলরক্ষক। কিন্তু, মেসি মানেই তো গোলমেশিনও। তাই এগুলো সবই ব্যর্থতার খাতায়। তাঁর পরিচিত জায়গা, মাঠের ডান প্রান্ত ধরে এগোনোর সুযোগ কম। বেশিরভাগ সময় মাঝমাঠে। তবুও ডানদিকে যখন গেলেন, আশরাফ হাকিমির সঙ্গে বোঝাপড়ায় দু-তিনবার পুরনো ছবির ঝলক। মাঝেমাঝেই মনে হয়েছে আর্জেন্টিনার হয়েই খেলছেন যেন! বল দিয়ে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম! ওখানে, মানে জাতীয় দলের জার্সিতে যা সতীর্থদের অপারগতা, এখানে পিএসজিতে সতীর্থদের তাঁকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা।
ওপরে তিনজন প্রতিভাবান হলে দলের সাফল্যে কাউকে না কাউকে রবার্তো ফিরমিনো বা লুইস সুয়ারেজ হয়ে উঠতেই হয়। পিএসজিতে মরিসিও পচেত্তিনোর আসল কাজই হয়তো ওই ফিরমিনোকে খুঁজে বের করা, অন্তত যত দিন না এমবাপ্পে চলে যাচ্ছেন রেয়াল মাদ্রিদে। তাঁকে না পেয়ে রিয়ালেরও হতশ্রী অবস্থা ফুটে বেরোল মলদোভার ফুটবল ক্লাব শেরিফের কাছে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে, ১-২ হেরে। যদিও মেসির গোলের আগে শেষ ছোঁয়া তাঁর পায়েই। এই সম্পর্ক মাঠে যত ভাল হয়, পিএসজির মঙ্গল। অন্তত এই মৌসুমটা, বা জানুয়ারির নতুন দলবদলের জানালা খোলা পর্যন্ত যেহেতু এমবাপ্পেকে থাকতেই হবে প্যারিস শহরে। তাই তো গোলের পর নেইমার যখন জড়িয়ে ধরে আনন্দে মেতে উঠেই পড়লেন মেসির কোলে, আর্জেন্টাইন অধিনায়কের হাত তখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এমবাপ্পেকেই খুঁজছিল অনেকক্ষণ!
পচেত্তিনোর দলের আরও সমস্যা, বলের দখল হারানো, অযাচিত। বিপক্ষকে দ্রুত খেলায় ফেরাতে যা সাহায্য করল, বিশেষ করে ম্যানচেস্টার সিটির মতো বল পায়ে খেলা দলকে। বারবার বিপদ ঘনিয়ে এল। সার্জিও রামোস আপনি কোথায়! মারকুইনোস ঠিক আছেন, কিম্পেম্বের জায়গায় রামোস এলে হয়তো খেলোয়াড় জীবনের এই শেষ বয়সেও স্পেনের প্রাক্তন অধিনায়ক এতটা দিলদরিয়া হবেন না, বক্সে বিপক্ষের ফুটবলারদের বিনা বাধায় হেড বা শট নেওয়ার ক্ষেত্রে। আর সিটির প্রেসিংয়ে যতটা, তার চেয়েও বেশি নিজেদের খামখেয়ালিপনায় বলের দখল নিয়মিত হারানোর এই অভ্যাস ফরাসি লিগে ঝামেলায় না ফেললেও ইউরোপে অবশ্যই সমস্যা তৈরি করবে। হয়ত আনহেল ডি মারিয়ার অনুপস্থিতিও বড় কারণ। কিন্তু ইউরোপ-সেরা হওয়ার লক্ষ্যটা নিজেদের সাজঘরে যাঁরা ঝুলিয়ে রাখতে চাইছেন, এভাবে চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো ভুল পাস দেওয়া যুক্তিহীন।
সেনেগালের ইদ্রিসা গায়ার দুরন্ত গোল আর ইউরোপ-সেরা দোনারুম্মার সদাসতর্ক মনোভাব তাই এতগুলো ভুলের মাঝেও পিএসজিকে দিয়ে গেল কাঙ্ক্ষিত তিন পয়েন্ট ঘরের মাঠে।
আর, বৈদ্যুতিক আলোয় আলোয় প্যারিসের আকাশে সব ছাপিয়ে গেল মেসির মুক্তি!