এমবাপ্পে অফসাইড, এমবাপ্পে অফসাইড না
উৎপলশুভ্রডটকম
১১ অক্টোবর ২০২১
দারুণ এক ফাইনালে স্পেনকে হারিয়ে বিশ্বকাপের সঙ্গে উয়েফা নেশনস লিগের ট্রফিটাও যোগ করে নিয়েছে ফ্রান্স। ফুটবলের যা কিছু সুন্দর, তা তো ছিলই এই ফাইনালে, সঙ্গে একটু বিতর্কও। জয়সূচক গোলটা করার সময় এমবাপ্পে অফসাইড ছিলেন বলে স্পেনের দাবি। তাহলে রেফারির মতো ভিএআর-ও কেন গোলটিকে বৈধ বলছে?
ফ্রান্স যখন আরেকটি ফেরার গল্প লিখে উয়েফা নেশনস লিগে প্রথম শিরোপা জয়ের উৎসব করছে, স্পেন তখন রাগে ফুঁসছে। লা রোজাদের বিশ্বাস, রেফারি অ্যান্থনি টেলর ভুল করেছেন। বিরাট ভুল। সেই ভুলের চরম মূল্য স্পেনকে দিতে হয়েছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লা ব্লুজদের তাতে কিছু আসে যায় না। প্রথমবারের মতো নেশনস লিগে চ্যাম্পিয়ন, যেটি যোগ হয়েছে বিশ্বকাপ শিরোপার সঙ্গে। ফরাসিদের উৎসব বাঁধ মানবে কেন? তবে সেই উৎসবে একটু বিতর্কও সঙ্গী হয়ে রইল।
ঘটনা খেলা শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট আগের। সেই ঘটনায় যাওয়ার আগে পরিস্থিতিটা একবার আলোচনা করে নেওয়া যাক। ইতালির সান সিরোতে নেশন লিগের ফাইনালে ফ্রান্স-স্পেন ফাইনালের প্রথমার্ধটা ছিল ম্যাড়মেড়ে। কিন্তু ৬০ মিনিট খেলা পেরুনোর পর হঠাৎই যেন কেউ সোনার কাঠি-রুপার কাঠি অদলবদল করে প্রাণ সঞ্চার করল ম্যাচে। ওইয়ারজাবালের গোলে স্পেন এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বেনজেমা তা শোধ করে দিলেন। ৮০ মিনিটে স্টেপ ওভারে গোলকিপারকে বিভ্রান্ত করে কিলিয়ান এমবাপ্পের গোল ২-১-এ এগিয়ে দিল ফ্রান্সকে। ওই স্কোর লাইনেই ফ্রান্স হয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন। বিতর্কও এমবাপ্পের ওই গোল নিয়েই। মানে জয়সূচক গোলটা নিয়ে।
কী সেই বিতর্ক, কেন বিতর্ক? স্পেনের ডিফেন্সের শেষ খেলোয়াড় ছিলেন এরিক গার্সিয়া। তিনি বল ক্লিয়ার করার চেষ্টা করেও সফল হননি। বলের তাঁর ছোঁয়া লেগেছে কি না, তা খালি চোখে বোঝারও উপায় ছিল না। কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, এমবাপ্পে অফসাইড পজিশনে থেকে থাকতে পারেন। গার্সিয়ার বল ক্লিয়ার করার ব্যর্থতার কারণেই এমবাপ্পে ওই স্টেপ ওভারের ঝলক দেখানোর সুযোগ পান।
এমবাপ্পেকে ঘিরে ফ্রান্স দল যখন উৎসবে মাতোয়ারা, স্প্যানিশটা তখন অফসাইডের দাবিতে প্রতিবাদমুখর। সেই দাবির সত্যতা থাকতে পারে ভেবেই রেফারি অ্যান্থনি টেলর সঙ্গে সঙ্গেই ভিএআরের সহায়তা নেন। ভিএআর রুমে বেশ অনেকটা সময় মনিটরে ওই গোলের কাটাছেঁড়া হয়। কোটি টাকার প্রশ্নটা ছিল, গার্সিয়ার সঙ্গে বলের স্পর্শ হয়েছে কি হয়নি। শেষ পর্যন্ত রেফারি গোলটিকে বৈধ বলে রায় দেন।
কিন্তু স্পেন নিশ্চিত, গার্সিয়ার সঙ্গে বলের কোনো সংযোগই হয়নি। তাহলে তো এমবাপ্পে পরিষ্কার অফ সাইড, কীভাবে এটা বৈধ গোল হয়? ফাইনালে দল হারলেও টুর্নামেন্ট-সেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার বুসকেটস। কিন্তু এটা কি আর ফাইনাল হারার সান্ত্বনা হয়! ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে তাদের মাটিতেই সেমিফাইনালে প্রায় উড়িয়ে দিয়ে জিতেছে স্পেন। ফাইনালেও ফরাসিদের বিপক্ষে পজেশন ধরে রেখে মনে করিয়ে দিয়েছে পুরোনো দিনের স্পেনকে। কিন্তু ইংলিশ রেফারির এক সিদ্ধান্তেই তাদের স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো। স্পেন তা মানবে কিভাবে?
Ice cold finish from Mbappe pic.twitter.com/KVndKblXGk
— ESPN FC (@ESPNFC) October 10, 2021
বুসকেটস ক্ষোভটা গোপন করেননি, ‘রেফারি আমাদের বললেন যে, এরিক গার্সিয়া বলটা খেলেছিল বলে এটা অফসাইড না। বলটা অফসাইডে থাকা এমবাপ্পের কাছে চলে যেতে পারত ভেবেই তো সে সেটি খেলেছে! এর কোনো মানে হয় না দ্বিতীয় গোলটা আমার চোখে অফসাইড মনে হচ্ছে। আমি মনে করি, এমবাপ্পে আসলেই অফসাইডে ছিল।’
শেষ ডিফেন্ডার গার্সিয়া আলোচনার কেন্দ্রে। তাঁরও বিশ্বাস, ভুল করেছেন রেফারি। এমন একটা গোলে শিরোপার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই গার্সিয়া খুব ক্ষুব্ধ। প্রকারান্তরে রেফারি তাঁর ওপর দায় চাপাচ্ছেন বলে আরও বেশি, ‘এমবাপ্পে অফ সাইড ছিল। রেফারি আমাকে জানালেন যে, আমি বলটা খেলতে চেষ্টা করেছিলাম। তাহলে আমার কী করা উচিত ছিল? সরে গিয়ে তাকে (এমবাপ্পে) খেলতে দেওয়া?’
এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছার উপায় কী? অভিযোগটা যেহেতু স্পেনই করছে, কোনো স্প্যানিশ রেফারির মত জানাটা বেশি কাজের হবে। তাহলে এদুয়ার্দো ইতুরালদে গঞ্জালেসের কাছে যাওয়া যাক।ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ে অনেক ম্যাচ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা আছে ইতুরালদের। তাঁর রেফারিং জীবনে অবশ্য 'ভার' বলে কিছু ছিল না। ভিএআর বিশ্ব ফুটবলে জায়গা করে নিয়েছে তো খুব বেশি দিন নয়। তারপরও এমন পরিস্থিতি তাঁর সময়ে হলেও সিদ্ধান্ত যে একই হতো, সেটাই বলতে চাইছেন ইতুরালদে। গোলটি কেন বৈধ, এই ব্যাখ্যাও মিলছে তাঁর কাছ থেকে, ‘সে (এমবাপ্পে) অফসাইডের মতো পজিশন থেকে শুরু করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। (গার্সিয়া) বল ক্লিয়ার করতে চাইলে এক কথা। কিন্তু সেই বলে স্পর্শ করা মানে হলো গোলটা বৈধ। এরিক বলটা স্পর্শ করাতেই এমবাপ্পের সুযোগ এসেছে।’
ইতুরালদের কাছে এমবাপ্পের করা গোলটা তাই মোটেও বিতর্কিত নয়, ‘এরিক বল স্পর্শ করেছে। আরও সহজ করে বললে এমবাপ্পে বল ক্লিয়ার করার মতো পরিস্থিতিতে ইন্টারফেয়ার করেনি। ওখানে তাঁর বৈধভাবে থাকা শর্তসাপেক্ষ। নিয়ম বলছে ইন্টারফেয়ার করতে হবে আর এরিক গার্সিয়া বলটা ক্লিয়ার করার মতো অবস্থায় ছিল কি ছিল না। আমি যখন রেফারিং করতাম, তখনও এটাকে অফসাইড দেওয়া যেত না। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ হলো ইন্টারফেয়ার করা হয়েছে কি হয়নি।’ এর সঙ্গে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন এভাবে, ‘এমবাপ্পে ইন্টারফেয়ার করেনি। ইন্টারফেয়ার করেনি বলেই অফসাইডের প্রশ্ন বাতিল হয়ে যায়। ডিফেন্ডার এখানে বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে বলে স্পর্শ করে ফেলেছে। তা করে সে আসলে প্রতিপক্ষের উপকার করে দিয়েছে।’
ফাইনালের রেফারি অ্রান্থনি টেলরের পক্ষেই যাচ্ছে কথাগুলো। কিন্তু এটাও সত্য যে, গোলটা মেনে নেওয়ার মতো অবস্থায় এখনো আসেনি স্পেন। ক্ষতটা থেকে যে এখনো রক্ত ঝরছে।