রিভালদো, রোনালদিনহো, মেসি...জার্সির ওজনটা টের পাচ্ছেন আনসু ফাতি?
রিজওয়ান রেহমান সাদিদ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
৩২২ দিন পর মাঠে নেমেছিলেন আনসু ফাতি, মাত্র মিনিট দশেক খেলে গোলও পেয়েছেন। শুরুটা ভালোই, তবে মাত্রই তো শুরু। একে তো বার্সার করুণ দশা, তার ওপর বার্সার ১০ নম্বর জার্সিও উঠেছে তাঁর গায়ে৷ রিভালদো, রোনালদিনহো, লিওনেল মেসি পরে গেছেন যে জার্সি, তার একটা ওজন তো আছেই। ফাতিও নিশ্চয়ই তা টের পাচ্ছেন।
ওই দৃশ্যগুলোতে অভিনবত্ব খুঁজতে চাওয়া বৃথা। মাঠের বাঁ প্রান্ত ধরে উঠে যাচ্ছেন, তাঁর গতির তোড় সামলাতে গিয়ে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ত্রাহি-ত্রাহি দশা, তাঁর জোরালো শট জালে জড়িয়ে যাচ্ছে গোলরক্ষক কিছু বুঝে ওঠার আগেই… এমন দৃশ্যগুলো তো আনসু ফাতিই তো দেখিয়েছিলেন! লেভান্তের বিপক্ষে ম্যাচে মিনিট দশেক সুযোগ পেয়ে সেসব দৃশ্যই মঞ্চে নামালেন আরেকবার।
তবে কিছু পার্থক্য থাকল এরপরও। এর আগে যা করেছেন, সব ৩১ কিংবা ২২ নম্বর জার্সি পরে; আর এদিন তাঁর গায়ে বার্সেলোনার ১০ নম্বর জার্সি। ওই ১০ নম্বর, শুধুই সংখ্যার সীমানা ছাড়িয়ে যাঁকে অমর বানিয়েছেন রোনালদিনহো কিংবা লিওনেল মেসি।
শুধু রোনালদিনহো কিংবা মেসিই নন; বার্সেলোনার ১০ নম্বর জার্সি উঠেছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনা, গিওর্গি হ্যাজি, রিস্টো স্টয়চকভ কিংবা লাদিসলাও কুবালার গায়েও। তবে তাঁরা যে সময়টায় খেলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জার্সি নম্বর দেওয়ার চলটা চালু হয়নি তখনো। যা চালু হয়েছে ১৯৯৫-৯৬ মৌসুম থেকে, বার্সেলোনার ১০ নম্বর জার্সি পরার শুরুটাও তাই আনহেল কুয়েয়ারের গায়ে।
স্প্যানিশ এই ফুটবলার উঠে এসেছিলেন রিয়াল বেতিসের একাডেমি থেকে। ওই দলের হয়েই ১৯৯০-৯১ মৌসুমে অভিষেকের পর খেলেছিলেন পাঁচ মৌসুম, সেখানে ৩৬ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ৬ গোল। কিন্তু এই পারফরম্যান্স দিয়েই বার্সেলোনা কর্তাদের মন কেড়ে নিয়েছিলেন পুরোপুরি। ১৯৯৫ সালে তিন মিলিয়ন ইউরো খরচ করে ন্যু ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিল তাঁকে। বার্সা বোর্ড ক্ষান্ত হয়নি সেখানেই, আসতে না আসতেই ১০ নম্বর জার্সি তুলে দিয়েছিল তাঁর হাতে।
বিনিময়ে কুয়েয়ার দিয়েছিলেন ঘণ্টা। আগমনের মাস ছয়েকের মধ্যেই পড়েছিলেন অ্যান্টরিয়র ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট ইনজুরিতে। চোট কাটিয়ে সাড়ে পাঁচ মাস পর ফিরেছিলেন যদিও, তবে পুরো মৌসুমে ১৬ ম্যাচ খেলে করেছিলেন মাত্র ২ গোল। বার্সাও বুঝেছিল, তাঁকে ১০ নম্বর ভাবাটা ভুলই হয়েছে। কুয়েয়ার এরপর বার্সায় কাটিয়েছিলেন আর একটা মৌসুমই, ওই মৌসুমে খেলেছিলেন ১১ নম্বর জার্সি পরে।
কুয়েরারের কাছ থেকে নম্বরটা গিয়েছিল ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার জিওভান্নির কাছে। ১৯৯৬ সালে ববি রবসন দায়িত্ব নিয়েই যে কয়েকজন ফুটবলারকে বার্সেলোনায় ভিড়িয়েছিলেন, ইনি তাঁদেরই একজন। বার্সেলোনার হয়ে তিন মৌসুমে খেলেছিলেন ১০৭ ম্যাচ, তাতে ৩৫ গোলের পাশপাশি করেছিলেন ৯ অ্যাসিস্ট। জিতেছিলেন ৮ শিরোপাও, যার মধ্যে আছে পরপর দুই মৌসুমের লা লিগা ট্রফিও।
জিওভান্নির বার্সেলোনা-অধ্যায়টা আরও লম্বাই হতো সম্ভবত। তবে ম্যানেজার লুই ফন হালের কারণে হয়নি সেটা। ১৯৯৭ সালে রবসনের আসতেই ফন হালের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরে জিওভান্নির। দু'মৌসুম দাঁতে দাঁত চেপে কাটালেও ১৯৯৯ সালে আর থাকেননি; বার্সেলোনা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন অলিম্পিয়াকোসে। দুজনের সম্পর্কের তিক্ততা কতদূর গড়িয়েছিল, সেটা বুঝে নেওয়া যায় ফন হাল সম্পর্কে জিওভান্নির করা ওই মন্তব্য থেকেই, 'লোকটা বদ্ধ উন্মাদ। ফুটবল সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ ধারণাও নেই। কিচ্ছু জানে না।'
বার্সেলোনার পরবর্তী 'নম্বর টেন'-কে এনেছিলেন ফন হালই। আয়াক্সে কাজ করার সময় থেকেই ইয়েরি লিটমাননের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর, ওই সূত্রেই ১৯৯৯-এর গ্রীষ্মে তাঁকে কাতালুনিয়ায় ডেকে এনেছিলেন ফন হাল।
আয়াক্সের হয়ে ২৫৫ ম্যাচ খেলে গোল করেছিলেন ১৩৩টি, গোলে সহায়তাও করেছিলেন ৩৩ বার। তবে ডাচ ক্লাবের ওই অনবদ্য ফর্মের কানাকড়িও নিয়ে আসতে পারেননি স্পেনে। চোটের সঙ্গে লড়ে টিকে ছিলেন দুই মৌসুম, খেলতে পেরেছিলেন মাত্র ৩২ ম্যাচ। ১০ নম্বর জার্সির অধিকার তো হারিয়েছিলেন প্রথম মৌসুম শেষেই। চার মিলিয়ন ইউরোর প্রতিদানে ৪ গোল আর ৪ অ্যাসিস্টের বাইরে বার্সাকে দিতে পারেননি কিছুই, এমনকি ২০০১ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে লিভারপুলে পাড়ি জমিয়েছিলেন ফ্রি ট্রান্সফারে।
দলে নবাগত কারও গায়ে ১০ নম্বর জার্সি তুলে দিলে তা বোঝা হয়ে যাচ্ছে ভেবেই খুব সম্ভবত, বার্সেলোনা এরপর নম্বরটা তুলে দিয়েছিল অভিজ্ঞ একজনের হাতে। সাড়ে ২৩ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সায় রিভালদো এসেছিলেন ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে, পরের দুই মৌসুমে ১১ নম্বর জার্সি পরে করেছিলেন ৫৭ গোল।
তবে রিভালদো বার্সেলোনায় নিজের সেরা সময়টা কাটিয়েছিলেন ১০ নম্বর জার্সি পরেই। ২০০০-০১ মৌসুমে করেছিলেন ৫৩ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ৩৬ গোল। বার্সেলোনাকে অবশ্য সেরা তিনে রাখতে পারেননি সেবারও, তবে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো হ্যাটট্রিক করে বার্সাকে চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকিট এনে দিয়েছিলেন ঠিকই।
বার্সেলোনায় তাঁর থাকার কথা ছিল আরও দুই মৌসুম। তবে লুই ফন হালের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো ছিল না তাঁরও, আর মাঝে দু'বছরের বিরতির পর ২০০২ সালে ফের বার্সা ডাগআউটে ফেরেন ফন হাল। যে কারণে চুক্তির এক বছর বাকি থাকতেই বার্সেলোনা ছেড়ে যান রিভালদো।
ব্রাজিলিয়ানের রেখে যাওয়া ব্যাটনটা উঠেছিল এক আর্জেন্টাইনের হাতে। নামের আগে 'নতুন ম্যারাডোনা' তকমা জুটেছিল খেলোয়াড়ি জীবনের শুরুতেই, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ১০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বোকা জুনিয়র্স থেকে বার্সেলোনায় এসেছিলেন হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে। তাঁকে ঘিরে সমর্থকদের প্রত্যাশার পারদও ছিল আকাশচুম্বী, কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্সে পূরণ করতে পারেননি সেই প্রত্যাশার সিকি ভাগও। যার পেছনে কোচ লুই ফন হালের দায়ও কম নয়। তাঁর মতো মিডফিল্ডারকে উইংয়ে খেলিয়ে কি আর সেরাটা পাওয়া যায়?
বার্সেলোনায় তিন বছরের জন্য এলেও খেলেছিলেন মাত্র এক মৌসুমই। সেই মৌসুমটাই খেলেছিলেন ১০ নম্বর জার্সি পরে, ৪২ ম্যাচে করেছিলেন ৬ গোল আর ৯ অ্যাসিস্ট। এমন মলিন পারফরম্যান্সের পরে ধারে চলে যেতে হলো ভিয়ারয়ালে, নিজেকে ফিরে পেয়েছিলেন সেখানেই। আর বার্সেলোনা তাঁর রেখে যাওয়া জার্সিটা তুলে দিয়েছিল রোনালদিনহোর হাতে। প্যারিস সেন্ট-জার্মেইতে আলো ছড়িয়ে ৩২.২৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যিনি এসেছিলেন বার্সায়।
এক অর্থে বার্সেলোনার সঙ্গে ১০ নম্বর জার্সির আড়ি ভেঙেছিল রোনালদিনহোকে দিয়েই। তাঁকে বার্সার ভাগ্য বদলের কারিগর বললেও অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না। তাঁর আগমনের ঠিক আগের মৌসুমেই বার্সেলোনা তাদের লা লিগা অভিযান শেষ করেছিল ষষ্ঠ অবস্থানে থেকে। ওই বার্সাকেই পরের পাঁচ বছরে জিতিয়েছিলেন দুটা লা লিগা আর একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ। ২০৭ ম্যাচ খেলে করেছেন ৯৪ গোল, সঙ্গে গোল করিয়েছেন ৭১টি। বার্সেলোনাকে ২০০৫ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর বছরে নিজে জিতেছেন ব্যালন ডি'অরও। অবশ্য এসব নিরেট সংখ্যা দিয়ে বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। পায়ের জাদুতে যে লক্ষ-কোটি দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন, তা কি আর সংখ্যার নিক্তিতে মাপা যায়?
তবুও রোনালদিনহো বার্সার ইতিহাসের সেরা 'নম্বর টেন' হতে পেরেছেন কই? ২০০৮ সালে রোনালদিনহো এসি মিলানে চলে গেলে জার্সিটা ফের উঠেছিল এক আর্জেন্টাইনের গায়ে। পরের ১৩ বছরে পৃথিবী বদলেছে অনেকটাই। অন্য গ্রহের দল থেকে ৮-২ ব্যবধানে পরাজিত দল...বার্সেলোনাও কম পালাবদল দেখেছে নাকি! শুধু ধ্রুব ছিল একটা সত্যই। বার্সেলোনার ১০ নম্বর জার্সিটা বাঁধা ছিল লিওনেল মেসির জন্যই।
ফাতির কাজটা যে ভীষণ দুরূহ হয়ে উঠেছে শুরুর আগেই, সেটা ওই ৫ ফুট সাড়ে ৬ ইঞ্চির জাদুকরের কারণেই। ফাতিও নিশ্চয়ই জানেন, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, পান থেকে চুন খসলেই তুলনাটা চলে আসবে আপনা-আপনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চকিতেই সত্য হয়ে নেমে আসবেন বার্সেলোনা সমর্থকদের মুখে, 'কতবার কত মুখ দেখিয়া মনে হইয়াছে, বুঝি কিছু কিছু মেলে; বুকের মধ্যে রক্ত দ্রুত বহিয়াছে, তার পরে দেখা যায়-- কণ্ঠস্বরে ঠিক মিল নাই, নাকের ডগার কাছটা অন্যরকম।'