মেসিকে পেয়ে পিএসজির অন্য লাভ-১
অ্যাডাম ক্রাফটন
৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
লিওনেল মেসি মাঠে কী করতে পারেন, তা তো সবাই দেখতেই পান। মাঠের বাইরেও কি মেসি ক্লাবের জন্য কম লাভের নাম! মেসিকে পেয়ে পিএসজির লাভটা কোথায় কোথায় হবে, তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে `দ্য অ্যাথলেটিক`। উৎপলশুভ্রডটকম-এর পাঠকদের জন্য এরই অনূদিত রূপ।
সাল ২০১৮। ইউরোপে তখন গ্রীষ্মকাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্যারিস সেন্ট-জার্মেইর (পিএসজি) বাণিজ্যিক দিকটার দায়িত্বে ছিলেন ব্রেট হার্টম্যান। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পিএসজির জনপ্রিয়তা নিয়ে হার্টমানের বলছিলেন, 'আমরা হিসাব করে দেখছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্র্যান্ড হিসেবে পিএসজি কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ সে সময় পুরো ম্যানহাটনে এমন কোন স্টোর ছিল না, যেখানে পিএসজির জার্সি দেখা যেত। পিএসজির কোনো পরিবেশকই ছিল না।'
কিন্তু এখন ব্যাপারটা বদলে গেছে ১৮০ ডিগ্রি। কারণটা আপনি অনুমান করতেই পারেন। নয়তো শুনতে পারেন হার্টম্যানের মুখেই, 'এখন আমাদের সাথে আছে লিওনেল মেসি। আপনি ভাবতেও পারবেন না, ব্যবসার জন্য এটা কত বড় সুযোগ।'
মাঠের খেলায় যা-ই হোক না কেন, বাণিজ্যের ময়দানে মেসি যে লক্ষ্মী ,সেটা কার না জানা! কত খরচ করে মেসিকে প্যারিসে আনা হলো, সেটা বিবেচনাতেই নেওয়ার দরকার নেই, কারণ মেসির পেছনে খরচ মানেই সেটা উল্টো লাভজনক বিনিয়োগ। বার্সেলোনার সভাপতি হুয়ান লাপোর্তা যেমন বলছিলেন, 'মেসি বেতন-বোনাস মিলে ক্লাব থেকে যা নেয়, তার কয়েক গুণ রাজস্ব আদায় করে দেয়। বার্সেলোনা প্রতি মৌসুমে যা আয় করে, তার তিন ভাগের এক ভাগ আসে মেসির প্রভাবে।'
মেসির সাথে পিএসজির চুক্তিটা ঠিক কত টাকার? যতটুকু জানা যাচ্ছে, দুই বছরের চুক্তিতে পিএসজিতে যোগ দেওয়ার জন্য মেসি সাইনিং বোনাস পেয়েছেন ২৫ মিলিয়ন ইউরো। আর প্রতি মৌসুমে তাঁর মাইনে হবে আরও ২৫ মিলিয়ন ইউরো। তো সাইনিং মানিসহ দুই বছরের বেতন-বোনাস মিলিয়ে আয়টা ছুঁতে পারে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করলে মোটামুটি মাথা খারাপ হয়ে যাবার দশা হয়, তারপরও কিছুটা ধারণা দেওয়া যাক। এই দুই মৌসুমে মেসি যদি পিএসজির হয়ে ১২০টি ম্যাচ খেলেন, তাহলে ম্যাচ প্রতি তাঁর আয় হবে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা। রসিকতা করে কেউ কেউ তাই বলতেই পারেন, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও প্রতি ঘণ্টায় মেসি প্রায় ৬ লাখ টাকা কামান!
চোখ কপালে তুলে দেয়া এমন সব অঙ্ক কিন্তু সন্দেহের অবকাশও তৈরি করে। চাইলেই কি ইচ্ছামতো খরচ করে ক্লাব চালানো যায়? উত্তর হলো, না, চালানো যায় না। উয়েফার অধীনে থাকা সকল ক্লাব উয়েফার 'ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে নীতিমালা' মেনে চলতে বাধ্য, যেটির মূল কথা হলো একটা ক্লাবের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
আধুনিক ইউরোপীয় ফুটবল মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেরদের মনোরঞ্জনের এবং বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান সুযোগ। সেই সুবাদে ফুটবলে 'ডার্টি মানি' ঢুকে পরার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এই বিষয়টাও উয়েফার আর্থিক শৃঙ্খলা নীতিমালার আওতায় আসে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, একই সাথে মেসি, নেইমার, এমবাপ্পে, ডি মারিয়া, রামোস, ইকার্দি, মার্কিনহোস, ভাইনালদুম অথবা ভেরাত্তিকে উচ্চ বেতন দিয়েও কিভাবে পিএসজি উয়েফার আর্থিক শৃঙ্খলা নীতিমালা মেনে চলতে পারছে?
ফুটবল ক্লাবগুলোর আয়-ব্যয় নিয়ে হিসাব করেন, এমন বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন ২০১৯-২০ মৌসুমে খেলোয়াড়দের বেতন-বোনাস মিলে পিএসজির ব্যয় ছিল ৪১৪ মিলিয়ন ইউরো, যেটি ফ্রেঞ্চ লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরচ করা ক্লাব অলিম্পিক লিওঁর চেয়েও প্রায় তিন গুণ বেশি। তবে এক বছরে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪১০০ কোটি টাকা বেতন-বোনাস দেয়ার পরও পিএসজি ইউরোপের শীর্ষ খরুচে ক্লাব ছিল না। এই রেকর্ডটা ছিল বার্সেলোনার।
তবে শুধু ২০১৯-২০ মৌসুমটা না ধরে হিসাবটা এর তিন বছর আগে থেকে করতে শুরু করুন; দেখবেন ২০১৬-১৭ মৌসুম থেকে হিসাব করলে পিএসজি ইউরোপের অষ্টম সর্বোচ্চ খরুচে ক্লাব। এই তিন বছরে সবচেয়ে খরুচে ক্লাবের প্রথম চার নাম: বার্সেলোনা (৯৬০ মিলিয়ন ইউরো), চেলসি (৭৫৮ মিলিয়ন ইউরো), ম্যানচেস্টার সিটি (৬৭৮ মিলিয়ন ইউরো) এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (৬০৪ মিলিয়ন ইউরো)।
পিএসজির অর্থ সাশ্রয়ের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল গত মৌসুমে থিয়াগো সিলভা আর এডিনসন কাভানিকে বিক্রি করে দেওয়া, সেখান থেকে বাঁচানো অর্থটা তারা কাজে লাগিয়েছে এই মৌসুমে। আর আর্থিক শর্ত ভঙ্গের আশঙ্কা তৈরি হলেও পিএসজির হাতে তৈরি আছে ঝটপট দুই মিনিটে তৈরি ম্যাগি নুডুলসের মতো একটা বিকল্প। সেটা কিলিয়ান এমবাপ্পে। তরুণ এই ফরাসির দিকে মাদ্রিদ চাতক পাখির মতো তাকিয়ে ছিল, এমনকি ২০০ মিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত খসাতে রাজি ছিল। কিন্তু পিএসজি রাজি হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে, আর্থিক বিধি-নিষেধের কোন শঙ্কা প্যারিসের ক্লাবটিকে করতে হচ্ছে না।
এটা ঠিক যে, কোভিড-১৯ এর কারণে প্রতিটা ক্লাবই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, নাসের আল খেলাইফি এমনভাবে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যটা বজায় রেখেছেন যাতে এমবাপ্পেকে ক্লাবে রেখেও পিএসজি আর্থিক নীতির শর্ত পালন করে যেতে পারবে। কারণ রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা কিংবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো বিশাল অঙ্কের দেনা পিএসজির নেই। জানিয়ে রাখা ভালো, এই মুহূর্তে বার্সেলোনার দেনা ১.৩ বিলিয়ন ইউরো।
খেলাইফি যে কত বড় ‘খেলোয়াড়’, তার আরেকটা উদাহরণ দেখুন। তেল বিক্রির বেশুমার অর্থ ক্লাবে ঢোকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উয়েফা যে আর্থিক নীতিমালার সূচনা করেছিল সেই উয়েফাই এখন নীতিমালা শিথিল করে ক্লাবগুলোতে ধনকুবেরদের বিনিয়োগকে আহ্বান জানাচ্ছে। আর এটার পেছনে বড় অবদান আছে পিএসজি চেয়ারম্যান নাসের আল খেলাইফির, যিনি একই সাথে উয়েফা এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য এবং ইউরোপিয়ান ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন (ECA)-এর সভাপতি। বিদ্যমান আইনে ক্লাবের আয়ের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় অনুমোদিত। নীতিমালা শিথিল করার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তাতে বলা আছে, ৭০%-এর অধিক ব্যয় করলে ক্লাবগুলোকে একটা 'লাক্সারি ট্যাক্স' বা বিলাস সামগ্রী ক্রয় কর দিতে হবে। আর সেটা পরিশোধ করতে পারলেই ক্লাবগুলোকে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে না। মূলত করোনাকালীন আর্থিক লোকসান পোষানোর জন্য ক্লাবগুলোতে ধনকুবেরদের অর্থ বিনিয়োগের পথ সুগম করতেই উয়েফা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এই নীতিতে খেলাইফির মতো ধনকুবেরদের জন্য একেবারে পোয়াবারো।তবে মেসিকে কেনার পর মেসির জার্সি বিক্রি করেই পিএসজির খরচ পুষিয়ে গিয়েছে, এমন ধারণাটাও কিন্তু সত্যি নয়। গত মৌসুমে পিএসজির অফিসিয়াল স্টোর থেকে মোট জার্সি বিক্রি হয়েছিল প্রায় ১০ লক্ষ পিস। মেসি আগমনের কারণে সেটা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন পিএসজির মার্কেটিং ডিরেক্টর ফ্যাবিয়েন অ্যালেগ্রি। তাছাড়া জার্সি বিক্রি করে ক্লাবের রাজস্ব বৃদ্ধির কাজটাও সহজ নয়। কারণ জার্সি বিক্রি করে আয় করে মূলত ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ ক্রীড়া সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো (নাইকি, অ্যাডিডাস, পুমা ইত্যাদি)। এক্ষেত্রে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের একটা ক্লাবের উদাহরণ দেয়া যায়। কিট প্রস্তুতকারক কোম্পানির সাথে ক্লাবের চুক্তিটি এমন যে, অন্তত সাড়ে চার কোটি জার্সি বিক্রি না হলে ক্লাবের সাথে রাজস্ব ভাগাভাগি হবে না, পুরোটাই পাবে কিট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। পিএসজির জার্সি প্রস্তুতকারক নাইকি। চুক্তিটি ২০৩২ সাল পর্যন্ত এবং প্রতি বছর পিএসজির আয় ৮০ মিলিয়ন ইউরো।
পিএসজির জার্সি স্পন্সর হলো এক্যর নামক একটা হসপিটালিটি গ্রুপ, যাদের কাছ থেকে পিএসজি'র আয় বছরে ৫০ মিলিয়ন ইউরো। ক্লাবের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গেলে দেখা মিলবে এমন আরও ১১টি প্রিমিয়াম পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের নাম, যাদের ৬টিই কাতারভিত্তিক। আছে অরেঞ্জ, ইএ স্পোর্টস, নিভিয়া, ভিজিট রুয়ান্ডা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান।
মেসির আগমনের পর এসব পৃষ্ঠপোষকদের সাথে চুক্তির কলেবর আরও বাড়ানোর কাজ করছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া ক্লাবের ভক্তদের মধ্যে ফ্যান টোকেন স্কিমের আওতায় ১৫ মিলিয়ন ইউরো আয় হয়েছে ইতোমধ্যে। ব্রেট হার্টম্যানের মতে, সুযোগ আছে মেসিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ফেস্টিভাল বা ইভেন্ট আয়োজন করে আরও স্পন্সর বাগিয়ে নেওয়ার। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাইনিংকে কেন্দ্র করে জুভেন্টাস বাড়তি আয় করেছিল প্রায় ৪৩ মিলিয়ন ইউরো। ধারণা করা যাচ্ছে, মেসিকে ঘিরে পিএসজি বাণিজ্যিক পরিকল্পনাও প্রায় একই রকম।
চলবে...
'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর: আজহারুল ইসলাম
আরও পড়ুন:
দ্বিতীয় পর্ব: মেসিকে পেয়ে অন্য লাভ-২
তৃতীয় পর্ব: মেসিকে পেয়ে অন্য লাভ-৩