রোনালদোর ইউনাইটেডে প্রত্যাবর্তন: কার কতটা লাভ?
দ্য অ্যাথলেটিক
৩০ আগস্ট ২০২১
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ফিরেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে, নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক বিরতির পরের ম্যাচ দিয়ে তাঁর খুব সম্ভবত অভিষেকও হয়ে যাবে। কিন্তু এই দলবদলে রোনালদোর কি কোনো লাভ হলো? নাকি কেবল ইউনাইটেডই জিতল? তাঁকে না পেয়ে সিটির কি পুরোটাই ক্ষতি? উত্তর পাবেন `দ্য অ্যাথলেটিক` থেকে ভাষান্তরিত এই লেখায়।
রূপকথার রাজা শেষ দানে আবার ফিরে আসছেন হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফিরে আসাটাকে কি এভাবে দেখা যায়?
খালি চোখে সহজেই বোঝা যায়, রোনালদো ইউনাইটেড ছেড়ে যাবার পর প্রায় এক যুগে প্রিমিয়ার লিগের অনেক কিছুই বদলে গেছে। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন অবসর নিয়েছেন আর নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্বে পেপ গার্দিওলা। আর চাকাটা একটু অন্যদিকে ঘুরে গেলেই দেখা যেত, চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদোর কোচ হয়ে পেপ গার্দিওলা পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন লিওনেল মেসির বিপক্ষে!
রোনালদোর ইউনাইটেডে যোগ দেয়াটাকে অনেকেই যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাধান্য হিসেবে দেখছেন। একবার কল্পনা করুন তো, সামনের ১১ সেপ্টেম্বর নিউক্যাসলের বিপক্ষে যে ম্যাচটিতে রোনালদোর দ্বিতীয় অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে, সেটা কেমন হতে পারে। বিখ্যাত লাল জার্সিটা গায়ে রোনালদো যখন মাঠে নামছেন তখন গ্যালারিটা কি রকম উন্মাতাল হয়ে উঠছে! ইউনাইটেড পেনাল্টি কিংবা বক্সের বাইরে বিপদজনক জায়গায় ফ্রি-কিক পেলে কার সাধ্যি রোনালদোর কাছ থেকে বলটা কেড়ে নেয়!
২০০৩ সালে রোনালদোর প্রিমিয়ার লিগে অভিষেকের ছবিটা মনে আছে? ম্যাচটা ছিল বোল্টন ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে, রোনালদোর চুলে জেল দেয়া, দাঁতে ব্রেস পরা আর কপালে ছোট্ট ফুসকুড়ি। প্রথম ম্যাচটা যারা দেখেছিলেন, তারা কি করে ভুলবেন রোনালদোর সেই পায়ের জাদু? ফুটবল-রাজ্য নতুন রাজার আগমনের বার্তা পেয়েছিল সেই দিনই। প্রায় চার বছর পর সেই একই বোল্টনের বিপক্ষে এক ম্যাচে রোনালদো এমনই অবিশ্বাস্য খেলছিলেন যে, ম্যাচ শুরুর মাত্র ২৮ মিনিট পর বোল্টন কোচ স্যাম অ্যালারডাইস বাধ্য হন দলের সেন্টার ব্যাক হেনরিক পেডারসনকে মাঠ থেকে উঠিয়ে নিতে। ম্যাচ শেষে এক সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করলেন পেডারসন মানসিকভাবে কতটা ধাক্কা খেয়েছেন, তখন অ্যালারডাইস উত্তর দিলেন, 'মানসিক চোট? ওর যা অবস্থা তাতে প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা বদলে না ফেললে ওর রেহাই নেই।'
৩৬ বছর বয়সী রোনালদো এখন নিশ্চয়ই আর সেই রোনালদো নন। সেই একই পা জোড়া থেকে ছুটে আসা শটগুলো আগের মতো আর লক্ষ্যভেদী নয়। আগের মতো একক প্রচেষ্টায় প্রতিপক্ষকে ছিটকে ফেলা ড্রিবল যেমন দেখা যায় না, তেমনি রোনালদোর পায়ে বল যাওয়া মাত্রই গ্যালারির নড়েচড়ে বসাটাও এখন নিয়মিত দৃশ্য নয়। তারপরেও ইউনাইটেড সমর্থকেরা দুই হাত বাড়িয়ে রোনালদোকে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। একদিকে যেমন রোনালদোর ক্যারিয়ার সাঁঝবেলায়, অন্যদিকে ফার্গুসনের বিদায়ের পর থেকে ইউনাইটেডও পথ হারিয়ে বিভ্রান্ত। রূপকথার রাজা ফিরে এসে রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রজাদের মন-সিংহাসনে চিরস্থায়ী আসন পেতে নেবেন, এই আশা করতে দোষ কোথায়? ইতিহাস তো বলছে, যখনই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন বা অহমে আঘাত লেগেছে, তখনই নিজের সেরাটা দিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
আবেগের কথা তো অনেক হলো, এবার যুক্তির কথায় আসা যাক। সেরা খেলোয়াড়েরা সতীর্থ হিসেবে সমপর্যায়ের খেলোয়াড়দের পাশে খেলতে চাইবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। সেই যুক্তিতে কি ইউনাইটেডের বদলে সিটিকে পছন্দ করা রোনালদোর জন্য যৌক্তিক ছিল না? ক্যারিয়ারের শেষের শুরু না হলে কি রোনালদো সেটাই করতেন? দল হিসেবে এ মুহূর্তে ইউনাইটেডের চেয়ে সিটি অবশ্যই শ্রেয়তর। প্রিমিয়ার লিগের গত পাঁচ মৌসুমের রেকর্ড তো বলছে ইউনাইটেডের চেয়ে সিটি মৌসুম প্রতি গড়ে ১৭.৪ পয়েন্ট বেশি অর্জন করেছে।
তবে রোনালদো সিটিতে যাচ্ছেন, এরকম খবর ছড়ানোর পর ইউনাইটেড সমর্থকরা যেভাবে ‘বিশ্বাসঘাতক’ টাইপের গালমন্দ করা শুরু করেছিলেন, সেটা থেকে নিশ্চিতভাবেই তিনি বেঁচে গেলেন। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় ইউনাইটেড সমর্থকদের কাছে ভালোবাসা পেয়ে শেষ বেলায় তাদের কাছ থেকেই নিন্দামন্দ শুনতে তাঁর নিশ্চয়ই খারাপ লাগত। তাছাড়া সিআরসেভেন ব্র্যান্ডের জন্যও এটা জরুরি ছিল। প্রিয় তারকাকে প্রায় অর্ধ যুগ লাল আর সাদা জার্সিতে দেখে অভ্যস্ত রোনালদো-ভক্তরা সিটির আকাশি নীল রঙে তাদের 'সিআরসেভেন'-কে কতটুকু সাদরে গ্রহন করতেন, কে জানে?
তবে সত্যটা হলো রোনালদো ম্যান সিটিতে যোগ দেবার ব্যাপারে অনেকটাই রাজি ছিলেন। যদি এমনটা হয় যে, সিটির প্রতি রোনালদোর দেখানো আগ্রহটা ছিল ইউনাইটেড ভক্ত এবং কর্তৃপক্ষকে কিছুটা উসকে দেয়ার জন্য, তাহলে বলতেই হবে বুদ্ধিটা দারুণ কাজ করেছে। সেই সাথে আমরা এটাও দেখলাম যে, অবসর নেওয়ার আট বছর পরও স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ভীষণ প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন।
ইউনাইটেড কোচ ওলে গানার সুলশার অবশ্য যুক্তির চেয়ে আবেগটাই বড় করে দেখলেন, 'অবশ্যই এখানে সবাই পেশাদার, কিন্তু ইউনাইটেডে খেলেছেন এমন কেউ সিটিতে খেলতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক।' গুরু ফার্গুসনও নিশ্চয়ই শিষ্যের সিটিতে যাওয়ার গুঞ্জন শুনে ফোনে বাংলা ছবির অভিমানী মুরুব্বির মতো বলেছেন, '... যদি যাস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি!'
তবে কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েও শেষ পর্যন্ত রোনালদোকে না পাওয়ায় সিটি যে মুখ ভার করে বসে আছে, এমনও কিন্তু না। হ্যারি কেন আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো দুজন জাত স্ট্রাইকার যেকোনো দলের জন্যই বিশাল সম্পদ বলে গণ্য হবেন। তবে টেকো মাথার গার্দিওলাও দেখিয়ে দিয়েছেন, প্রথাগত স্ট্রাইকার ছাড়াই তিনি লিগ শিরোপা জিততে পারেন। গার্দিওলার দল এবারও লিগের প্রথম ৩ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১০ গোল করে ফেলেছে, স্কোর শিটে নাম লিখিয়েছেন আট জন। তাই গোল করাটা এখনো পর্যন্ত সিটির মাথাব্যথার তালিকায় নেই।
অন্যদিকে রোনালদোকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেও সুলশার পড়ে যাচ্ছেন মধুর সমস্যায়। আক্রমণে রোনালদোকে কেন্দ্রে রেখে কাভানি, গ্রিনউড, রাশফোর্ড, সাঞ্চো, মার্শিয়াল আর ব্রুনো ফার্নান্দেজের মধ্যে কাকে বসিয়ে কাকে এবং কিভাবে খেলাবেন-- এটাই এখন তাঁর বড় দুশ্চিন্তা। পর্তুগাল সতীর্থ ব্রুনো ফার্নান্দেজ ফোনে রোনালদোকে সিটির বদলে ইউনাইটেডে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন বলে শোনা যায়। দেখা গেল, রোনালদোকে একাদশে জায়গা করে দিতে কোচ ব্রুনো ফার্নান্দেজকেই বেঞ্চে বসিয়ে রাখছেন। জাতীয় দলের ক্ষেত্রে এমনটাই করে আসছেন পর্তুগাল কোচ ফার্নান্দো সান্তোস।
এসব নিয়ে অবশ্য রোনালদোর মাথা না ঘামালেও চলবে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে তুরিনে খেলতে গিয়ে যে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা তিনি গ্যালারি থেকে পেয়েছিলেন, সেই টানেই তো পরে মাদ্রিদ ছেড়ে চার বছরের জন্য তুরিনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু তিন বছর পর সেখানে যেমন তাঁর মন বসছিল না, তেমনি জুভেন্টাস কর্তৃপক্ষও লাভ-ক্ষতির হিসেব মেলাতে গিয়ে হতাশ। এদিকে ইউনাইটেড-রোনালদো পুনর্মিলনের সব সময়ই একটা সম্ভাবনা ছিল। সেই ডেভিড ময়েসের আমল থেকেই ভেসে আসা গুঞ্জনটা এত দিনে বাস্তব হলো।
রোনালদো ক্লাবে ফেরায় ইউইনাইটেড সমর্থকরা তাই একটা ব্লকবাস্টার মুভির সিকুয়েল টু-এর আশা করতেই পারে, যদিও মুভির নায়ক আগের মতো তেজোদ্দীপ্ত নেই আর। তারপরও নামটা যখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তখন মিরাকল দেখার প্রত্যাশা কি বাঁধ মানে নাকি?
*'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর: আজহারুল ইসলাম