পেলেকে পেরিয়ে কেঁদে ভাসালেন পুলগা
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
১১ সেপ্টেম্বর ২০২১
লিওনেল মেসিরা অতীতবিলাসী নন, বর্তমানেই বাঁচতে আগ্রহী। তাই, যে দিন উৎসবে মেতে উঠবেন, সে দিনটাকে আরও রঙিন করে তুললেন পেলেকে গোলসংখ্যায় পেরিয়ে! সেটিও এক-দুই গোলে নয়, হ্যাটট্রিক করে।
তিনি কাঁদলেন। কেঁদে ভাসালেন। হাসালেনও!
কাঁদলেন, কারণ, ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনাকে এনে দিলেন ট্রফি। তা-ও আবার মারাকানা থেকে! চিরশত্রুর দেশে, চিরশত্রুর বুকের ওপর থেকে, পাঁজর খুলে এনে। কোপা আমেরিকা জিতেছিল আর্জেন্টিনা, ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে। সেই ট্রফিটা তুলে ধরলেন এস্তাদিও মোনুমেন্তাল-এ, একুশ হাজারের গ্যালারির সামনে। সেই আর্জেন্তিনীয় ভক্তরা যারা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সমালোচনায় মুখর হতো, ধিক্কারে ভরিয়ে দিত; সেই আর্জেন্টিনিয়ান সাংবাদিক, ফুটবল-লেখক, ধারাভাষ্যকারদের সামনে তুলে ধরলেন ট্রফি, কাঁদতে কাঁদতে। আর বলে গেলেন, ‘ওই যে, মা আছেন এখানে। এই গ্যালারিতে আছে আমার ভাইবোনেরা। ওরা সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। আমিও খুব খুশি। বহু দিন, বহু বছর অপেক্ষা করেছিলাম এই মুহূর্তটার জন্য, স্বপ্ন দেখেছিলাম।’
কিন্তু সে তো পুরনো কৃতিত্ব নতুন করে মনে পড়িয়ে-দেওয়া। লিওনেল মেসিরা অতীতবিলাসী নন, বর্তমানেই বাঁচতে আগ্রহী। তাই, যে দিন উৎসবে মেতে উঠবেন, সে দিনটাকে আরও রঙিন করে তুললেন পেলেকে গোলসংখ্যায় পেরিয়ে!
দক্ষিণ আমেরিকার পুরুষদের ফুটবলে এত দিন পেলেই ছিলেন দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৭৭ গোলের মালিক। বলিভিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম গোল করে ব্রাজিলের কিংবদন্তিকে ছুঁয়ে ফেলেছিলেন মেসি, দ্বিতীয় গোলে পেরিয়ে গেলেন, তৃতীয় গোলে এল আলবিসেলেস্তে জার্সিতে সপ্তম হ্যাটট্রিক। আপাতত ১৫৩ ম্যাচে ৭৯ গোল তাঁর। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিশ্বরেকর্ড ১১১ গোলের চেয়ে ৩২ পেছনে। আর, ব্রাজিলের দুই মহিলা মার্তা (১০৯) ও ক্রিস্তিয়ানে (৯৬) এগিয়ে রয়েছেন লাতিন আমেরিকার ফুটবলার হিসাবে সর্বোচ্চ গোলের তালিকায়, মেসিকে তৃতীয় স্থানে রেখে।
ইতিহাস লিখে পেলে-কে ছোঁয়া এবং পেরিয়ে যাওয়ার দুটি গোল যথারীতি বাঁধিয়ে রাখার মতোই।
মেসিকে 'লা পুলগা' বলা হয়। স্পেনীয় শব্দের অর্থ মাছি। ছোট চেহারা আর ধরতে চেয়েও ধরা যায় না, এই দুটি মিলের কারণে। সেই ‘পুলগা’ সর্বশ্রেষ্ঠ পেলেকে ছুঁয়েছিলেন যে-গোলে, বল ধরেছিলেন নিজের গোলের দিকে মুখ করে। বল ধরলেন, ঘুরলেন, সামনে একেবারে গায়ের ওপরে এক ডিফেন্ডার। সহজ নাটমেগ, মানে পায়ের তলা দিয়ে বল গলিয়ে দেওয়া। তারপর দেখা গেল, সমান্তরাল সরলরেখায় মেসির সামনে তিন সবুজ জার্সিধারী, পেছনেও তিন। মাঝখানে দাঁড়েয়ে তিনি তাই-ই করলেন, যা করতে সিদ্ধপদ। বাঁ পায়ে নিখুঁত তুলে দিলেন বলিভিয়ার গোলরক্ষকের ডানদিকের জালে। প্রক্রিয়া এতটাই সহজাত যে, মনে হবে কত সহজ। একবার পায়ে বল নিয়ে দেখবেন নাকি!
পেলেকে পেরোলেন যে-গোলে, লাউতারো মার্তিনেজের সঙ্গে বক্সে দুবারের ওয়ান-টু মনে তো থাকবেই, শট নিয়েছিলেন বাঁ পায়ে। সামনের ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে ফিরতি বল মেসির ডান পায়ে এবং অনভ্যাসের ডান পায়েই বল রেখে দেন আবারও বিমূঢ় বলিভিয়া গোলরক্ষকের ডানদিকে!
তৃতীয় গোলটা রিবাউন্ড থেকে হলেও, বলিভিয়ার গোলরক্ষক উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন শুধু নয়, ডান পা দিয়ে ফার্স্ট পোস্ট কভারও করেছিলেন। ছড়ানো ডান হাত আর ডান পায়ের মাঝের ফাঁকটুকু মেসির পায়ে কী করে যেন ধরা পড়েই যায়। সেই কারণেই হয়ত বিপক্ষের যে ফুটবলার হ্যাটট্রিক করলেন তাঁর বিপক্ষে, বলিভিয়ার গোলরক্ষক খেলা শেষে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন জড়িয়ে ধরে। এই পরাজয়ে যে মালিন্য নেই কোথাও!
ম্যাচটা দেখে থাকলে আরও একটা গোল মনে রাখার মতোই ছিল, যা সঙ্গত কারণেই অফসাইড বলে বাতিল। মেসি পাস দিয়েছিলেন ডি মারিয়াকে। ২৮ বছর পর আন্তর্জাতিক ট্রফি এসেছিল আর্জেন্টিনার যাঁর গোলে, মেসির সেই পিএসজি-সতীর্থ বাঁ পায়ের আউট স্টেপ দিয়ে বলটা রেখেছিলেন এত চমৎকার যে, মন ভরে গিয়েছিল। কিন্তু তারও আগে চমক লাউতারোর। ঠিক বেরিয়ে এসে দুর্দান্ত পায়ে-বলে করলেন। এমন গতিতে, কী করে সহকারী রেফারি তার মধ্যেও অফসাইডটা ঠিক ধরে ফেললেন, আশ্চর্য দক্ষতা তো বটেই, তিনি নিজের জায়গায় ‘মেসির মতো’ বললেও এক ফোঁটা অত্যুক্তির সম্ভাবনা নেই।
Lionel Messi finally got to celebrate the Copa America victory with the Argentinian people, and it all got a bit too much pic.twitter.com/cP7nZFOc0X
— Mirror Football (@MirrorFootball) September 10, 2021
খেলা শেষে এল চোখের জলে ভিজিয়ে দেওয়ার পালা। ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা জয় আর ব্রাজিলের পেলেকে পেরিয়ে যাওয়ার আনন্দে চোখে যদি জল না আসে তো খেলা কেন! এই পবিত্র আবেগটা, এই শিশুর সরলতা আবার পেশাদারের চূড়ান্ত দক্ষতা একসঙ্গে মিশে থাকে বলেই তো তিনি সমকাল ছেড়ে সর্বকালের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করেছেন সেই কবে থেকে, এখনও হাঁটছেন, আগামীতেও হাঁটবেন।
আমরা সেই রাস্তার দুধারে জমায়েত জনতা। হাততালি দেব, লাফিয়ে উঠব, কখনও আবার সেই পেপ গার্দিওলার ভাইরাল হয়ে-যাওয়া ভিডিওটার মতো, মুখ ঢাকব হাত তুলে, বিস্ময়ে